মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতীর সরল ও শ্রুতিমধুর সংস্কৃতে বক্তৃতা

 


🔥 মহর্ষি কেন সরল সংস্কৃতে কথা বলতেন ?
 
মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী বাল্যকাল থেকেই সংস্কৃত ভাষার প্রতি আগ্রহী ছিলেন। মহর্ষির জীবনচরিত্র থেকে জানা যায় তিনি বাল্যকাল থেকেই সংস্কৃত ভাষা এবং তদসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ব্যাকরণগ্রন্থ অধ্যয়ন করা শুরু করেছিলেন। গৃহত্যাগ করে সন্ন্যাস গ্রহণের পরও বহু সংস্কৃত গ্রন্থের অধ্যয়ন করেন । এরপর তৎকালীন যুগে সংস্কৃত ভাষা ও ব্যাকরণের সর্বশ্রেষ্ঠ বিদ্বান, প্রজ্ঞাচক্ষু স্বামী বিরজানন্দ জী দণ্ডীর সান্নিধ্যে দীর্ঘদিন অধ্যয়ন করে তিনি সংস্কৃত ভাষা এবং ব্যাকরণের অপূর্ব বিদ্বান হয়ে উঠেন । গুরুদেব বিরজানন্দের কাছে বিদ্যা অর্জন শেষে মহর্ষি মূলত সংস্কৃতেই বেশি কথা বলতেন। মহর্ষির অনেক ব্যাখানাদিও সংস্কৃত ভাষায় হতো। সবাই যেহেতু সংস্কৃত ভাষা বোঝে না এজন্য মহর্ষি খুবই সরল রীতিতে সংস্কৃত বলতেন যাতে সংস্কৃত ভাষা সবার বোধগম্য হয়। বাংলা হিন্দি প্রভৃতি আর্যাবর্ত দেশীয় ভাষার সাথে সংস্কৃত ভাষার একটি গভীর সম্পর্ক আছে। সুতরাং সরল রীতিতে সংস্কৃত বললে তা জনসাধারণেরও বোধগম্য হয়ে যেতো।
 
সংস্কৃতের প্রচার- মহর্ষি সবসময় সংস্কৃত ভাষার প্রচারকে উৎসাহিত করতেন । তিনি মনে করতেন যে মানুষ যদি বলা সংস্কৃত কিছু বোঝে তাহলে অবশ্যই তারা সংস্কৃত ভাষার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠবে । 
 
🔥 মহর্ষি বলতেন, “আমি সরল সংস্কৃতে এজন্যই বলি যাতে শ্রোতাগণের পক্ষে আমার কথা সহজে বোধগম্য হয়”।--
 
❝ জেঠালালজী মহর্ষিকে বললেন, “ আপনার বলা সংস্কৃত খুবই সহজবোধ্য হয়। পণ্ডিতদের মতো জটিল ভাষা আমি আপনার থেকে শুনি নি। দ্বিতীয়ত, যখন আপনি আপনি পণ্ডিতদের সাথে শাস্ত্রার্থ করেন তখনও তাদের মুখ কেবল যুক্তি ও প্রমাণের দ্বারাই চুপ করিয়ে দেন। (তথাকথিত) পণ্ডিতরা তো এক একটি শব্দ নিয়েই সারা দিন পার করে দেন। আপনি এমন করেন না কেন? ”
 
উত্তরে শ্রীমৎ দয়ানন্দ সরস্বতী মহারাজ বললেন, “ মহাশয়জী! আমি সরল সংস্কৃতে এজন্যই বলি যাতে শ্রোতাগণের পক্ষে আমার কথা সহজে বোধগম্য হয়। আমার উদ্দেশ্য জনতাকে বোঝানো, নিজের পাণ্ডিত্য প্রদর্শন নয়। তবে এটা জেনে রাখুন, সহজ করে বলার রীতি কোনো ভাষার অল্প জ্ঞানের দ্বারা লাভ করা যায় না। আর আমার কাছে এতো সময় কোথায়? যে আমি এক একটি শব্দের জোড়াতালিতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দিবো। যারা কর্মহীন এবং উদ্দেশ্যশূন্য, তারাই এক একটি শব্দ বিবেচনায় সারা দিন কাটিয়ে দেয়। আমার সময় জনতার জন্য সমর্পিত। একে আমি পক্ষীর মতো ব্যায় করতে পারি না।” ❞ -1
 
🔥 সাধারণ মানুষের বোধগম্যতা
❝ মহর্ষি চকেরীগ্রামের কাছাকাছি এসে এক চামারকে সরল সংস্কৃতে চকেরীগ্রামে যাওয়ার পথ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেন। সে স্বামিজীর অভিপ্রায় বুঝে যায় এবং হাত তুলে পথ দেখিয়ে দেয়। ❞ -2
 
