মহর্ষি দয়ানন্দ সম্পর্কে ভজনোপদেশকগণ বলেন,

দেব দয়ানন্দ জেসা জীবন, না দেখ পাতে হ্যায়।
অর্থাৎ- এ সংসারে তো অনেক মহাপুরুষেরই আবির্ভাব হয় কিন্তু ঋষি দয়ানন্দ সরস্বতীর মতো এত মহত্ত্বপূর্ণ জীবন দেখা যায় না ।
মহর্ষি তাঁর স্বল্প কার্যকালে যা যা করে গিয়েছেন, সেসবকে প্রকাশ করার জন্য শুধু অসাধারণ শব্দটি পর্যাপ্ত নয়। তাঁর প্রতিটি কাজ জনকল্যাণের জন্য সমর্পিত ছিল। বিশেষত অবনত ভারতবর্ষকে উন্নত করাকে মহর্ষি নিজের জীবনের ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। সেই মহর্ষি দেশের মহা অবনতি দেখে কিভাবে চুপ থাকতে পারতেন ?

“ একদিন মহর্ষি বসে থাকতে থাকতে কিছুক্ষণ পরে শুয়ে পড়লেন । হঠাৎ উঠে বসলেন এবং ভারাক্রান্ত নিঃশ্বাস নিয়ে বললেন বিধবা আর গাভীদের অভিশাপে এই দেশ নষ্ট হয়েছে । ”
[পণ্ডিত লেখরাম কৃত, জীবনচরিত্র- মহর্ষি স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী / পৃষ্টা ৫৯৩]
মহর্ষি ছিলেন একজন আপাদমস্তক কর্মবীর। গোরক্ষার বিচার শুধুমাত্র মনে মনে কিংবা কাগজে কলমে লিখে রাখার মতো ব্যক্তি তিনি ছিলেন না। আর সেটা ছিলেন না বলেই গোরক্ষার মহান আন্দোলন শুরু করেন। শিখরা গোরক্ষার জন্য বিদ্রোহ করেছিলেন কিন্তু সেটি বিশেষ ফলপ্রসূ হয়নি। এটিকে আমরা বিদ্রোহ বলেই গণ্য করব । কারণ আন্দোলন হলো এমন কোনো কার্যক্রম যা বৃহৎ পরিসরে জনমানসকে আন্দোলিত করে তোলে। এবং যে কার্যক্রম ফলপ্রসূ হয়। মহর্ষি গোরক্ষাকে একটি জাতীয় আন্দোলনে পরিণত করতে সমর্থ হয়েছিলেন । জনসাধারণের মধ্যে ব্যাপক জাগরণ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। যা তৎপূর্বে কোনও মহাপুরুষ করতে পারেন নি। মহর্ষির এই আন্দোলন ফলপ্রসূও হয়েছিল। এজন্য ভারতবর্ষে মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতীই গোরক্ষা আন্দোলনের প্রবর্তক হিসেবে সম্মানিত হন।
মহর্ষির কার্যক্রমের পরিধি এতদূর ছিল যে তা একটি ছোট প্রবন্ধে বর্ণনা করা বেশ কঠিন। তাও তথ্যপ্রমাণ সহ কিছু লিখার চেষ্টা করবো-

“ এতদ্দেশে স্বামী দয়ানন্দই গোরক্ষা বিষয়ক আন্দোলনের প্রবর্ত্তক । কয়েক বৎসর পূর্ব্বে উত্তর পশ্চিমাঞ্চলে গোরক্ষা লইয়া যে ঘোর আন্দোলন উপস্থিত হয়, তৎসংশ্রবে কয়েকটি ইংরাজও স্বামিজীকেই গোরক্ষা-সংক্রান্ত আন্দোলনের প্রবর্ত্তক বলিয়া স্বীকার করিয়াছিলেন।”
