গোরক্ষা আন্দোলনের প্রবর্তক করুণানিধি শ্রীমৎ মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী

 


🔸 গোরক্ষা আন্দোলন কী?
 
গোরক্ষা আন্দোলন একটি সামাজিক আন্দোলন। তদুপরি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ধার্মিক আন্দোলনও বটে। এই আন্দোলনের মূল সিদ্ধান্ত হলো গবাদি পশু বিশেষত গো জাতিকে রক্ষা করা। যেমন- গোরুকে হত্যা না করা, হত্যা করতে না দেওয়া, গোরুর পালন পোষণ করা ইত্যাদি। 
 
🔸গোরক্ষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট ও গুরুত্ব
 
🔹ধর্মীয় গুরুত্ব-
 
সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে সনাতনীরা কখনোই গোহত্যা করেন, কোনো কালে করতেনও না। বিপরীত দৃশ্যপটে এদেশের বহিরাগত মতাবলম্বীরা মাংসভোজন এবং কট্টর হিন্দুবিদ্বেষের বহিঃপ্রকাশ করার জন্য গোহত্যা করে এসেছে। 
 
যেমন, ভারতবর্ষে আক্রমণকারী মুসলমান শাসকদের হিন্দুবিদ্বেষের একটি অন্যতম উপায় ছিল গোহত্যা। তাদের মানসিকতা ছিল এমন যে, গোরু হিন্দুর শ্রদ্ধেয় প্রাণী। সুতরাং একে মারলে মন্দির ভাঙার মতোই হিন্দুদের অনুভূতিতে আঘাত করা যাবে। তাই একে মারো। তারা যে গোমাংসভোজীও ছিল তা বলাই বাহুল্য। সে সময়ে হিন্দুদের ধর্মভ্রষ্ট করতে বা মন্দির অপবিত্র করতে গোমাংসের প্রয়োগের ঘটনাও একদম অস্বাভাবিক ছিল না। উক্ত বিষয়ে আলাদা কোনো প্রবন্ধ লিখা যায়।
ইংরেজরা যখন পাঞ্জাব অধিকার করেছিলো তখন তারা স্থানে স্থানে কসাইখানা খুলে অসংখ্য গোরুর হত্যা করতে থাকে। এর প্রতিবাদে নামধারী শিখ সম্প্রদায় সরাসরি ইংরেজদের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। বিভিন্ন কসাইখানা থেকে গোরুদের মুক্ত করে দেয়। কিন্তু আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত ম্লেচ্ছরা শিখদের বিদ্রোহকে কঠোরভাবে দমন করে। বলা হয় উক্ত বিদ্রোহে প্রায় ৬৬ জন শিখ বীরগতিপ্রাপ্ত হন। ইতিহাসে এই ঘটনা কুকা বিদ্রোহ নামে পরিচিত। [উইকিপিডিয়া]
 
এভাবে বহিরাগত যবন জাতিগোষ্ঠী সবসময় সনাতনীদের মর্মে আঘাত করার জন্য গোহত্যার পথ বেছে নিয়েছে। সুতরাং গোরক্ষা সনাতনীদের জন্য কেবলমাত্র একটি সামাজিক আন্দোলন নয় বরং ধর্মীয় আন্দোলনও বটে।
 
গোরক্ষা আদিকাল থেকে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় আন্দোলন হওয়ার সবচেয়ে মহত্ত্বপূর্ণ যে কারণ তা হলো সনাতন ধর্মের প্রধান ধর্মগ্রন্থ পবিত্র বেদের আদেশ। বেদের বহুস্থলে গোরক্ষার আদেশ আছে। এ প্রসঙ্গে কয়েকটা বেদমন্ত্রের ভাবার্থ উদ্ধৃত করছি-
 