🔥 মহর্ষির সরল সংস্কৃত বলা নিয়ে উপহাস! দক্ষিণী পণ্ডিতদের অহংকার চূর্ণ---
 
❝ বড়োদায় স্বামিজীর আগমনের অনেক আগেই পণ্ডিতগণ শাস্ত্রার্থ করার জন্য প্রস্তুতি নিয়ে সুসজ্জিত ছিলেন । এজন্য ব্যাখ্যান সমাপ্তির পরেই শাস্ত্র সমর আরম্ভ হয়ে গেল। স্বামীজি মহারাজ এমন সরল সংস্কৃতে কথা বলতেন যে তা খুব সহজেই বোধগম্য হতো। কিন্তু পণ্ডিতগণের এসব ভালো লাগলো না । তারা বার বার উপহাসপূর্বক জটিল সংস্কৃতে বলার জন্য আহ্বান করতে থাকেন । একজন শাস্ত্রী বললেন, “ মহাত্মাজী! কেবল ‘ভবতি’ ‘পচতি’ মাত্রে কাজ হবে না । আপনি দক্ষিণী পণ্ডিতদের হাতে পড়েছেন।
” প্রতিপক্ষের প্রবল প্রেরণায় স্বামিজী মহারাজ অপ্রসিদ্ধ শব্দপূর্ণ ( সাধারণত অপরিচিত শব্দ) , সমাস বহুল, অনেকার্থবোধক এমন জটিল সংস্কৃত বলা শুরু করলেন যে প্রতিপক্ষের পণ্ডিতগণ শুধু দেখতেই থাকলেন । তারা মহারাজের অনর্গল বলে চলা সংস্কৃতের সব কথা বুঝতেই পারেন নি, উত্তর কি দিবেন? সবাইকে মৌন-মূর্তি হয়েই থাকতে হলো। ❞–3
 
🔥 মহর্ষির সরল ও শ্রুতিমধুর সংস্কৃতে বক্তৃতা এবং প্রত্যক্ষ শ্রোতাগণের অভিমত-
 
🔥 ❝ নানা শ্রেণিস্থ লোক দয়ানন্দের নিকট উপস্থিত হইতে লাগিল । প্রাতে ও সন্ধ্যাকালে লোকের সমাগম অধিক হইত। সমাগত লোকদিগের ভিতর কেহ কেহ কৌতুহল-পরবশ হইয়া প্রশ্ন উত্থাপিত করিত। কিন্তু তাহাদিগের অনেকেই দয়ানন্দের তেজোদ্দীপ্ত মূর্ত্তি, প্রসারিত ললাট, প্রতিভাময় মুখমণ্ডল এবং শাস্ত্র বিবৃতির একরূপ অপূর্ব্ব ভঙ্গি দেখিয়া একেবারে নির্ব্বাক হইয়া রহিত । ❞ –4
 
🔥 ❝ কেশব বাবুর বাটীতে যে দিন প্রথম দয়ানন্দের বক্তৃতা শুনিলাম, সে দিন একটি নূতন ব্যাপার প্রত্যক্ষ করিলাম । সংস্কৃত ভাষায় যে এমন সরল মধুর বক্তৃতা হইতে পারে; জানিতাম না। তিনি এমনি সহজ সংস্কৃত বলিতে লাগিলেন যে, সংস্কৃত ভাষায় যে ব্যক্তি মহামূর্খ, সেও অনায়াসে তাঁহার কথা বুঝিতে লাগিল। আর একটি বিষয়ের জন্য আশ্চর্য হইলাম। ইংরেজি ভাষায় অনভিজ্ঞ হিন্দু সন্ন্যাসীর মুখে ধর্ম্ম ও সমাজ সম্বন্ধে এমন উদার মত সকল পূর্ব্বে কখনও শুনি নাই। ❞ –5
 
🔥 ❝ মণ্ডল বাবুদিগের গৃহে দয়ানন্দের একদিন বক্তৃতা হয়। সেই বক্তৃতা-স্থলে বঙ্গ সাহিত্যের সুপরিচিত সেবক শ্রীযুক্ত অক্ষয়কুমার সরকার মহাশয় উপস্থিত ছিলেন। তিনি সেই বক্তৃতা সম্বন্ধে গ্রন্থকারকে লিখিয়াছেন যে, " আমাদের সমক্ষে চুঁচড়ার মণ্ডলদের বাটীতে পণ্ডিতবর একদিন অপরাহ্নে বক্তৃতা করেন, সেই সময় ভট্টপল্লীর কতকগুলি পণ্ডিত উপস্থিত ছিলেন । তাঁহার অতি সহজ সংস্কৃত বলার ক্ষমতা দেখিয়া আমি তাঁহাকে মনে মনে শতবার প্রশংসা করিয়াছিলাম। ঐরূপ সহজ সংস্কৃতে যে অতি কঠিন বিষয়ের ব্যাখ্যান হইতে পারে, তৎপূর্ব্বে সে ধারণা আমার ছিল না । তাঁহার প্রচুর ভঙ্গিতে তাঁহার ভাষা সহজেই অনেকের বোধগম্য হইয়াছিল । ❞ –6 
 
