মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতীর জীবনের শেষ দিনগুলোর সংক্ষিপ্ত বর্ণনা
- বীরভূমি রাজস্থানে যাত্রা, বৈদিক ধর্মের প্রচার ও মহারাণা তথা মহারাজদের ধর্মশিক্ষা দান ও সংশোধন
রাজস্থানের প্রাচীন বীরত্বপূর্ণ ইতিহাসে দয়ানন্দ সরস্বতী প্রভাবিত ছিলেন। তিনি বুঝতেন যে যদি রাজস্থানের রাজা এবং ঠাকুরদের মধ্যে বৈদিক ধর্মের প্রচার করা হয় এবং তাদের জীবনকে উন্নতির পথে নিয়ে আসা যায়, তবে দেশের আরও উন্নতি হতে পারে। রাজাকে দেখে প্রজার দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আসতে পারে। একজন রাজার সংশোধিত হওয়ার ফলে সম্পূর্ণ প্রজার সংশোধিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। প্রজাও সুখী ও সমৃদ্ধ হতে পারে। রাজস্থান থেকে দয়ানন্দ সরস্বতীর কাছে নিমন্ত্রণও আসছিল।
আগ্রা থেকে যাত্রা করে স্বামীজি মহারাজ ফাল্গুন শুক্লা দশমীতে, সংবৎ ১৯৩৭ (দশ মার্চ ১৮৮১ খ্রিস্টাব্দ) তারিখে, ভরতপুরে আগমন করলেন। দশ দিন পর্যন্ত এখানে অবস্থান করে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ভক্তদের মধ্যে বৈদিক আদর্শের বিষয়ে উপদেশ দিতে থাকলেন।
ভরতপুর থেকে চৈত্র মাসের কৃষ্ণা পঞ্চমী, সংবৎ ১৯৩৭ (১৮৮১ খ্রিস্টাব্দ) তারিখে, জয়পুরের উদ্দেশ্যে প্রস্থান করলেন। এখানে গঙ্গাপোলের বাইরে অচরোলের ঠাকুরের উদ্যানে তিনি নিবাস করলেন। একদিন অচরোলের ঠাকুরের হাভেলিতে তিনি বক্তৃতা দিলেন। কৌতূহলী ব্যক্তিদের সন্দেহ নিরসন করতে করতে তাদের জ্ঞানপিপাসা শান্ত করলেন। বৈদিক ধর্মের স্থায়ীভাবে প্রচারের জন্য "বৈদিক ধর্ম সভা" প্রতিষ্ঠা করলেন। এই সভা ভবিষ্যতে আর্যসমাজ রূপে পরিণত হয়েছিল।
জয়পুর থেকে বৈশাখ মাসের শুক্লা সপ্তমী, সংবৎ ১৯৩৮ (১৮৮১ খ্রিস্টাব্দ) তারিখে, আজমীরে পদার্পণ করলেন। এখানে শেঠ ফতেহচাঁদের উদ্যানে আশ্রয় গ্রহণ করলেন। আজমীরে আর্যসমাজ ৯২-এর প্রতিষ্ঠা পূর্বেই হয়ে গিয়েছিল। স্বামীজির আগমনের সংবাদ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল। বৈশাখ মাসের শুক্লা দশমী থেকে প্রতিদিন মহারাজের বক্তৃতা শুরু হল। বক্তৃতাগুলি সরস এবং সরল ভাষায় হত। সাধারণ মানুষও শাস্ত্রের গুঢ় বিষয়গুলি ভালোভাবে বুঝতে পারত। বাইশ দিনে স্বামীজি ছাব্বিশটি বক্তৃতা দিলেন। শ্রোতারা প্রতিদিন বৃহৎ সংখ্যায় অমৃত পান করতে আসতেন। তাঁরা এই অমৃত রসে এত আনন্দ অনুভব করতে লাগলেন যে বক্তৃতার সময়ের পূর্বেই সভাস্থলে পৌঁছানোর চেষ্টা করতেন এবং শেষ পর্যন্ত শান্তভাবে শুনে নিজেদের বাড়ির দিকে প্রস্থান করতেন। বৈদিক ধর্মের প্রচার এবং প্রসাররূপী যজ্ঞে আহুতিস্বরূপ পণ্ডিত লেখরাম সেই দিনগুলিতে পেশাওয়ারে থাকতেন। তাঁর মনে দীর্ঘকাল ধরে স্বামীজি মহারাজের দর্শনের আকাঙ্ক্ষা ছিল। তিনি পেশাওয়ার থেকে যাত্রা করে জ্যৈষ্ঠ মাসের কৃষ্ণা চতুর্থী, সংবৎ ১৯৩৮ (১৮৮১ খ্রিস্টাব্দ) তারিখে, সকালে মহারাজের সেবায় উপস্থিত হলেন। দিব্য মূর্তির দর্শন করে চরণস্পর্শের সাথে অভিবাদন করলেন। মহারাজের আশীর্বাদের পর নিজের সন্দেহগুলির নিবারণ করলেন। অন্যান্য প্রশ্নগুলির সাথে মহারাজকে এইটিও জিজ্ঞেস করলেন যে, “অন্য ধর্মাবলম্বীদের শুদ্ধ করে নিজের সমাজে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত নাকি উচিত নয়?” মহারাজ বললেন যে বৈদিক ধর্মে বিশ্বাস রাখা অন্য ধর্মাবলম্বীদের শুদ্ধ করে অবশ্যই নিজের সমাজে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। শেষে মহারাজ পণ্ডিত লেখরামকে আদেশ দিলেন যে পঁচিশ বছর বয়সের পূর্বে বিবাহ না করতে। বিদায়ের সময় মহারাজ উপহার স্বরূপ পণ্ডিতজিকে 'অষ্টাধ্যায়ী'র একটি প্রতি (copy) প্রদান করলেন।
নিজের গুরুদেবের এই আদেশ পালনেই পণ্ডিত লেখরাম আত্মহূতি দিয়েছিলেন।