• জ্ঞানবান পুরুষের নিকট আমি বলেতেছি নিরপরাধ অহিংস পৃথিবী সদৃশ গো জাতিকে হত্যা করবে না।
[ঋগ্বেদ ৮।১০১।১৫]
• বনস্পতি আমাদের জন্য মধুময় হউক। সূর্য আমাদের জন্য মধুময় হউক। গো জাতি আমাদের জন্য মাধুর্যময় হউক। [ঋগ্বেদ ১/৯০/৮।]
• সত্য রক্ষক পুরুষেরা আমাদের হিতকারী হউন। অশ্ব ও গো আমাদের সুখদায়ক হউক। বুদ্ধিমান সৎকর্ম্মা শিল্পী আমাদের সুখদান করুন। অগ্নিহোত্রাদি সৎকর্ম্মে জ্ঞানীগণ আমাদের জন্য সুখদায়ক হউন।
[ঋগ্বেদ ৭/৩৫/১২]
• হে প্রকাশময় পরমাত্মন্ ! এই ভাবে তুমি আমাদিগকে শুদ্ধ কর। গোজাতি, মনুষ্যজাতি, অশ্বজাতি ও ওষধি সমূহের জন্য কল্যাণকর।
[সামবেদ উত্তরার্চিক-১/১]
• গোরু অদিতি, সে অবধ্য, তাকে হিংসা করো না। [যজুর্বেদ- ১৩/৪৩]
• হত্যার অযোগ্য গোরুকে কখনো মেরো না।
[যজুর্বেদ ১৩/৪৯]
• গো ঘাতকদের জন্য মৃত্যুদণ্ড রয়েছে।
[যজুর্বেদ ৩০/১৮]
• নির্দোষের হত্যা অবশ্যই ভয়ানক। আমাদের গো, অশ্ব, পুরুষকে মেরো না। [অথর্ববেদ ১০/১/২৯]
• হে ধেনু সকল! তোমরা কৃশ মনুষ্যকে হৃষ্ট পুষ্ট কর।বিশ্রী মনুষ্যকে সুশ্রী কর। গৃহকে মঙ্গলময় কর।তোমাদের রব মঙ্গলময়। সভা সমুহে তোমাদের বহু গুণ বর্ণনা করা হয়।
[অথর্ব্ববেদ ৪/২১/৬]
• যদি তুমি আমাদের গরু, অশ্ব ও প্রজাদিগকে হিংসা কর তবে তোমাকে সীসকের গুলি দ্বারা বিদ্ধ করিব। আমাদের সমাজের মধ্যে যেন বীরদের বিনাশকারী কেহই না থাকে।
[অথর্ব্ববেদ ১/১৬/৪।]
• এই গোশালায় ধেনু সকল নির্ভয়ে থাকুক, একসঙ্গে মিলিয়া বিচরণ করুক, গোময় উৎপন্ন করুক, অমৃতময় দুগ্ধ ধারণ করুক এবং নীরোগ হইয়া আমার নিকট আসুক।
[অথর্ব্ববেদ ৩/১৪/৩]
 
 
🔹আর্থ-সামাজিক গুরুত্ব-
ভারতবর্ষ সম্পূর্ণ কৃষিভিত্তিক দেশ। আর কৃষিভিত্তিক কোনো অর্থনীতিতে গবাদি পশুর পালন-পোষণ হওয়া একান্ত আবশ্যক। কিন্তু সুদীর্ঘকাল ধরে পরাধীন এবং যুদ্ধবিগ্রহে লিপ্ত হয়ে থাকা ভারতবর্ষে হয়েছিল তার ঠিক বিপরীত। অর্থাৎ গোরক্ষার দিকে কেউই মনোযোগ দেয় নি, বরং মুসলমান বা ইংরেজ শাসনামল। উভয় সময়েই এদেশে বিপুল সংখ্যক গো মাংসভোজী এসে বাস করেছে । তারা অসংখ্য কসাইখানা খুলে অবাধে গোহত্যা করেছে। এভাবে সুদীর্ঘকাল ধরে গোহত্যা চলতে থাকায় কৃষ্যাদি কর্ম হ্রাসপ্রাপ্ত হয়েছিলো। যার পরিণামস্বরূপ কৃষিনির্ভর ভারতবর্ষের আর্থ-সামাজিক অবনতি যেমন- দারিদ্র, দুর্ভিক্ষ, নিরক্ষরতা, পুষ্টিহীনতা ইত্যাদি নানাবিধ সমস্যা শুরু হয়। ধীরে ধীরে এই সমস্যাগুলো প্রচণ্ড আকার ধারণ করে। গবাদি পশুকে যত্নসহকারে রক্ষা করা এবং কৃষিকাজে উন্নতি করার মাধ্যমেই এসব সমস্যার সমাধান হতে পারতো। 
 
