অগ্নিবীরের মূলনীতি, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য

 


মূলনীতি

অগ্নিবীর বৈশ্বিক মানবতা ও ভ্রাতৃত্ববোধে  বিশ্বাসী এবং  জাতি-ধর্ম-বর্ণের ভিত্তিতে যে কোনো ধরনের বৈষম্যকে প্রত্যাখ্যান করে। অগ্নিবীর "বসুধৈব কুটুম্বকম্" সভ্যতার গর্বিত উত্তরসূরী, আমরা এক জাতি, এক পরিবার ও এক  মানবতার ধর্মে বিশ্বাসী এবং সেটি হল এক ও অদ্বিতীয় বৈদিক ধর্ম যা সকল  মানুষকে সমান দৃষ্টিতে দেখে, যার অনুপ্রেরণা এক ও অদ্বিতীয় নিরাকার সর্বব্যাপক পরমেশ্বর।

১. অগ্নিবীর বৈদিক মানবতার ধর্মে বিশ্বাসী যা  পবিত্র বেদে বর্ণিত হয়েছে এবং যা শান্তি, সহিষ্ণুতা, একতা, সত্যবাদীতা ও  সততাকে সমর্থন দেয়। কেউ যদি এর সাথে দ্বিমত হয় তবে তার সাথে আলোচনার  ভিত্তিতে আমরা ঐকমত্যে আসতে বিশ্বাসী; অর্বাচীন বাক্যালাপ কিংবা ভয়ভীতি  প্রদর্শনে নয়। যদিও আজ পর্যন্ত বৈদিক মানবতাবাদের ত্রুটি কেউ প্রমাণ করতে  সক্ষম হয় নি।

২. অগ্নিবীর পবিত্র বেদে বিশ্বাসী যা মানবজাতির প্রথম ও  একমাত্র গ্রন্থ যা ঈশ্বরের প্রেরণায় প্রাপ্ত। অগ্নিবীর অন্য কোনো গ্রন্থকেই ঐশ্বরিক বলে বিশ্বাস করে না এবং এর পেছনে যথেষ্ট যুক্তি আছে বলেই তা করে না।

৩. তবে অগ্নিবীর কাউকে অন্ধভাবে বেদ গ্রহণ করতে বাধ্য করে নাকেননা এটি বেদের মৌলিক নীতির বিরুদ্ধে। বেদকে ঐশ্বরিক গ্রন্থ হিসেবে  মানা সিদ্ধান্ত হবে, পূর্বনির্ধারিত অন্ধ বিশ্বাস নয়; এটাই বেদের নীতি।  তাই বেদকে ঐশ্বরিক হিসেবে বিশ্বাস করে না এমন লোকদেরও আমরা সমানভাবে মহৎ ও  পুণ্যবান মনে করি যদি তারা সৎ ও চরিত্রবান হয় এবং "শুধু সত্যকে স্বীকার আর  মিথ্যাকে প্রত্যাখ্যান" এই নীতিতে বিশ্বাসী হয়।

৪. অগ্নিবীর ঈশ্বর উপাসনা ও আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য যোগের অষ্ট নিয়মে বিশ্বাসী।

যম- অহিংসা, সত্যবাদিতা, চুরি না করা, অবৈধ সঞ্চয় না করাআত্মসংযম।

নিয়ম - চিন্তা এবং মনের বিশুদ্ধতা, আত্মতৃপ্তি, 'আমিএই বোধকে'  দ্রবীভূত করে ঈশ্বরে সবকিছু উৎসর্গ করা, পরিশ্রম, অন্তর্দর্শন এবং  স্বশিক্ষা।

আসন - দীর্ঘ সময়ের জন্য ধীরভাবে মনঃসংযোগ ক্ষমতা।

প্রাণায়াম- শ্বাস প্রক্রিয়ার পর নিয়ন্ত্রণ আনা।

প্রত্যাহার - বহিরাগত ব্যাঘাতের থেকে মনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা।