মাসুদা রাজ্যের ঠাকুর সাহেব স্বামীজি মহারাজের পরম ভক্ত ছিলেন। আষাঢ় মাসের কৃষ্ণা দ্বাদশী, সংবৎ ১৯৩৮ তারিখে, আজমীর থেকে যাত্রা করে স্বামীজি মাসুদায় পদার্পণ করলেন। ঠাকুর সাহেব রামবাগের বারাদারিতে মহারাজের বসবাসের ব্যবস্থা করলেন। এখানে বিয়াওয়ারের খ্রিস্টান পাদ্রী শূলব্রেড এবং বিহারীলালের সাথে মহারাজের ধর্মীয় আলোচনা হল। জৈন সাধু সিদ্ধকরণজির সাথেও লিখিত রূপে কিছু প্রশ্নোত্তর হল। মাসুদার দুর্গে মহারাজের বক্তৃতার ব্যবস্থা করা হল। উপদেশামৃত পান করে কিছু ভক্ত মহারাজের কাছে যজ্ঞোপবীত গ্রহণের প্রার্থনা জানালেন। বিধিমত যজ্ঞশালার নির্মাণ করে সেটিকে অলঙ্কৃত করা হল। রূপার চামচ তৈরি করানো হল। আজমীর থেকে হবন সামগ্রী আনানো হল। প্রথম দিনে বত্রিশ জন ভক্ত যজ্ঞোপবীত ধারণ করলেন। এদের মধ্যে জৈনদের সংখ্যা অধিক ছিল। কিছু দিন পর পুনরায় মহারাজের কাছে প্রার্থনা করে ষোলো জন ভক্ত যজ্ঞোপবীত গ্রহণ করলেন। এদের মধ্যেও জৈনদের সংখ্যা অধিক ছিল।
মাসুদাতে মুসলমান বাদশাহদের শাসনকালে কিছু হিন্দু মুসলমান হয়ে গিয়েছিল। এই মুসলমানদেরকে তাদের নিজেদের জাতির হিন্দুরা নিজেদের কন্যাদের বিবাহের জন্য দিয়ে দিতো। মহারাজ তাঁদের ডেকে বুঝালেন যে নিজেদের কন্যাদের বিধর্মীদের দিয়ে কেন নিজেদের জাতির নাশ করছ? নিজেদের কন্যাদের স্বয়ং ধর্মভ্রষ্ট করছ। এটি অত্যন্ত লজ্জাজনক কাজ। সেই দিন থেকে মাসুদাতে এই প্রথা বন্ধ হয়ে গেল। ভবিষ্যতের জন্য হিন্দু কন্যারা রক্ষা পেল।
মাসুদা থেকে ভাদ্র মাসের কৃষ্ণা নবমী, সংবৎ ১৯৩৮ (১৮৮১ খ্রিস্টাব্দ) তারিখে, স্বামীজি মহারাজ রামপুর আসলেন। রামপুরাধীশ রাও হরিসিংহের রাজ্য মন্ত্রী ছিলেন ইলাহীবখশ। ইলাহীবক্ষের সহযোগী ছিলেন তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র করীমবখশ। স্বামীজি মহারাজ রাও হরিসিংহকে বললেন যে আপনার যবনদেরকে রাজ্য মন্ত্রী করা উচিত নয়। এতে রাজ্য এবং ধর্মের ক্ষতি হবে। তাছাড়া এরা সকলেই দাসী পুত্র। কোরান শরীফ অনুসারে ইব্রাহিমের দুই স্ত্রী ছিল। এক বিবাহিতা 'সারা' এবং অন্যজন দাসী 'হাজিরা'। হাজিরার গর্ভ থেকে ইব্রাহিমের পুত্র সন্তান লাভ হয়েছিল। পুত্রের নাম ইসমাইল রাখা হয়েছিল।
রামপুরে থাকাকালীন স্বামীজি 'বেদাঙ্গ প্রকাশ'-এর লেখা সমাপ্ত করলেন। রামপুর থেকে বিয়াওয়ার, মাসুদা, বানেড়া হয়ে দয়ানন্দ সরস্বতী কার্তিক মাসের শুক্লা পঞ্চমী, সংবৎ ১৯৩৮ (২৬ অক্টোবর ১৮৮১ খ্রিস্টাব্দ) তারিখে, চিতোর আসলেন।
মেবারের অধিপতি মহারানা সজ্জনসিংহ এক নবযুবক ছিলেন। তাঁর ঝোঁক কিছুটা নাস্তিকতার দিকে ছিল। যদিও উদয়পুরের রাজধর্ম ছিল শৈব, কিন্তু শৈব বলে পরিচিত হলেও তাঁদের শৈবমতে বিশেষ অনুরাগ ছিল না। তাঁর নিকটে দুইজন মুসলমান মনোবিনোদনের জন্য থাকত। গণিকাদের প্রতি তাঁর বিশেষ অনুরাগ ছিল। উদয়পুরের প্রতিপত্তিশালী ব্যক্তি মোহনলাল বিষ্ণুলাল পাণ্ড্যা এবং কবিরাজ শ্যামলদাস মহারাণার এই অবস্থা দেখে দুঃখিত ছিলেন। তাঁরা মহারাণার কাছে গিয়ে কখনো কখনো রামায়ণ ইত্যাদি ধর্মগ্রন্থের পাঠ শোনানোর চেষ্টা করতেন। সংবাদপত্র থেকে দয়ানন্দ সরস্বতীর সংবাদও পড়ে শোনাতেন। মহারাণা দয়ানন্দ সরস্বতীর সংবাদগুলি আগ্রহের সাথে শুনতেন। পাণ্ড্যাজি মহারাণাকে 'সত্যাৰ্থ প্রকাশ'-এরও একটি কপিও উপহার দিলেন। 'সত্যাৰ্থ প্রকাশ'-এর কিছু অংশ পড়ে মহারাণার হৃদয়ে দয়ানন্দ সরস্বতীর প্রতি শ্রদ্ধার ভাব অঙ্কুরিত হল। তিনি স্বামীজীর দর্শনের জন্য উৎসুক হয়ে উঠলেন।
সেই সময়ের ভারত সরকারের প্রতিনিধি লর্ড রিপন মহারাণা সজ্জনসিংহকে জি. সি. এস. আই. উপাধি দিতে চাইছিলেন। মহারাণা প্রতাপের বংশধর নিজেদেরকে রাজবংশের সূর্য মনে করতেন। তাঁরা এই প্রকারের উপাধি গ্রহণ করা নিজেদের সম্মানের অনুকূল মনে করতেন না। কিন্তু লর্ড রিপন মহারাণাকে এর জন্য বাধ্য করলেন এবং এই আশ্বাস দিলেন যে তিনি স্বয়ং চিতোরে এসে সম্মানপূর্বক এই উপাধিতে তাঁকে ভূষিত করবেন। এই অবস্থায় মহারাণাকেও সম্মতি জানাতে হল। এই অনুষ্ঠানের জন্য তেইশ নভেম্বর ১৮৮১ খ্রিস্টাব্দ (সংবৎ ১৯৩৮) তারিখটি ধার্য করা হয়েছিল।
অনুষ্ঠানে যোগদান করার জন্য মেবারের সকল ঠাকুর এবং সর্দার চিতোরে এসেছিলেন। শাহপুরাধীশ মহারাজা নাহারসিংহও এই দিনগুলিতে চিতোরে ছিলেন।
এই সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করার জন্য মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী, পাণ্ড্যাজি এবং কবিরাজজির নিমন্ত্রণে চিতোরে আসলেন। গম্ভীরা নদীর তীরে রুদ্রেশ্বর মহাদেবের মন্দিরের নিকটে মহারাণার অনুমতিতে স্বামীজি মহারাজের বসবাসের জন্য তাঁবু লাগিয়ে দেওয়া হল। ভক্তরা মহারাজের উপদেশগুলি শুনতে আসতে লাগলেন। শাহপুরাধীশ মহারাজা নাহারসিংহজি স্বামীজি মহারাজের ডেরাতে এসে তাঁর অমৃতময় বাণী দ্বারা নিজেদের হৃদয়ের জ্ঞানপিপাসা শান্ত করলেন। মহারাজা নাহারসিংহ স্বামীজি মহারাজের পরম ভক্ত হয়ে গেলেন। আজীবন তাঁর পদচিহ্ন অনুসরণকারী হয়ে থাকলেন।