[শ্রী দেবেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় কৃত- দয়ানন্দ চরিত। দ্বিতীয় ভাগ / দ্বাদশ পরিচ্ছেদ / পৃষ্ঠা- ২৮২]
স্বামী সত্যানন্দ জী লিখেছেন,
“ গো রক্ষা স্বামীজির অত্যুত্তম কার্যসমূহের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ভারতবাসীরা গোহত্যাকে চরম ঘৃণা করেন। কিন্তু কোনো সভা সংগঠিত করে গোরক্ষা করার ব্যাবস্থা সর্বপ্রথম শ্রী স্বামীজি মহারাজই জাগ্রত করেছিলেন । তৎপূর্বে অন্য কোন পুরুষ এই পদ্ধতি অবলম্বন করেননি ।
[স্বামী সত্যানন্দ কৃত, শ্রীমদ্দয়ানন্দ-প্রকাশ । রাজস্থান কাণ্ড / দ্বিতীয় সর্গ]


গোরক্ষা আন্দোলনে কার্যক্রম কোনো বিষয়ে সীমাবদ্ধ ছিল না। তাঁর কোনো প্রচেষ্টায় কমতি ছিল না। গ্রন্থ রচনা, অসংখ্য বক্তৃতা, বিপুল জনসমর্থন অর্জন, এবং একের পর এক কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ ইত্যাদিতে মহর্ষি অনন্য সাফল্য লাভ করেছিলেন। যদি আমরা বক্তৃতার বিষয়ে বলি তাহলে বলতে হয়, মহর্ষির মতো অসাধারণ বাগ্মী পুরুষ ইতিহাসে দুর্লভ। মহর্ষির জীবনচরিত্রের অধ্যয়নকারী মাত্রেই তাঁর অসাধারণ বাগ্মীতা সম্পর্কে অবগত আছেন। তিনি যে বিষয়ে বক্তৃতা দিতেন সে বিষয়ে বিরুদ্ধপক্ষের লোকেরাও তাঁর সাথে একমত হয়ে যেতেন। প্রসঙ্গত, শ্রী দেবেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় উক্ত প্রসঙ্গে লিখেছেন
“ স্বামীজির ব্যাখ্যান এক অপূর্ব সামগ্রী। যে ব্যক্তি তাঁহার ব্যাখ্যান একবার শুনিতেন তিনি বিমোহিত না হইয়া থাকিতে পারিতেন না।”
এরকম অপূর্ব বক্তা মহর্ষি যে গবাদি পশু রক্ষার বিষয়ে প্রচুর জনমত তৈরি করবেন। এ বিষয়ে সন্দেহ কি? মহর্ষি নিজের অপূর্ব বাগ্বিন্যাস এবং অকাট্য যুক্তিতর্ক দ্বারা গোরক্ষার উপকারিতা জনসাধারণের কাছে এমনভাবে প্রচার করেন যে তারা গোরক্ষার উপযোগিতা বুঝে গোরক্ষার সমর্থক হয়ে যায়।
মহর্ষির বক্তব্য, ব্যাখ্যানাদির বর্ণনায় স্বামী সত্যানন্দ জী লিখেছেন,
“ স্বামীজি মহারাজ গো-রক্ষা বিষয়ে শতাধিক প্রভাবশালী ব্যাখ্যান দিয়েছিলেন। হাজার হাজার মুসলমান এবং খ্রিস্টানদের গাভীর মহত্ত্ব বুঝিয়েছিলেন ।”
[স্বামী সত্যানন্দ কৃত, শ্রীমদ্দয়ানন্দ-প্রকাশ। রাজস্থান কাণ্ড / দ্বিতীয় সর্গ]
“ স্বামীজি মহারাজের প্রতিদিন ব্যাখ্যান হতো। হাজার হাজার মানুষ বক্তৃতা শুনতে আসতো। কালেক্টর আদি রাজকর্মচারীগণও তদুপলক্ষে সম্মিলিত হতেন এবং অত্যন্ত প্রসন্ন হতেন। স্বামীজির ভাষণের প্রভাব বর্ণনাতীত হতো।