ধারণা – ঈশ্বর ধারণায় মনোনিবেশ।

ধ্যান- ধারাবাহিকভাবে নির্দিষ্ট কিছুতে মনোযোগী হওয়া।

সমাধি – এমন বিশ্বাস অর্জন যে ঈশ্বর আমাদের মধ্যেই।

৫. অগ্নিবীর জ্ঞানভিত্তিক বিবর্তন পদ্ধতিতে বিশ্বাস করে এবং জোরপূর্বক  বিশ্বাস ও অন্ধবিশ্বাসর পরিণতি সর্বদা বিপরীত ও অনাকাঙ্ক্ষিতই হয় বলে মনে  করে। সেহেতু অগ্নিবীর এর পদ্ধতি হল সবচেয়ে সৎ এবং শান্তিপূর্ণ উপায়ে  জ্ঞান এবং মানসিক সচেতনতা ছড়িয়ে দেয়া।

৬. অগ্নিবীর বিশ্বাস করে  যে "নারীরা পুরুষদের চেয়ে তুলনামূলক অযোগ্য এবং নারীদের পুরুষদের তুলনায়  স্বল্প অধিকার প্রাপ্য" এরূপ যারা বিবেচনা  করে তারা বেদবিরুদ্ধ মানসিকতা  লালন করে এবং মানবতার সর্ববৃহৎ শত্রু।

৭. অগ্নিবীর সম্পূর্ণরূপে  সেইসব বিকৃতমস্তিস্কদের বিরুদ্ধে যারা জন্মভিত্তিক বর্ণপ্রথা এবং  যোগ্যতাবিহীন বংশপরম্পরার ভিত্তিতে নির্ধারিত গুরুবাদে বিশ্বাস করে এবং এর  মাধ্যমে বৈষম্যের সৃষ্টি করে। অগ্নিবীর পবিত্র বেদ বর্ণিত কর্ম ও  গুণভিত্তিক শ্রমবিভাজন তথা বর্ণাশ্রম ধর্মে বিশ্বাসী। মানবসৃষ্ট ভ্রান্ত  অমানবিক জন্মভিত্তিক বর্ণপ্রথায় নয়।

৮.অগ্নিবীর দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে  'মাতৃবৎ পরদারেসু' অর্থাৎ শুধুমাত্র নিজ স্ত্রী [একজন] ছাড়া সকল নারী  মাতৃস্বরপ। যে সকল প্রতিষ্ঠান বা অনুষ্ঠান নারীদের ভোগপণ্য হিসেবে  উপস্থাপন করে আমরা তাদের দৃঢ়ভাবে বিরোধিতা করি।

৯. আমরা বেদের ভ্রান্ত, অশুদ্ধ ভাষ্য-ব্যাখ্যাকে অগ্রহণযোগ্য  মনে করি এবং মহর্ষি-বিদ্বানগণ দ্বারা বৈদিক প্রমাণ আশ্রিত রূপসমৃদ্ধ বেদ ভাষ্য - ব্যাখ্যা অনুসরণ করি।

১০. অগ্নিবীর বদ্ধ মানসিকতায় বিশ্বাসী নয় এবং কোনো মানবীয় মতকে চূড়ান্ত বলে মনে করে না। মানবীয় সকল মতের সমীক্ষা একমাত্র ঈশ্বরের বাণী বেদ দ্বারাই হতে পারে। তাই অগ্নিবীর সর্বদাই বেদ ও বৈদিক শাস্ত্রের আলোকে আলোচনা ও শাস্ত্রার্থের মাধ্যমে সত্য গ্রহণ করতে প্রস্তুত। সত্য গ্রহণের ক্ষেত্রে বেদের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত এবং অভ্রান্ত‌; তবে অন্যান্য মার্গকেও আমরা সন্মান করি ও ভ্রাতৃসুলভ বলে মনে করি।