লর্ড রিপনের দরবার সমাপ্ত হওয়ার পর মহারাণা সজ্জনসিংহ স্বামীজি মহারাজকে নিজের দরবারে আমন্ত্রণ জানালেন। স্বামীজি মহারাজের দর্শন করে মহারাণা নতমস্তক হয়ে তাঁর বন্দনা করলেন। সম্মানের সাথে তাঁকে আসন গ্রহণ করার প্রার্থনা জানালেন। স্বামীজি মহারাজকে নিজের গুরু মনে করে ও স্বয়ং শিষ্য-ভাবনা নিয়ে তাঁর নিকটে বসে গেলেন।
দয়ানন্দ সরস্বতী মহারাণাকে রাজনীতির বিষয়ে উপদেশ দিলেন। সদাচারের নিয়মগুলির প্রতিপাদন করতে করতে মদ্যপান এবং গণিকাদের সাথে থাকার দোষ দেখালেন। স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতীর কোনো রকম আড়াল-আবডাল ছাড়া নির্ভীক প্রবচন শুনে মহারাণা অত্যন্ত প্রভাবিত হলেন। এখন পর্যন্ত তিনি এমন স্পষ্ট বক্তা ও উপদেষ্টা দেখেননি।
চার ডিসেম্বর ১৮৮১ খ্রিস্টাব্দ তারিখে মহারাণা সজ্জনসিংহ স্বয়ং স্বামীজির বাসস্থানে আসলেন। পরম শ্রদ্ধার সাথে মহারাজের কাছে বসে ধর্ম এবং রাজনীতির বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করতে থাকলেন।
এক দিন দয়ানন্দ সরস্বতী কিছু রাজা এবং জায়গীরদারদের সাথে ভ্রমণের জন্য যাচ্ছিলেন। পথে একটি মন্দিরের কাছে কিছু বালক-বালিকা খেলছিল। এদের মধ্যে চার বছরের একটি বালিকাও ছিল। স্বামীজির মস্তক ঝুঁকে গেল। তাঁর সঙ্গে যাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে একজন বললেন যে, মহারাজ আপনি মূর্তিপূজার খণ্ডন করেন, কিন্তু মন্দিরের সামনে আপনার মস্তকও তো ঝুঁকে গেল। এটি দেব-মূর্তিগুলির প্রভাব।
স্বামীজি সেখানেই দাঁড়িয়ে গেলেন এবং সেই কন্যাটির দিকে ইঙ্গিত করে বললেন, "দেখুন, এই মাতৃশক্তিকে, যেই মাতৃশক্তি আমাদের সকলকে জন্ম দিয়েছেন। আমি এনার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করছি, পাথরের মূর্তির প্রতি নয়।"
স্বামীজি মহারাজকে বম্বাই যেতে হতো। সেখানে আর্যসমাজের বাৎসরিক উৎসব ছিল। অন্য কোনো উপলক্ষে উদয়পুর আসার জন্য মহারাণাকে প্রতিশ্রুতি দিয়ে স্বামীজি মহারাজ ইন্দৌর হয়ে পৌষ মাসের শুক্লা একাদশী, সংবৎ ১৯৩৮ (১৮৮১ খ্রিস্টাব্দ) তারিখে, বম্বাই পৌঁছালেন। কর্নেল অলকট এবং বম্বাই আর্যসমাজের সদস্যরা রেলওয়ে স্টেশনে মহারাজের অভ্যর্থনার জন্য উপস্থিত ছিলেন। বালুকেশ্বরে গোশালার স্থানে মহারাজ আসন গ্রহণ করলেন। কর্নেল অলকটও বালুকেশ্বরে অবস্থান করছিলেন।
বম্বাইয়ের এই যাত্রায় স্বামীজি মহারাজ এখানে বক্তৃতা, আলাপ-আলোচনা এবং বিদ্বানদের সাথে শাস্ত্র-আলোচনার মাধ্যমে বৈদিক ধর্মের আদর্শকে সাধারণ মানুষের সামনে তুলে ধরলেন। বম্বাই আর্যসমাজ প্রতিষ্ঠার সময় আর্যসমাজের ২৮টি নিয়ম স্থির করা হয়েছিল। লাহোরে এই নিয়মগুলিতে পরিবর্তন করে দশটি নিয়ম গ্রহণ করা হয়েছিল। বম্বাই আর্যসমাজেও এই দশটি নিয়মকে স্বীকৃতি প্রদান করা হল। থিয়োসফিক্যাল সোসাইটির সাথে আর্যসমাজের সম্পর্ক চিরতরে ছিন্ন করার ঘোষণা করা হল। ফলস্বরূপ কর্নেল অলকট এবং ম্যাডাম ব্লেভাটস্কির বম্বাইয়ে প্রভাব শিথিল হয়ে পড়ল। তাঁরা এখান থেকে মাদ্রাজ চলে গেলেন।
ভারতে গো-হত্যা দেখে মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতীর মন অত্যন্ত চিন্তিত ছিল। তিনি গো-বংশকে দেশের প্রাণ মনে করতেন। গো-বংশ যেখানে অমৃতময় দুগ্ধ দ্বারা আমাদের সকলকে পরিতৃপ্ত করে, সেখানে কৃষি প্রভৃতি কার্যও এদের ছাড়া সম্ভব নয়। গো-হত্যা রোধের প্রতি ঋষির দৃষ্টিকোণ কেবল নৈতিকতার ছিল না, বরং এই কৃষিপ্রধান দেশে এর অর্থনৈতিক উপযোগিতার প্রতিও ছিল। এই প্রকার গো-বংশ দেশের অন্নদাতা-ও বটে।
স্বামীজি মহারাজ গো-রক্ষার বিষয়ে সকল ধর্মাবলম্বীদের সাথে আলোচনা করে লর্ড রিপনের মাধ্যমে রানী ভিক্টোরিয়ার কাছে পাঠানোর জন্য একটি নিবেদন পত্র (স্মারকলিপি) প্রস্তুত করলেন। তিনি চেয়েছিলেন যে এই নিবেদন পত্রে কোটি কোটি সংখ্যায় সকল মতের ভারতীয়দের স্বাক্ষর করিয়ে মহারানীর কাছে পেশ করা হোক। এই উদ্দেশ্যেই ভারতের বিভিন্ন অংশে স্বাক্ষর করানোর জন্য এই নিবেদন পত্র পাঠানো হয়েছিল। দুর্ভাগ্যবশত সংবৎ ১৯৪০-এর দীপাবলির সময় স্বামীজি মহারাজের দেহান্ত হয়ে গেল। এর ফলে নিবেদন পত্রের উদ্দেশ্য পূর্ণ হতে পারল না।