🔥 “ ৯ই মার্চ তারিখে বরাহনগর নাইট-স্কুল-গৃহে আর এক বক্তৃতা হইয়াছিল। সেই বক্তৃতা সম্বন্ধে বরাহনগরের একজন শিক্ষিত ব্যক্তি এইরূপ লিখিয়া গিয়াছেন :-
 
 ❝ পণ্ডিত দয়ানন্দ সরস্বতী ৯ মার্চ রবিবার অপরাহ্ন সাড়ে তিন ঘটিকার সময় বৈদিক মত সম্বন্ধে এক বক্তৃতা করিয়াছেন। বক্তৃতাস্থলে বহুসংখ্যক শিক্ষিত ও সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি উপস্থিত হইয়াছিলেন। বক্তা-মহাশয় বেদির উপর গম্ভীর ভাবে উপবিষ্ট হইয়া একটি প্রার্থনা পূর্ব্বক কার্য্য আরম্ভ করিয়াছিলেন। সমাপ্ত হইতে তিন ঘণ্টারও অধিক সময় অতিবাহিত হইয়াছিল। বক্তৃতা যদিও সংস্কৃত ভাষায় হইয়াছিল, তাহা হইলেও সরস্বতী মহাশয়ের সংস্কৃত যার পর নাই সরল সুমিষ্ট ও আবেগময়। তিনি বৈদিক প্রমাণ অবলম্বন করিয়া ঈশ্বরের একত্ব, জাতিভেদ ও বাল্য-বিবাহের অপকারিতা অতি সহজেই বুঝাইয়া দিয়াছিলেন। দয়ানন্দের বাগ্মিতা অতি অসাধারণ। তাঁহার বক্তৃতা শুনিলে কেবল তাঁহাকে একজন সৰ্ব্বশাস্ত্র-দর্শী বোধ হয় না। বলিতে কি, তিনি যে একজন বিলক্ষণ ভাবুক ও ভূয়োদর্শী ব্যক্তি তাহাও তাঁহার কথা শুনিয়া বুঝিতে পারা যায়। দয়ানন্দের যুক্তি সকল একান্ত তীব্র ও প্রবল, এবং তাঁহার হৃদয় সৰ্ব্বোতোভাবেই ভীতিশূন্য। আমরা ভরসা করি, কলিকাতার শিক্ষিত ব্যক্তিগণ ভবিষ্যতে তাঁহার বক্তৃতা শুনিতে যত্নপর রহিবেন। ❞–7 
 
🔥 ❝ ইংল্যান্ডের বিখ্যাত পণ্ডিত মনিয়র উইলিয়মস বোম্বায়ে আসিয়াছিলেন। তিনি দয়ানন্দের সহিত আলাপার্থী হইয়া তথাকার আর্য্যসমাজে এক দিবস উপস্থিত হইলেন। দয়ানন্দের যার পর নাই সরল ও সুমিষ্ট সংস্কৃতে ব্যাখ্যান শুনিয়া মনিয়র উইলিয়মস বিমোহিত হইয়া রহিলেন, এবং ব্যাখ্যান শেষে তাঁহার সহিত আলাপ করিয়া পরিতৃপ্ত হইয়া আসিলেন।❞ –8 
 

তথ্যসূত্র :-
 
1. [ স্বামী সত্যানন্দজী প্রণীত, শ্রীমৎ দয়ানন্দ প্রকাশ । কাশী কাণ্ড / দশম সর্গ ]
2. [ পণ্ডিত লেখরাম কৃত, জীবনচরিত্র - মহর্ষি স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী / পৃষ্ঠা- ২০২ ]
3. [ শ্রীমৎ দয়ানন্দ-প্রকাশ / সংগঠন কাণ্ড / প্রথম সর্গ ]
4. [ শ্রী দেবেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় প্রণীত, দয়ানন্দ চরিত / ২য় ভাগ, সপ্তম পরিচ্ছেদ / পৃষ্ঠা- ২০২]
5. [ শ্রীযুক্ত নগেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় প্রণীত মহাত্মা দয়ানন্দ সরস্বতীর সংক্ষিপ্ত জীবনী। পৃষ্ঠা- ২ ]
6. [ দয়ানন্দ চরিত / ১ম ভাগ/ ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ ।পৃষ্ঠা- ১৯২]
7. [ দয়ানন্দ চরিত/ ১ম ভাগ/ ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ। পৃষ্টা-১৯০]
8. [ দয়ানন্দ চরিত । ২য় ভাগ / দ্বাদশ পরিচ্ছেদ / পৃষ্ঠা-২৮৫ ]

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.