আর্যসমাজের মূলনীতির প্রথম নীতিই বলে বেদ সমস্ত সত্য বিদ্যার পুস্তক । মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী স্বীয় 'সত্যার্থ প্রকাশ' গ্রন্থে আর্ষদৃষ্টিতে যে সিদ্ধান্ত প্রদান করেছেন বিদ্বৎ পর্যায়ে সেটিই প্রামাণিক বলে আর্যসমাজের সভ্যদের নিকট গৃহীত হবে । আর্যসমাজ সিদ্ধান্তগত বিষয়ে যে নীতি অনুসরণ করে -
১। বেদ ও বৈদিক তত্ত্ব অপৌরুষেয়তার পরিপন্থী কোন মতামত গৃহীত হবে না ।
২। মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী স্বীয় গ্রন্থাদিতে মতান্তর সম্পর্কে যে মতামত দিয়েছেন সেটিই স্পষ্টভাবে গৃহীত হবে । কদাচিৎ কোন বিদ্বান দ্বারা যদি বিরোধ পরিলক্ষিত হয় তবে উক্ত সিদ্ধান্ত ও বক্তব্য স্বতঃ অনুমোদনহীন ও প্রত্যাখ্যান করা হবে ।
৩। আর্যসমাজ শাস্ত্রীয় সিদ্ধান্তে ' বাদে বাদে জায়তে তত্ত্ববোধঃ ' নীতিতে বিশ্বাসী । বিদ্বানদের মধ্যে মতভেদ থাকা সম্ভব । কিন্তু বেদ ও আর্ষদৃষ্টিকে অভ্রান্ত এই নীতিকে অনুসরণ করতে হবে । ফলশ্রুতিতে কোন বিদ্বানের দ্বারা আপাত বিরোধ পরিলক্ষিত হলেও তার সামগ্রিক সিদ্ধান্ত পরিত্যাজ্য না হয়ে উক্ত বিরোধাভাসপূর্ণ সিদ্ধান্তই খণ্ডনপূর্বক বৈদিক তত্ত্বাভাস স্থাপিত হবে ।
৪। মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী থেকে শুরু করে সমস্ত আর্ষ পরম্পরার বিদ্বানদের মতামত শাস্ত্রালোকে গৃহীত । শাস্ত্রভিত্তিতে পৌরুষেয় শাস্ত্রের মতের অনুসরণে কৃত সিদ্ধান্ত দোষাবহ গণ্য হবে না বরং পথপ্রদর্শক রূপে পরিগণিত হয়ে আধুনিকতম ও শুদ্ধতর সিদ্ধান্তই অনুসৃত হবে ।
মহর্ষি
দয়ানন্দ সরস্বতী ব্যতীত কোন বিদ্বানই ঋষিকোটির হিসেবে আমরা স্বীকার করি না
। এমতাবস্থায় বৈদিক তত্ত্ব নিয়ে সিদ্ধান্তগত মতভেদ থাকলেও তা গুরুতর নয়
এবং চূড়ান্ত যৌক্তিক সিদ্ধান্তই গ্রহণযোগ্য হবে । আন্তর্জাতিক
কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘে যেমন শ্রীল প্রভুপাদ কিংবা রামকৃষ্ণ
মিশনে স্বামী বিবেকানন্দ - শ্রীরামকৃষ্ণ যেমন মূল তেমনি বাকি বিদ্বানরা
কিন্তু এখানে মূল নয় বরং মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতীই সংস্থাপক । তাই যদি কেউ
কোন বিদ্বানের মতামত নিয়ে আর্যসমাজকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চায় তবে সে ভুল করবে
২টি কারণে -
১। বৈদিক অপৌরুষেয়তা নিয়ে সব বিদ্বান একমত ।
২। উক্ত সিদ্ধান্তই আর্যসমাজের মূল ভিত্তি স্বরূপ ।
উদাহরণস্বরূপ -
১।
পণ্ডিত রাজারাম শাস্ত্রী ও পণ্ডিত বিশ্ববন্ধু শাস্ত্রীর যাস্কীয় ইতিহাসবাদ
মান্যতা স্বামী ব্রহ্মমুনি, মহামহোপাধ্যায় পণ্ডিত আর্যমুনি, পণ্ডিত
শিবশঙ্কর শর্মা কাব্যতীর্থ, পণ্ডিত অমর স্বামী সরস্বতী, মহামহোপাধ্যায়