বম্বাইয়ে মহারাজ দিনের অধিকাংশ সময় বেদ-ভাষ্য লেখানোর কাজে অতিবাহিত করতেন। বম্বাই থেকে দয়ানন্দ সরস্বতী খাণ্ডোয়া, ইন্দৌর, রতলাম, জাবরা ইত্যাদি নগরগুলিতে ভক্তদের উপদেশামৃত পান করাতে করাতে শ্রাবণ মাসের শুক্লা নবমী, সংবৎ ১৯৩৯ (২৫ জুলাই ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দ) তারিখে, পুনরায় চিতোরে পৌঁছালেন। দুই সপ্তাহ এখানেই নিবাস করলেন। চিতোরের প্রাকৃতিক দৃশ্য এবং প্রাচীন বীরত্বময় ইতিহাসে প্রভাবিত হয়ে স্বামীজি চেয়েছিলেন যে এখানে বেদাদি শাস্ত্রের স্বাধ্যায়ের জন্য একটি গুরুকুলের প্রতিষ্ঠা করা হোক। স্বামীজি মহারাজের অনন্য ভক্ত ব্রহ্মচারী যুধিষ্ঠির (স্বামী ব্রহ্মানন্দ জি) তাঁর এই ইচ্ছাকে কার্যত রূপ প্রদান করলেন।
চিতোর থেকে প্রস্থান করে শ্রাবণ মাসের কৃষ্ণা দ্বাদশী, সংবৎ ১৯৩৯ (১১ আগস্ট ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দ) তারিখে, স্বামীজি মহারাজ উদয়পুর পৌঁছালেন। উদয়পুরে মহারাণা সজ্জনসিংহের পক্ষ থেকে নওলখা বাগ (সজ্জন-বিলাস)-এ মহারাজের থাকার ব্যবস্থা করা হল।
মহারাজের আগমনের দ্বিতীয় দিনে মহারাণা সজ্জনসিংহ কিছু প্রতিষ্ঠিত রাজকর্মচারীর সাথে তাঁর সাথে দেখা করতে এলেন। পরে প্রতিদিন, একদিন সকালে, অন্যদিন সন্ধ্যায় মহারাণা স্বামীজি মহারাজের নিবাস স্থানে তাঁর সাথে দেখা করতে আসতেন। স্বামীজি মহারাজ উপাসনা থেকে নিবৃত্ত হওয়ার পর মহারাণা তাঁর সাথে বাগানে হাঁটতে হাঁটতে বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করতেন।
একদিন মহারানা সজ্জনসিংহ সংস্কৃত পড়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। মহারাজ সহর্ষে স্বীকার করে তাঁকে সরল পদ্ধতিতে সংস্কৃতের জ্ঞান দিতে দিতে মনুস্মৃতির ৭, ৮, ৯ অধ্যায় পড়ালেন। মহাভারতের উদ্যোগ পর্ব এবং বন পর্ব থেকে কিছু চরিত্র গঠন এবং রাজনীতি বিষয়ক প্রসঙ্গ শোনালেন। বিদুর নীতির মর্মও বোঝালেন। মহারাণার দিনচর্যাকে নিয়ন্ত্রিত করলেন। রাজভবনে প্রতিদিন নিয়মানুসারে অগ্নিহোত্র করার আদেশ দিলেন। একবার রাজ্যে বৃহৎ যজ্ঞ করালেন, যাতে মহারাণার দ্বারা পূর্ণাহুতি দেওয়ালেন। মহারাণাকে বেশ্যাবৃত্তি এবং অন্যান্য অনাচার থেকে দূরে থাকার কঠোর আদেশ দিলেন, যা মহারাণা যথাযথভাবে পালন করলেন এবং নিজের জীবনে অনেক উন্নতি সাধন করলেন। স্বামীজি এটাই চাইছিলেন যে রাজাদের চরিত্র শুধরে যাক, যাতে তাঁদের দেখে প্রজারাও যোগ্য হতে পারে।
হিন্দুদের মধ্যে ঐক্যের দৃষ্টিকোণ থেকে মহারাণা স্বামীজিকে মূর্তিপূজার খণ্ডন ছেড়ে একলিঙ্গ মন্দিরের আধিপত্য গ্রহণ করার জন্য অনুরোধ করলেন, যার সেই সময় লক্ষ টাকা আয় ছিল।
মহারাণার এই প্রস্তাবের উত্তরে স্বামীজি গম্ভীর হয়ে বললেন— "মহারাণা!! আপনি আমাকে প্রলোভন দিয়ে সেই সর্বশক্তিমান্ জগন্নিয়ন্তা প্রভুর আজ্ঞা ভঙ্গ করাতে চাইছেন? এই ছোট রাজ্য ও এই মন্দিরের সম্পত্তি আমাকে সেই সর্বনিয়ন্তার আজ্ঞা লঙ্ঘন করার দিকে প্রবৃত্ত করতে পারে না। আমি এক দৌড়ে আপনার রাজ্য থেকে বাইরে চলে যেতে পারি, কিন্তু বিশ্বব্যাপী পরমেশ্বরের ছত্রছায়া থেকে দূরে থাকতে পারি না। বেদের আজ্ঞা তাঁরই আজ্ঞা। আমি তা পরিত্যাগ করতে পারি না। কোনো শক্তি আমাকে সত্য পথ থেকে বিচলিত এবং মিথ্যার দিকে ঝুঁকাতে পারে না। মিথ্যার খণ্ডন এবং সত্যের প্রকাশ করা আমার কর্তব্য। ভবিষ্যতে আপনি আমাকে ঈশ্বর আজ্ঞা ভঙ্গ করার কথা কখনও বলবেন না।"
দয়ানন্দ সরস্বতীর নির্ভয় ধ্বনি শুনে মহারাণা স্তম্ভিত হয়ে রইলেন। এখনও পর্যন্ত তিনি নিজের 'হ্যাঁ'-তে 'হ্যাঁ' মেলানো প্রশংসাবাদী পণ্ডিতই দেখেছিলেন। স্বামীজি মহারাজের এই উত্তর শুনে ক্ষমা প্রার্থনা করতে করতে মহারাণা বললেন, "মহারাজ! আমি এই দেখতে চেয়েছিলাম যে আপনি আপনার সিদ্ধান্তগুলির ওপর কতটা দৃঢ়! আমার পরম সন্তোষ হচ্ছে যে আপনি কোনো প্রলোভন অথবা ভয়ের কারণে সত্য থেকে বিচলিত হতে পারেন না। আমার অপরাধ ক্ষমা করুন।"
একদিন মোহনলাল পাণ্ড্যা স্বামীজি মহারাজকে প্রশ্ন করলেন যে, আর্যাবর্ত দেশের সম্পূর্ণ হিত এবং জাতীয় উন্নতি কখন হবে?