ব্যখ্যানে গো-রক্ষার লাভ বর্ণন করে স্বামীজি মহারাজ বলেন,
“ গো হত্যার কারণে এতো ক্ষতি হচ্ছে কিন্তু দুঃখের বিষয় যে রাজপুরুষ গণ এই বিষয়ে কোনো মনোযোগ দেন না । এই দোষ আমাদেরই বেশি। আমাদের মধ্যে একতার বড়ো অভাব । যদি আমরা সবাই মিলে গো হত্যা বন্ধ করানোর জন্য নিবেদন করি তাহলে কেন তা হতে পারে না? ”
[শ্রীমদ্দয়ানন্দ-প্রকাশ । সংগঠন কাণ্ড / দশম সর্গ পৃ০- ৪২২]
শ্রী দেবেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় লিখেছেন,
“ বোম্বাইস্থ আর্য্যসমাজের উদ্যোগে এক মহাসভার অধিবেশন হইল। সেই মহাসভা মধ্যে স্বামী দয়ানন্দ গোরক্ষার আবশ্যকতা সম্বন্ধে এক তেজস্বিনী বক্তৃতা করিলেন। সেই বক্তৃতা শুনিয়া বোম্বাইয়ের অধিবাসিবর্গ স্তম্ভিত হইয়া রহিল। এমনকি সেই বক্তৃতাই তৎপ্রদেশে গোরক্ষা বিষয়ক আন্দোলনের সূত্রপাত করিল। ”
[দয়ানন্দ চরিত । দ্বিতীয় ভাগ / দ্বাদশ পরিচ্ছেদ / পৃষ্ঠা- ২৮৫]
পণ্ডিত ঘাসীরাম জী লিখেছেন–
“ স্বামীজি মহারাজের ব্যাখ্যান গোরক্ষা বিষয়ে হয়েছিল যেখানে তিনি বলেছিলেন, যদি একটি মোটাতাজা গোরুকে হত্যা করা হয় তাহলে এর মাংসের দ্বারা মাত্র ২০ জন মানুষের উদরপূর্তি হতে পারে, তাও তা তখনই সম্ভব যখন এর মধ্যে ১০ সের অন্ন মেশানো হবে । কিন্তু তাকে রক্ষা করা হলে এক বৎসরে ১৮০০০ সের দুধ দিবে, তাতে ৫ সের প্রতি মন চাল দিয়ে খাবার তৈরি করলে ২০,২৫০ জন লোকের একবার তৃপ্তি হতে পারে। এছাড়াও এর যে সন্তান উৎপন্ন হবে, তারা গাভী হলে তাদের থেকে উত্তরোত্তর লাভ হতেই থাকবে। ষাঁড় হলে কৃষিকাজে ব্যাবহৃত হয়ে হাজার হাজার মানুষের খাবারের ব্যাবস্থা করবে ।
“ দেশে হাজারো গোরুকে প্রতিদিন হত্যা করা হয় যার কারণে দেশের অত্যন্ত ক্ষতি হয়ে চলেছে। এর কারণেই এই দেশ দুর্দশাগ্রস্ত হচ্ছে। আমাদের দেশের শাসকরা এর উপর কোনও মনোযোগ দেয় না। কিন্তু এখানে শুধু শাসকেরই অপরাধ নয় আমাদেরও অপরাধ আছে। আমরা ঐক্যবদ্ধ নই একারণে উক্ত ক্ষতি হয়ে চলেছে। যদি সবাই মিলে সরকারের উদ্দেশ্যে আবেদন করি তাহলে কি গোহত্যা বন্ধ হতে পারে না? ”
[ পণ্ডিত ঘাসীরাম কৃত, " মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী কা জীবন-চরিত। দ্বিতীয় ভাগ/ চতুর্বিংশ অধ্যায় / পৃষ্টা ৫৭১]
আরো পড়ুন -