১১.  সমালোচনা অর্থই ঘৃণা নয়। আমরা এমনকি আমাদের পিতা-মাতার সাথেও কোনো বিষয়ে  বিতর্ক করতে পারি কিন্তু তার মানে এই নয় যে আমরা তাঁদের ঘৃণা করি। তাই  প্রচলিত কুসংস্কারের বিরুদ্ধে আমাদের বেদের আদর্শভিত্তিক বক্তব্যসমূহকে  নিন্দা বা ঘৃণার চোখে না দেখে যৌক্তিকতার চোখে দেখার আহ্বান জানাই। বৈদিক  সত্যের শুভ্র সৈনিক অগ্নিবীরেরা কোনপ্রকারেই কারো সাথে অশালীন  তর্ক, অযৌক্তিক বাক্যালাপ, কারো মতকে কুৎসিতভাবে আঘাত করতে পারে না; বরং  শান্তিপূর্ণ সুন্দর আলোচনা করতে পারে মাত্র।

১২. সর্বশেষে অগ্নিবীর  কোন বদ্ধ সংগঠন নয়, বরং এটি একটি উন্মুক্ত ধারণা। আপনি যদি বৈদিক  যৌক্তিকতার মতে বিশ্বাসী হন ও বাংলাদেশ অগ্নিবীর এর মূলনীতির অনুসারী হন,  তবে আপনিও একজন অগ্নিবীর! আমরা সকলে অহিংস হই, আমরা একে অপরের  শত্রুভাবাপন্ন না হই, আমরা সকলের কল্যাণ কামনা করি, আমরা সকলকে নিজ  পরিবারের সদস্য মনে করি। শান্তি, সহিষ্ণুতা এবং পারস্পরিক সহযোগিতা হোক  আমাদের অস্ত্র।

লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যঃ

১. সনাতন ধর্ম বেদমূলক । "বেদখিলো ধর্মমূলম্" - তাই সকল শাস্ত্র  বৈদিক সিদ্ধান্তের অনুকুল ভাবেই মান্য করা বিহিত । বর্তমানে বৈদিক  সিদ্ধান্তের নামে এবং আড়ালে অনেক সংস্কার ও বিচারধারা প্রবর্তিত হয়েছে যা  কুসংস্কার ও সম্প্রদায়গত মতভেদের জন্ম দিয়েছে । তাই বেদের সর্ব প্রামাণ্যতা  কথায় নয় বরং কাজে প্রতিষ্ঠা করাই আমাদের সর্বপ্রথম লক্ষ্য ।

২.পূর্বেষামপি গুরুঃ কালেনানবচ্ছেদাৎ। যোগ দর্শন ১.২৬

সেই ঈশ্বরই সকল গুরুরও গুরু, কেননা কালের দ্বারা তার অবচ্ছেদ নেই।

বর্তমানে অন্ধবিশ্বাসী গুরুবাদের বিরুদ্ধে সচেতনতা সৃষ্টি করা।  যোগী‌, তপস্বী, বেদজ্ঞ গুরুদেব বা আচার্য শিষ্যকে পরমাত্মা প্রাপ্তির পথ  দেখাতে পারেন, ভগবদ্ভক্ত করার ক্ষেত্রে সাহায্য করতে পারেন, বেদানুকূলভাবে  পঞ্চমহাযজ্ঞ সম্বলিত জীবন পরিচালনার ক্ষেত্রে পরামর্শ দিতে পারেন কিন্তু  তাঁর বক্তব্যই শেষ কথা নয় সাথে যুক্তি ও শাস্ত্রীয় প্রামাণ্যতাও আবশ্যক।

বর্তমানে অনেক নিজস্ব মতবাদপুষ্ট, বেদবিরোধী গুরুবাদ ও তাঁকেই ঈশ্বর  হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে বৈদিক সনাতন সিদ্ধান্তে অনৈক্যের সৃষ্টি হয়েছে যা দূর  করা বশ্যক।