স্বামীজি মহারাজ বললেন- "প্রিয় মোহনলাল, এই দেশের উত্থান তখনই সম্ভব যখন আমাদের এক ধর্ম, এক ভাষা এবং এক লক্ষ্য হবে। যদি সকল নরেশ (রাজা) নিজেদের রাজ্যে ধর্ম, ভাষা এবং ভাবের ঐক্য স্থাপন করার চেষ্টা করেন, তবে এই দেশের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হতে পারে, এটাই এর উন্নতির একটি পথ।"
মোহনলাল স্বামীজি মহারাজের উক্তিতে আশঙ্কা প্রকাশ করে বললেন- "মহারাজ! যে রূপে আপনি ভাবগুলির মধ্যে ঐক্য চাইছেন, সেই দৃষ্টিকোণ থেকে আবার মত-মতান্তরগুলির খণ্ডন কেন করেন? এর দ্বারা পরস্পরের মধ্যে ভেদ-ভাবনা উৎসাহিত হয়।"
স্বামীজি বললেন- "দেখুন! যখন ধর্মাচার্য এবং দেশের নেতাদের অসাবধানতা, অবিবেক এবং প্রমাদ (অলসতা) দ্বারা জাতির আচার-বিচার এবং আদর্শ দূষিত হয়ে যায়, তখন তাদের মধ্যে ভাবের ঐক্য থাকতে পারে না। আর্য জাতি এই সময় পতনের দিকে যাচ্ছে। আমাদের ধর্মাচার্যদের অবিবেকপূর্ণ এবং সংকীর্ণ দৃষ্টিকোণের কারণে কোটি কোটি সংখ্যায় আর্য সন্তান আজ মুসলমান এবং খ্রিস্টান হচ্ছে। যদি এদের সামলানো না হয়, তবে এর শীঘ্রই সমাপ্তি হয়ে যাবে। নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য জাতিকে বিনাশের দিকে নিয়ে যাওয়া এই ধর্মাচার্যদের দৃষ্টিকোণ তখনই পরিবর্তিত হতে পারে যখন সত্যের তীক্ষ্ণ ধারা দ্বারা মিথ্যা, পাপাচারণ, অনৈতিক প্রথা এবং কুপ্রথাগুলির সমূল উচ্ছেদ করা যায়। এর জন্য কঠোর এবং তিক্ততাপূর্ণ উপায়ের আশ্রয় নেওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই। আমি কোনো স্বার্থবশত এই কাজ করছি না। এই কাজে আমি অনেক কষ্ট সহ্য করছি। স্বার্থপর পুরুষেরা আমাকে গালি দেয়। ইট-পাথর মারে। সকল প্রকারে আমার প্রাণ-হরণের চেষ্টা করে। তরোয়ালের ভয় দেখায়। চুরি করে খাবার জিনিসে বিষ দেয়। প্রলোভনও দেয়। আর্য জাতির রক্ষা এবং বৈদিক ধর্মের পুনরুত্থানের জন্য আমি এই সব সহ্য করি এবং করব, কারণ বৈদিক ধর্মের পুনরুত্থান ছাড়া রাষ্ট্রের উত্থান সম্ভবই নয়।"
দয়ানন্দ সরস্বতীর কথা শুনে ভক্ত মোহনলাল পাণ্ড্যা ভাববিহ্বল হয়ে বললেন- "প্রভু! যদি আপনার মতো দুই-তিনজন ধর্মাচার্য এই দেশে অবতীর্ণ হতেন, তবে বাস্তবে আর্য জাতির এই ডুবন্ত নৌকাটি শীঘ্রই নিরাপদে পার হয়ে যেতো"
একদিন কবিরাজ শ্যামলদাস মহারাজকে নিবেদন করলেন যে, মহারাজ! ভক্তরা আপনার স্মরণ-চিহ্ন নির্মাণ করতে চাইছেন।
মহারাজ তাঁকে সাবধান করে বললেন "এমনটা কখনও করবেন না। আমার ভৌতিক দেহের ত্যাগের পরে এর ভস্মকে কোনো জমিতে ফেলে দেবেন। স্মারক বানালে ভবিষ্যতে তার দ্বারা মূর্তিপূজাকে উৎসাহ দেওয়া হয়।"
দয়ানন্দ সরস্বতী দূরদর্শী ছিলেন, ঋষি ছিলেন, কোনো এই প্রকারের প্রথা স্থাপন করতে চাইতেন না যা থেকে আগামী ভক্তদের মধ্যে মিথ্যাচারের প্রচার হয়।
উদয়পুরে থাকাকালীন দয়ানন্দ সরস্বতী অধিকাংশ সময় বেদ-ভাষ্যের রচনায় অতিবাহিত করতেন।
পরোপকারিণী সভার গঠন
এই সংসারে কোনো মানুষ চিরকাল বেঁচে থাকে না। যিনি জন্ম নিয়েছেন, তাঁকে এই জীবনের অন্তও দেখতে হবে। মহর্ষিদয়ানন্দ সরস্বতীর জীবন সর্বদা সংকটপূর্ণ ছিল। খ্রিস্টান, মুসলমান, পৌরাণিকপন্থী এবং চক্রাঙ্কিত সম্প্রদায়, সকলেই তাঁর এই দেহের বিনাশ সাধনে উদ্যোগী ছিল। বহুবার তাঁকে বিষ দেওয়া হয়েছে। তাঁর ওপর প্রাণঘাতী আক্রমণের চেষ্টা করা হয়েছে। এই কারণে দয়ানন্দ সরস্বতী মহারাজ যখন জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দে (সংবৎ ১৯৩৮) মীরাটে ছিলেন, তখন তিনি পরোকারিণী সভা প্রতিষ্ঠার সংকল্প করেছিলেন।
এই পরিস্থিতিতে তিনি চাইছিলেন যে এই দেহ থেকে মুক্তি পাওয়ার পরেও তাঁর কাজ যথাযথভাবে চালু থাকুক। বৈদিক গ্রন্থসমূহের নির্মাণ এবং প্রকাশের কর্মসূচি সর্বদা জারি থাকুক। ভারতের বাইরে বিদেশগুলিতেও বৈদিক ধর্মের প্রচারের বিস্তার করা হোক। অনাথ এবং দীন-দরিদ্রদের শিক্ষা এবং পালনের দিকে বিশেষ মনোযোগ দেওয়া হোক। ধর্ম এবং পরোপকারের কাজ উৎসাহ, পুরুষার্থ, গাম্ভীর্য এবং উদারতার সাথে সর্বদা হতে থাকুক। আর্যদের নির্মাণকার্য সর্বদা হতে থাকুক, যা তিনি স্বয়ং জীবনভর করে গেছেন।
নিজের অবশিষ্ট জীবনকালে এবং এই দেহ ত্যাগের পরে এই উদ্দেশ্যগুলির পূর্তির জন্য দয়ানন্দ সরস্বতী একটি স্বীকার পত্র (উইল) তৈরি করলেন। তেইশ জন সজ্জন ব্যক্তিকে সাক্ষী করে একটি "পরোপকারিণী সভা" গঠন করে সেটিকে নিজের সম্পত্তির অধিকারী করে দিলেন।