আর্যমুনিজী কর্তৃক মহাত্মা হংসরাজের সভাপতিত্বে আভ্যন্তরীণ শাস্ত্রার্থে খণ্ডিত হয় ।
২।
স্বামী জগদীশ্বরানন্দ দ্বারা কৃত রামায়ণের নির্বাচন বিশেষ পণ্ডিত অমর
স্বামী সরস্বতীজীর 'রামায়ণ দর্পণ' গ্রন্থের টীকায় শ্রী লালা লাজপত রায়
দ্বারা খণ্ডিত ।
৩।
বেদরত্ন শ্রী উদয়বীর শাস্ত্রীজীর সাংখ্যদর্শনে প্রক্ষিপ্ততা ও মীমাংসার
সূত্রে মাংসের উল্লেখ ড. জ্বলন্ত কুমার শাস্ত্রী, মহামহোপাধ্যায় আর্যমুনিজী
ও স্বামী ব্রহ্মমুনি পরিব্রাজক দ্বারা সদ্ ব্যাখ্যাত ।
৪। শ্রী অগ্নিব্রত নৈষ্ঠিকের রশ্মি তত্ত্ব পরোপকারিণী সভা ২০১৩ সালের মে মাসের ২য় পত্রিকায় মুনি সত্যজিৎজী দ্বারা ভ্রান্ত ঘোষিত ।
প্রাসঙ্গিক
ঘটনা দিয়েও বিষয়টা বোঝা যেতে পারে । যেমন স্বামী জগদীশ্বরানন্দ সরস্বতী
মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতীজীকে নিয়ে লেখা একটি বইতে অত্যস্তুতি করেছেন যা কিনা
সরাসরি মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতীজীর মৌলিক মান্যতা বিরোধী । তাই
স্বাভাবিকভাবেই উক্ত সিদ্ধান্ত গৃহীত হবে না । আবার এতে স্বামী
জগদীশ্বরানন্দ সরস্বতীর অন্য কৃতিত্বও ম্লান হবে না কেননা আর্যসমাজ নিজেই
তার বক্তব্যের খণ্ডন করার ও তা বলার সামর্থ্য রাখে ।
এবার
অন্যদিকে আসি । রামকৃষ্ণ মিশনের ' জগতে যত ধর্মমত ' বইতে ইসলাম ও নবীকে
নিয়ে অত্যন্ত মহাপুরুষ বা ভালো ভালো (?) কথা আছে । রামকৃষ্ণ মিশন কি তা
অস্বীকার বা প্রত্যাখ্যান করতে পারে বা করেছে ? স্টেটমেন্ট দেওয়ার
সামর্থ্য রাখে যেভাবে আমরা রাখি বা আমাদের বিদ্বানগণ কোন সিদ্ধান্ত খণ্ডনে
রাখেন ? তারা করেনি ।
আবার স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন বেদে কুসংস্কার আছে , শ্রীরাম বা শ্রীকৃষ্ণ
মদ্য-মাংস খেতেন । এটা তারা অস্বীকার করতে পারবে ? এখন স্বামী
জগদীশ্বরানন্দ সরস্বতী আর্যসমাজের সংস্থাপক না বরং সেবক মাত্র, কিন্তু
স্বামী বিবেকানন্দ তো রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের সংস্থাপক । দুটোর তুলনা যারা
করে তাদের মন্দবুদ্ধি বলা আর কি উপায় ? একই কথা শ্রীরামকৃষ্ণ, শ্রীল
প্রভুপাদসহ সবার উক্তির জন্যে প্রযোজ্য যে তাদের বক্তব্য বৈধ করার
জন্য সেবকমাত্রের কোন সামান্য ভ্রান্তির অংশবিশেষ তুলে এনে যারা প্রচার করে
তারা এটাই প্রমাণ করে যে তারা যাদের রক্ষা করতে চাচ্ছে তাদের অবস্থান
মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতীর চরণ তো দূরে থাক তার এক সেবকের তুল্যও না ।
উল্লেখ্য,
উক্ত সমস্ত সিদ্ধান্তই বেদের অপৌরুষেয়তার সাথে সম্পর্কহীন ও বৈদিক
মান্যতার সাথে মূখ্যত কোন সংঘর্ষ তৈরি করে না । অধিকন্তু বিদ্বানগণে