৩. বলি প্রথার বিলোপ এবং বেদানুকূল সাত্ত্বিক খাদ্য গ্রহণে উৎসাহ খাদ্য বিচার নিয়ে সম্প্রদায়গত মতভেদ নির্মূল।

৪. "জন্ম নয় বরং কর্ম ও গুণেই বর্ণ" - এই মূলনীতিকে সামনে রেখে কর্ম ও  গুণের ক্রমবিকাশের ওপর ভিত্তি করে উপনয়ন, বিবাহ সংস্কারাদি পরিচালনা করা এবং  পর্যায়ক্রমে সকল সনাতনীকে ষোড়শ সংস্কারের আওতায় আনা।

৫. সর্বস্তরে  বেদ ও তদানুকূল শাস্ত্রের প্রচার-প্রসার এবং সংস্কৃত শিক্ষা প্রদান, তার  জন্য প্রতিষ্ঠান স্থাপন ও কর্মসূত্রানুযায়ী পাঠদান। বর্তমান  শাস্ত্রবিমুখদের মধ্যে শাস্ত্র সম্পর্কে আগ্রহ সৃষ্টি করা। পারিবারিকভাবে  সন্তানদের শাস্ত্রশিক্ষার জন্য উদ্বুদ্ধ করা।

৬. সামাজিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের অংশ হিসেবে অর্থনৈতিক ও কর্মক্ষেত্রীয় মৌলিক অধিকার প্রাপ্তির সুযোগ নিশ্চিত করা।

৭. নারী পুরুষের সমান মৌলিক অধিকার-যজ্ঞ, পেশা,‌সংস্কার থেকে শুরু করে  সম্পত্তির উত্তরাধিকাপর্যন্ত নিশ্চিত করা। বিশেষতঃ সম্পত্তির  উত্তরাধিকার সনাতন ধর্মাবলম্বনকারী সন্তানই হবে, ব্যতিক্রমীরা নয় তা  নিশ্চিতকর ।

৮. বাল্যবিবাহ বিলোপ, সমাজ শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে নারীদের নিজ সুরক্ষায় নিজেদেরই সমর্থ করা এবং সামাজিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠাকরণ

৯. ভিন্ন উগ্রবাদী মতবাদ কর্তৃক প্রচারিত অপপ্রচার ও চেতনা পরিবর্তনের  মাধ্যমে ধর্মান্তরকরণ [পড়ুন মতবাদের অনুসারীকরণ; কারণ মানবধর্ম একমাত্র  বৈদিক সনাতন ধর্ম, অন্য সকল "ধর্ম" মতবাদ মাত্র] রোধ ও সত্য প্রতিষ্ঠা

১০. সদ্‌ গ্রন্থ পাঠ ও বিবেকীপুরুষের মাধ্যমে অতীতে "ধর্মান্তরিত" বা নতুন  শুভাগতদের শুদ্ধি যজ্ঞের মাধ্যামে আইনি ব্যবস্থা ও ধর্মীয়ভাবে মানসিক  পরিশুদ্ধিকরণ বাস্তবায়ন করে সামাজিক ভাবে গ্রহণ।

১১. পরমেশ্বর ও  বেদমাতার বাক্য শিরোধার্য করে "এক মত, এক চিত্ত, এক আহার, এক লক্ষ্য ও এক  মিলন ভূমি" প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সনাতনের ঐক্য সাধন৷

১২. পরমেশ্বরের শ্রেষ্ঠ নাম - ও৩ম

এক মহামন্ত্র - গায়ত্রী

এই লক্ষ্যদ্বয় বাস্তবায়ন করে ঐক্য সাধন।

Post a Comment

1 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.
  1. সমান ঊর্বে অধি সংগতাসঃ সং জানতে।
    ঋগ্বেদ ৭.৭৬.৫
    মহান্ কার্যের জন্য মানবগণ একসাথে সংগঠিত হয়।

    ReplyDelete