এই তেইশ জন ব্যক্তির মধ্যে উদয়পুরের মহারাণা সজ্জনসিংহকে এই সভার প্রধান নিযুক্ত করলেন। অন্যান্য সদস্যদের মধ্যে ছিলেন শাহপুরাধীশ মহারাজা নাহারসিংহ, প্রসিদ্ধ সমাজ-সংস্কারক রাও বাহাদুর গোবিন্দ রানাডে পুনা, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির সংস্কৃতের অধ্যাপক শ্যামজি কৃষ্ণ বর্মা, বম্বাই কাউন্সিলের সদস্য রাও বাহাদুর পণ্ডিত গোপালরাও দেশমুখ, স্বামীজির ভক্ত রাজা জয় কিশনদাস মোরাদাবাদ, লালা সাইঁদাস লাহোর ইত্যাদি।
স্বীকারপত্রের নিয়মাবলিতে প্রথম নিয়ম, যাতে এর উদ্দেশ্যগুলি স্পষ্ট করা হয়েছে, তা নিম্নরূপ:–
“ উক্ত সভা, যেমন আমার জীবিতাবস্থায় আমার সমস্ত পদার্থের (সম্পত্তি) রক্ষা করে নিম্নলিখিত পরোপকারের কাজগুলিতে লাগানোর অধিকার রাখে, তেমনই আমার পরেও অর্থাৎ মৃত্যুর পরে লাগাবে।”
১. বেদ এবং বেদাঙ্গাদি শাস্ত্রের প্রচার, অর্থাৎ সেগুলির ব্যাখ্যা করা-করানো, পড়া-পড়ানো, শোনা-শোনানো, ছাপা-ছাপানো ইত্যাদি ক্ষেত্রে।
২. বেদের নির্দেশিত ধর্মের উপদেশ এবং শিক্ষা, অর্থাৎ উপদেশ মণ্ডলী নির্দিষ্ট করে দেশ-দেশান্তর এবং দ্বীপ-দ্বীপান্তরে পাঠিয়ে সত্যের গ্রহণ এবং অসত্যের ত্যাগ ইত্যাদি বিষয়ে।
৩. আর্যাবর্তের অনাথ এবং দীন-দরিদ্রদের শিক্ষা এবং পালনে খরচ করবে এবং
এই উদ্দেশ্যগুলির স্পষ্টীকরণ করতে গিয়ে কার্য পরিচালনার জন্য তেরোটি অন্যান্য নিয়ম তৈরি করা হল।
ফাল্গুন মাসের কৃষ্ণা সপ্তমী, সংবৎ ১৯৩৯ বিক্রমী (১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দ) পর্যন্ত স্বামীজি মহারাজ উদয়পুরে থাকলেন। বিদায়ের সময় মহারানা স্বামীজি মহারাজকে একটি কৃতজ্ঞতাসূচক সম্মানপত্র প্রদান করলেন। তার সাথে আশা প্রকাশ করলেন যে তিনি পুনরায় নিজের দর্শনের দ্বারা তাঁদের কৃতার্থ করতে থাকবেন।
উদয়পুর থেকে প্রস্থান করে চিতোর হয়ে দয়ানন্দ সরস্বতী ফাল্গুনের অমাবস্যার দিনে শাহপুরা পৌঁছালেন। লর্ড রিপনের দরবারের সময় চিতোরে শাহপুরাধীশ মহারাজা নাহার সিংহ দয়ানন্দ সরস্বতীর সৎসঙ্গ থেকে লাভবান হয়েছিলেন। তাঁর সত্যোপদেশে প্রভাবিত হয়ে শাহপুরাধীশ স্বামীজি মহারাজকে প্রার্থনা করেছিলেন– "ভগবান্, আপনি কৃপা করে আমাদের রাজ্যেও পদার্পণ করে প্রজাবর্গকে নিজের উপদেশামৃত দ্বারা তৃপ্ত করুন।" স্বামীজি মহারাজ শাহপুরাধীশের বিনীত প্রার্থনা স্বীকার করে নিকট ভবিষ্যতে সুযোগ পেলে আসার আশা প্রকাশ করেছিলেন।
শাহপুরায় রাজকীয় উদ্যানে তাঁবু ফেলে স্বামীজি মহারাজের নিবাসের ব্যবস্থা করা হল। সন্ধ্যার সময় শাহপুরাধীশ মহারাজা নাহারসিংহ রাজ্যের সম্মানিত ব্যক্তিদের সাথে মহারাজের কুশল-মঙ্গল জিজ্ঞেস করার জন্য তাঁর সেবায় এলেন।
এখানে থাকাকালীন মহারাজের অধিক সময় বেদ-ভাষ্যের রচনায় অতিবাহিত হত। কিছু সময় শ্রদ্ধালু ভক্তদের উপদেশ দিতেন এবং তাঁদের সন্দেহগুলির নিবারণ করতেন।
সন্ধ্যার ছয়টা থেকে ন'টা পর্যন্ত শাহপুরাধীশ স্বামীজি মহারাজের চরণতলে বসে তাঁর কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতেন। এক ঘণ্টা ধর্ম আলোচনা এবং ধর্ম সংক্রান্ত সংশয়গুলির নিবারণ হত। দুই ঘণ্টা শাস্ত্রের অধ্যয়নের জন্য নির্দিষ্ট ছিল। এই সময়ে মহারাজ শাহপুরাধীশকে মনুস্মৃতি, পাতঞ্জল যোগদর্শন এবং বৈশেষিক দর্শনের কিছু অংশের অধ্যয়ন করালেন। প্রাণায়াম পদ্ধতিরও উপদেশ দিলেন।
স্বামীজি মহারাজের উপদেশে প্রভাবিত হয়ে মহারাজ রাজভবনে যজ্ঞশালা নির্মাণ করালেন, এখানে নিত্য হবন হতে শুরু হল।
- যোধপুরে প্রচার কার্য
যোধপুরে কর্নেল স্যার প্রতাপসিংহ এবং রাওরাজা তেজসিংহ মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতীর পরম ভক্ত ছিলেন। দয়ানন্দ সরস্বতীর উদয়পুর নিবাসের দিনগুলিতে তাঁরা স্বামীজি মহারাজকে যোধপুরে পদার্পণ করার জন্য বিনয়পূর্বক প্রার্থনা করেছিলেন। তাঁরা যোধপুরের অধিপতি মহারাজা যশবন্তসিংহকে নিবেদন করে স্বামীজি মহারাজকে যোধপুর আসার জন্য নিমন্ত্রণ পাঠিয়েছিলেন। দয়ানন্দ সরস্বতী রাজস্থানের রাজাদের মধ্যে প্রাচীন বৈদিক আদর্শ পুনরায় স্থাপন করতে চাইছিলেন। যোধপুর নরেশের নিমন্ত্রণ পেয়ে তিনি যোধপুর যাওয়ার সংকল্প করলেন। জ্যৈষ্ঠ মাসের কৃষ্ণা চতুর্থী, সংবৎ ১৯৪০ বিক্রমী দিনটিও যাত্রার জন্য নির্দিষ্ট হয়ে গেল।