মতান্তর হলেও মনান্তর নেই এবং চূড়ান্ত সিদ্ধান্তই গৃহীত হয় । তাই অন্য
সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতাগণের প্রদরর ভ্রান্ত মতবাদের সাথে বিদ্বৎ শ্রেণীর
শাস্ত্রীয় চিন্তাধারার তুলনা করাটা মূর্খসুলভই হবে ।
আরো পড়ুন - আর্যসমাজ কোন কোন শাস্ত্র কিভাবে মানে
মহর্ষি দয়ানন্দের শাস্ত্রীয় চিন্তাধারা এবং শাস্ত্রে প্রক্ষিপ্ত বা যোজনার (মিশ্রণের) সঠিক চিহ্নিতকরণের জন্য সতর্কতা
বর্তমানে মহর্ষি দয়ানন্দ জীর শাস্ত্রীয় চিন্তাধারা পূর্ণ (পূর্ণ বলতে এখানে ঈশ্বরের পরবর্তী সর্বোচ্চ অর্থে) এবং আমাদের একমাত্র পথপ্রদর্শক। এ থেকে বড় কোনো পথপ্রদর্শক এই সময়ে নেই, এটি আমাদের মনে রাখতে হবে। শাস্ত্রের প্রক্ষিপ্ত বা যোজনা চিহ্নিত করার সময় নিম্নলিখিত সতর্কতাগুলো মেনে চলা উচিত:
- যে অংশ প্রক্ষিপ্ত বা যোজনা মনে হয়, তা মুছে (মন থেকে সরিয়ে, গ্রন্থ থেকে নয়) দেখুন, যাতে গ্রন্থের বিষয় বা ধারাবাহিকতা ভেঙে না পড়ে। যদি বিষয় বা ক্রম ভেঙে যায়, তাহলে তা প্রক্ষিপ্ত নয়। আর এমন হতে পারে যোগ করা হয়েছে পড়ে। যোজনা সরিয়ে দিলে মূল বিষয়ের বিকৃতি ঘটে না, কিন্তু প্রক্ষিপ্ত করা হয় মূল বিষয়ের পরিবর্তনের জন্য।
- যে প্রসঙ্গকে প্রক্ষিপ্ত বা যোজনা মনে করছেন, তার গ্রন্থে অন্য কোনো প্রকরণ আছে কিনা দেখুন। যদি সম্পর্ক থাকে, তাহলে ভুল বোঝার কারণে তা প্রক্ষিপ্ত নয়। হতেই পারে কোনো বক্তব্য নেতিবাচক মনে হচ্ছে, কিন্তু সেই বক্তব্য কোনো সাধু ব্যক্তির বক্তব্য হিসেবে উল্লেখিত না কি নেতিবাচক ব্যক্তির সেটিও দেখতে হবে। কেননা নেতিবাচক ব্যক্তির মতামত মন্দ হতেই পারে, তাতে তা প্রক্ষিপ্ত হয়ে যায় না। আর যদি ইতিবাচক বা সাধু ব্যক্তির বক্তব্য হিসেবে দেখা যায় তবে তা প্রক্ষিপ্ত হতে পারে।
- যে শব্দটি প্রক্ষিপ্ত মনে হচ্ছে, তার অর্থ একই গ্রন্থ বা অন্য কোনো শাস্ত্রে খুঁজে দেখুন, যাতে জানা যায় তার অন্য কোনো অর্থ আছে কিনা। অনেক সময় একই শব্দের ভিন্ন অর্থ থাকে কিন্তু অনুবাদকদের জ্ঞানের স্বল্পতার জন্য বিরুদ্ধ অর্থ দেখা যায়।
- যে প্রকরণকে প্রক্ষিপ্ত মনে করছেন, তার প্রকৃতি বুঝুন। সাধারণ বিদ্বান প্রক্ষিপ্ত করতে পারে না; প্রক্ষিপ্ত করতে হলে তাকে ব্যাকরণ, ছন্দ ইত্যাদির গভীর জ্ঞান থাকতে হবে। যেমন: ঐতরেয় ব্রাহ্মণ গ্রন্থে একটি রহস্যময় প্রকরণ আছে যেখানে দেবতারা যজ্ঞে মানুষের অংশ পশুতে স্থানান্তরিত করেন। এতে প্রক্ষিপ্তকারী এত বোকা হতে পারে না যে, গরু নীলগাই বা ভেড়া উট হয়ে যায়। কিংবা ঐতরেয় ব্রাহ্মণ বা গোপথ ব্রাহ্মণে পশুর অঙ্গ বিভাজন দেখা যায় যা কিনা মূলত ছন্দের রূপক। কোনো কোনো প্রসঙ্গ রহস্যময় অর্থ বহন করে, বুঝতে ভুল হতে পারে। এজন্য দেখতে হবে কাহিনীটি স্থূল নাকি রূপক। বর্তমান বেদবিদ্যার ধারায় প্রচলিত অনেক রূপক ব্যাপারকে ভিন্ন সম্প্রদায় স্থূল হিসেবে চিন্তা করেন। এখানে বিদ্বানদের মতভেদ দেখা গেলেও সকলেই পূজ্য এবং প্রক্ষিপ্ত না মেনে যদি বেদের অবিরোধীরূপে অর্থ ও ব্যাখ্যাপূর্বক গ্রহণ করা যায় সেটিই স্বীকার্য।