উক্ত বিষয়ে মহর্ষির জীবনী লেখকগণের দেওয়া তথ্য বিশেষ প্রণিধানযোগ্য। যেমন- পণ্ডিত ঘাসীরাম জী লিখেছেন,
 
স্বামীজি (মহর্ষি স্বামী দয়ানন্দ জী) বললেন, “দেশে হাজারো গোরুকে প্রতিদিন হত্যা করা হয়। এতে দেশের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। এ কারণেই এই দেশ দুর্দশাগ্রস্ত হচ্ছে। কিন্তু আমাদের দেশের শাসকরা এর উপর কোনও মনোযোগ দেয় না।” 
[পণ্ডিত ঘাসীরাম কৃত, " মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী কা জীবন-চরিত‌। দ্বিতীয় ভাগ/ চতুর্বিংশ অধ্যায় / পৃষ্টা ৫৭১]
 
“ এক ব্যখ্যানে স্বামীজি বলেছিলেন, আজকাল দুধ, ঘি ইত্যাদি পদার্থের মূল্য অনেক বেশি হয়ে গেছে। এখন এসব কিনে খাওয়ার সামর্থ্য অনেক লোকের নেই। গুজরাটের গ্রামগুলোতে এমন অনেক মানুষ আছে যারা দুধ, দই ইত্যাদি কখনো মুখে দিয়ে দেখতে পারে না।
সেখানকার বয়োবৃদ্ধ ব্যক্তিদের কথা শুনলে বোঝা যায় যে, পুরানো সময়ের সাপেক্ষে বর্তমানে এসব পদার্থ কতোটা দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠেছে।”
[পণ্ডিত ঘাসীরাম কৃত, " মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী কা জীবন-চরিত‌। দ্বিতীয় ভাগ/ সপ্তবিংশ অধ্যায় / পৃষ্টা ৬৫৭]
 
“ স্বামীজি দেখলেন, গোরক্ষাই আর্যাবর্তের উন্নতির মূল গোহত্যার কারণে দেশের ভয়ংকর ক্ষতি হচ্ছে। দুধ ঘি ইত্যাদি পদার্থের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাচ্ছে, অধিকাংশ লোক অনাহারে দিনাতিপাত করছে। এতে তাদের শরীর দুর্বল হচ্ছে, বিভিন্ন রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে।
কৃষিকাজের জন্য এখন আর হৃষ্টপুষ্ট বলবান ষাঁড় পাওয়া যায় না, ধীরে ধীরে ষাঁড়ের সংখ্যাও কমে আসছে। কৃষকরা অনাহারে মারা যাচ্ছে। ”
[পণ্ডিত ঘাসীরাম কৃত, " মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী কা জীবন-চরিত‌। দ্বিতীয় ভাগ / সপ্তবিংশ অধ্যায় / পৃষ্টা– ৬৬৭]
 
মহর্ষির স্বরচিত গ্রন্থ গোকরুণানিধিঃ তে তিনি অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের বিষয়ে লিখেছেন,
 
“ প্রমাণিত হইল যে গবাদি পশুর বিনাশ হইলে রাজা এবং প্রজার ও বিনাশ হয়। কারণ, পশুর সংখ্যা হ্রাস পাইলে দুগ্ধাদি পদার্থ এবং কৃষি কার্য্যাদিও হ্রাস প্রাপ্ত হয়। দেখো এই জন্যই যে মূল্যে যে পরিমাণ দুগ্ধ ঘৃতাদি পদার্থ ও বৃষাদি পশু সাতশত বৎসর পূর্বে পাওয়া যাইত সেই পরিমাণে দুগ্ধ-ঘৃতাদি পদার্থ এবং বৃষাদি পশু আজ কাল দশ গুণ মূল্যেও পাওয়া যায় না। কারণ গত ৭০০ সাত শত বৎসরের মধ্যে এই দেশে গবাদি পশুর হন্তা মাংসাহারী বিদেশী বহু সংখ্যায় আসিয়া বাস করিয়াছে। তাহারা ঐ সব সর্বহিতকারী পশুর হাড় মাংস পর্যন্তও ছাড়ে না। “নষ্টে মূলে নৈব পত্ৰং ন পুষ্পম্” কারণের নাশ করিয়া দিলে কার্যের নাশ কেন হইবে না।”

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.