শাহপুরাধীশ মহারাজা নাহারসিংহ যখন এই সংবাদ পেলেন, তখন তিনি স্বামীজি মহারাজের কাছে এলেন। চিন্তিত চিত্তে বিনয়পূর্বক মহারাজের কাছে প্রার্থনা করলেন–"মহারাজ! আপনি সেখানে গণিকাদের বিষয়ে সমালোচনা করবেন না, কারণ যোধপুরের অধিপতির ননহী জান নামক গণিকার সাথে স্নেহ-সম্পর্ক ছিল। শাহপুরাধীশ জানতেন যে স্বামীজি মহারাজ অত্যন্ত নির্ভীক, সত্যবক্তা। তিনি এই ভেবে চিন্তিত ছিলেন যে পাছে তার এই নির্ভীক সত্য বক্তব্যের কারণে তাঁর কোনো ক্ষতি না হয়, স্বার্থপরেরা কোনো স্বার্থের বশে স্বামীজির ক্ষতি করতে পারে।
স্বামীজি মহারাজ নিজের স্বভাব অনুসারে সাহসপূর্ণ উত্তর দিলেন– "আমি কাঁটাযুক্ত গাছগুলিকে নখ দিয়ে কাটব না। তার জন্য অত্যন্ত তীক্ষ্ণ অস্ত্রের প্রয়োজন হবে।"
শাহপুরা থেকে যোধপুরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করার সময় স্বামীজি আজমীর আসলেন। এখানে শেঠ ফতেহমল-এর কোঠিতে বিশ্রাম করলেন। স্বামীজি মহারাজের ভক্ত রাওবাহাদুর গোপালরাও হরি দেশমুখের সুপুত্র লক্ষণরাও (খান্দেশের অ্যাসিস্ট্যান্ট কালেক্টর) আজমীরে স্বামীজি মহারাজের কাছে যোগাভ্যাসের রহস্য বোঝার জন্য এসেছিলেন। মহারাজ তাঁকে একান্তে যোগবিষয়ক শিক্ষা দিলেন।
আজমীর থেকে যোধপুরের দিকে যাত্রা করার পূর্বে ভক্তমণ্ডলী মহারাজকে মারওয়াড় না যাওয়ার জন্য অনুরোধ করলেন।
মহারাজ উত্তর দিলেন– "যদি তারা আমাদের আঙুলগুলিকে মোমবাতি বানিয়ে জ্বালিয়েও দেয়, তাতেও কোনো চিন্তা নেই। আমি সেখানে গিয়ে সত্যোপদেশই দেব।"
আজমীর থেকে পালি স্টেশন পর্যন্ত মহারাজ রেলে আসলেন। সেই দিনগুলিতে পালি থেকে যোধপুর পর্যন্ত রেললাইন ছিল না। পালিতে যোধপুরের অধিপতির পক্ষ থেকে একটি হাতি, তিনটি রথ, একটি সেজ গাড়ি, তিনটি উট, উটের সাথে চারজন সওয়ার তৈরি ছিল। পথে বৃষ্টির কারণে একদিন রোপট-এ বিশ্রাম করে দ্বিতীয় দিনে যোধপুরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। যখন যোধপুর দুই ক্রোশ দূরে ছিল, মহারাজ বাহন থেকে নেমে হেঁটে চলতে শুরু করলেন।
যোধপুরে নজর বাগ-এর সামনে ফয়জুল্লা খাঁ-র কোঠিতে মহারাজের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। রাওরাজা জওয়ানসিংহ রাজ্যের পক্ষ থেকে স্বামীজির অভ্যর্থনার জন্য কোঠি থেকে কিছুটা এগিয়ে পথে চলে গেলেন। কর্নেল প্রতাপসিংহ এবং রাওরাজা তেজসিংহ মহারাজের অভ্যর্থনার জন্য কোঠিতে অপেক্ষা করছিলেন।
সামনে থেকে গৈরিক বসন পরিহিত, হাতে দণ্ডধারী, দীর্ঘকায়, সন্ন্যাসী আসছিলেন। উন্নত মস্তক, গৌরবর্ণ, তেজস্বী মুখমণ্ডল ছিল। প্রভাতকালীন সূর্যের জ্যোতিতে তাঁর ছবি ছিল অবর্ণনীয়। মাংসপেশী সুসংগঠিত ছিল। প্রসারিত বক্ষে তিনি হাঁটছিলেন। গতিতে উৎসাহ ছিল। ঠোঁটে মৃদু হাস্য ছিল। ঈশ্বর বিশ্বাস এবং সত্যের উপাসনার আভা ছিল। শান্তি এবং সন্তোষের অনুভূতি ছিল। কর্নেল এবং রাওরাজা এই অদ্ভুত মানবমূর্তি দেখে স্তম্ভিত হয়ে রইলেন।
শ্রদ্ধাভরা অনুভূতি নিয়ে ভক্তমণ্ডলী মহারাজকে অভিবাদন জানালেন। মহারাজও "নমস্তে" (নমস্কার) শব্দ দ্বারা তাঁদের অভিবাদন করলেন।
স্বামীজি মহারাজের নিবাস এবং ভোজন ইত্যাদির সুব্যবস্থা করে দেওয়া হল। যোধপুরের নরেশ মহারাজা যশবন্তসিংহ কিছুটা অসুস্থ ছিলেন। তাঁর গলায় ব্যথা ছিল, অতএব তিনি কিছু দিন মহারাজের সেবায় আসতে পারেননি। স্বাস্থ্য লাভ হওয়ার পরেই মহারাজা যশবন্তসিংহ নিজের শিষ্ট-মণ্ডলীর (সভাসদদের) সাথে স্বামীজি মহারাজের নিবাস স্থানে দর্শনের জন্য আসলেন। চরণে প্রণাম করে আসন গ্রহণ করলেন। কুশল-মঙ্গলের প্রশ্নোত্তর হওয়ার পরে মহারাজা অমৃতোপদেশ শোনার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। স্বামীজি মনুস্মৃতি অনুসারে রাজধর্মের উপদেশ দিলেন। স্বদেশ প্রেম, প্রজাপালন, ন্যায় ব্যবস্থা ইত্যাদির সম্পর্কে উপযুক্ত পরামর্শ দিলেন। দেশদ্রোহ এবং পারস্পরিক ফুট (বিভেদ)-এর দোষগুলির ওপর আলোকপাত করলেন। তিন ঘণ্টা পর্যন্ত মহারাজাকে রাজনীতির তত্ত্বগুলি বোঝাতে থাকলেন।