- গণনা বা ভূগোলের ক্ষেত্রে সময়ের সাথে পরিবর্তন হতে পারে। যেমন, লঙ্কা ১০০ যোজন দূরে উল্লেখ থাকলেও আজকের দূরত্ব কম। তাই বর্তমানের ভিত্তিতে দ্রুত প্রক্ষিপ্ত ধরে নেওয়া উচিত নয়। এজন্য বাস্তবিক ব্যাখ্যা কীভাবে হতে পারে সেই অনুযায়ী ব্যাখ্যা গ্রহণ করতে হবে। যাতে বেদানুকূলও হয় আবার যুক্তিগ্রাহ্যও হয়।
- যে কাজ বা বিষয় আমি বুঝতে আমি পারি না, তা অন্য কেউ পারবে না ভাবা ভুল। যেমন, গীতাকে অনেকেই অনেকেই প্রক্ষিপ্ত মনে করেন। কিন্তু আমাদের সীমিত বুদ্ধি দিয়ে কোনো পরিপ্রেক্ষিত না বুঝে অস্বীকার করা উচিত নয়। আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে সঠিক ব্যাখ্যা করার। তবে অনার্ষ গ্রন্থে এই কাজ হেত্বাভাস হবে। কেননা অনার্ষ গ্রন্থে আর্ষ সিদ্ধান্ত স্বীকার করা হয় না।
- কেউ কেউ নিজের মতবাদ প্রচারের জন্য গ্রন্থ থেকে মূল বিষয়কে প্রক্ষিপ্ত বা সঠিক না বলে মুছে দিয়ে নিজের মতবাদ তৈরি করার চেষ্টা করে। যেমন আজ বিভিন্ন ধরনের যোগ প্রচলিত, যা মূল পাতঞ্জল যোগদর্শন থেকে বিচ্ছিন্ন, সাংখ্যদর্শনকেও বিকৃত করার প্রচেষ্টা করা হয়েছে।
- শব্দের অর্থ প্রকরণ অনুসারে রূঢ় না কি যৌগিক তা বুঝতে হবে। যদি রূঢ় হয় এবং প্রসঙ্গ-শাস্ত্র-সৃষ্টিনিয়ম বিরুদ্ধ হয় তবে তা স্বীকার্য নয়।
- যে ব্যক্তি শাস্ত্র ও সৃষ্টির গভীর জ্ঞান রাখে না, সে সহজে সব কিছু প্রক্ষিপ্ত বা যোজনা বলে দিতে পারে। আভার যার স্বাভাবিক জ্ঞান আছে সে অবাস্তব ব্যাপার সহজেই ধরতে পারবে যা কিনা সাম্প্রদায়িক ব্যক্তিরা জোর করে হলেও স্বীকার করতে চায় না। যেমন, কেউ যদি কখনো বিমান না দেখে, তাহলে সে আকাশে বাস চলাকে সৃষ্টিবিরুদ্ধ মনে করবে।
- ইতিহাসে প্রক্ষিপ্ত বা যোজনা চলতে থাকে এবং আজকের মহাভারতে লক্ষাধিক শ্লোক রয়েছে, রামায়ণেও বহু যোজনা আছে। প্রক্ষিপ্ত চিহ্নিত করা কঠিন এবং তর্ক ও ন্যায়দর্শন ভিত্তিক অনুমানের ভিত্তিতে করা উচিত।
- যে অংশ প্রক্ষিপ্ত মনে হয়, তা সব গ্রন্থ থেকে সরিয়ে ফেলা উচিত নয়। কারণ এক ব্যক্তির মতে প্রক্ষিপ্ত মনে হলে তা সরালে গ্রন্থ শেষ হয়ে যাবে। বরং প্রক্ষিপ্ত হিসেবে চিহ্নিত করে গ্রন্থে রাখা উচিত। হতে পারে টীকায় বা মূলেই চিহ্নিত করে। এতে যারা বুঝতে চায় কেন প্রক্ষিপ্ত তা জানতে সহজ হবে। হ্যাঁ জনসাধারণের জন্য কেবল প্রকৃতভাগ পৃথকভাবে প্রচার করা যেতে পারে।