দ্বিতীয় দিন থেকে ফয়জুল্লা খাঁ-র মালিকানাধীন কোঠিতে স্বামীজির বক্তৃতার ব্যবস্থা হয়ে গেল। প্রতিদিন সন্ধ্যার সময় মহারাজ নিজের নিবাস স্থানে ভক্তদের উপদেশ দিতেন এবং তাঁদের সংশয়গুলির নিবারণ করতেন। দিনের সময় নিত্য কর্মগুলি থেকে নিবৃত্ত হয়ে বেদ-ভাষ্য লেখাতেন এবং 'সত্যাৰ্থ প্রকাশ' ও 'সংস্কার বিধি'-র প্রুফগুলির সংশোধন করতেন। যোধপুর নিবাসী জনগণের জন্য স্বামীজির বক্তৃতাগুলিতে নতুনত্ব ছিল। তিনি এক নিরাকার ঈশ্বরের উপাসনা, সদাচার এবং গো-রক্ষার ওপর বিশেষ জোর দিতেন। বাল্যবিবাহ, মৃতক শ্রাদ্ধ ইত্যাদির খণ্ডন থেকে এখানকার পূজারী এবং পুরোহিতেরা মহারাজের বিরুদ্ধে হয়ে গেলেন। এর ফলে তাদের জীবিকার ওপর প্রভাব পড়ত। চক্রাঙ্কিত সম্প্রদায়-এরও যোধপুরে খুব প্রচার ছিল। একদিন স্বামীজি নিজের বক্তৃতায় এই সম্প্রদায়েরও কড়া সমালোচনা করলেন। এই প্রকার চক্রাঙ্কিত সম্প্রদায়কে মান্যকারী সম্প্রদায়ও মহারাজের ওপর ক্রুদ্ধ হয়ে গেল, অর্থাৎ জনসাধারণের উন্নতির জন্য স্বামীজি অনেক শত্রুদের বরণ করতে প্রস্তুত ছিলেন।
ফয়জুল্লা খাঁ যোধপুরের রাজকর্মচারীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন। যোধপুর নরেশ তাকে খুব মান্যতা দিতেন। এই কারণে প্রজাদের মধ্যে তার প্রভাব ছিল। একদিন মহারাজ নিজের বক্তৃতায় খ্রিস্টান ধর্মের সমালোচনা করছিলেন, বক্তৃতার মাঝখানে ফয়জুল্লা খাঁ-র ভ্রাতুষ্পুত্র মহম্মদ হুসেন তরোয়ালের বাঁটের ওপর হাত রেখে দাঁড়িয়ে এবং বললো " খবরদার! আপনি ইসলামের বিষয়ে কিছু বলবেন না।" স্বামীজি মহারাজ নির্ভীক সুরে বললেন– "তুমি এখনও অনভিজ্ঞ শিশু। তুমি কেবল তরোয়ালের বাঁটে হাত রাখতেই পারবে। তা খাপ থেকে বের করতে পারবে না। আমি এইরকম শেয়ালসুলভ চিৎকারে ভয় পাওয়ার মানুষ নই।"
এরপরে তিনি ইসলামি মতের যুক্তিবিরোধী কথাগুলিকে খুব ভালোভাবে তুলে ধরলেন। এভাবে কট্টর মুসলমানেরাও স্বামীজি মহারাজের শত্রু হয়ে গেলো।
স্বামীজি গণিকাবৃত্তির ঘোর বিরোধী ছিলেন। যোধপুর নরেশ এবং সেখানকার রইসরা এই রোগের অসাধ্য কঠিন রোগী ছিলেন। ক্ষত্রিয়ের আচার এবং কর্তব্যের ওপর উপদেশ দিতে গিয়ে স্বামীজি মহারাজ গণিকাবৃত্তির কঠোর শব্দে বিরোধিতা করতেন। সকলের জন্য এটিকে একটি নিন্দনীয় কর্ম মনে করতেন।
যোধপুরে এই দিনগুলিতে চার প্রকারের জনশক্তি ছিল। পুরাণপন্থী হিন্দু, চক্রাঙ্কিত, মুসলমান এবং জায়গীরদার। সকলে নিজেদের স্বার্থ এবং কুপ্রথাগুলির তীব্র খণ্ডন দেখতে পেয়ে মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতীর বিরোধী হয়ে যায়।
উদয়পুর এবং শাহপুরায় থাকার সময় দয়ানন্দ সরস্বতী সেখানেকার নরেশদের সক্রিয় সহযোগিতা পেয়েছিলেন। সেখানকার নরেশেরা মহারাজের উপদেশগুলি শ্রদ্ধা সহকারে শুনলেন। সেই অনুসারে আচরণ করলেন। মদ্যপান এবং গণিকাদের সঙ্গ ইত্যাদি দুর্গুণ পরিত্যাগ করলেন, প্রাচীন রাজনীতি এবং ধর্ম সংক্রান্ত গ্রন্থগুলির স্বাধ্যায় (অধ্যয়ন) শুরু করলেন। এই প্রকার তাঁদের জীবনে উন্নতি হল। প্রজার উন্নতি এবং ন্যায় ব্যবস্থার দিকেও তাঁদের মনোযোগ অধিক আকৃষ্ট হল। তারা আর্য রাজা হয়ে উঠতে লাগলেন ।
এদিকে যোধপুরের পরিস্থিতি এর থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ছিল। যোধপুর নরেশ মহারাজা যশবন্তসিংহ ননহী জান নামক গণিকার প্রতি অতিশয় মাত্রায় আসক্ত ছিলেন। তাঁর ওপর স্বামীজির উপদেশগুলির তেমন প্রভাব পড়ল না। বস্তুতঃ তিনি স্বামীজির উপদেশে শুনলেও অধর্মে নিজের দুঃসাধ্য আসক্তির কারণে তিনি গণিকার কবল থেকে মুক্তি পেতে পারলেন না।
মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী রাজস্থানের ক্ষত্রিয়কুলোদ্ভুত মহারাজাদের উন্নতির পথে নিয়ে যেতে বিশেষভাবে আগ্রহী ছিলেন। এই উদ্দেশ্যেই তিনি অন্যান্য প্রদেশের নিমন্ত্রণ আসা সত্ত্বেও সেখানে যাননি। রাজস্থানেই নিজের কর্মসূচি নির্দিষ্ট রাখলেন।
স্বামীজি মহারাজের উপদেশ ও প্রবচন শুনে যোধপুরের প্রজাদের মধ্যে ধার্মিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিপ্লব/নব-জাগরণ তৈরি হল। তাঁদের সামনে ইসলাম এবং খ্রিস্টান মতের অন্তঃসারশূন্যতা স্পষ্ট হয়ে গেল। পুরাণপন্থী এবং চক্রাঙ্কিতদের লীলাগুলির কুৎসিত স্বরূপও তাঁরা বুঝতে লাগলেন। জায়গীরদারদের গণিকা-সঙ্গ ইত্যাদি অনাচারগুলির প্রতি তাঁদের আর প্রশ্রয় ভাবনা রইল না। বৈদিক সত্য ধর্মের প্রকাশ তাঁদের হৃদয়ে প্রবেশ করল।
এই কারণে সেখানকার সকল অপসম্প্রদায়ের নেতা এবং জায়গীরদার মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতীর বিরোধী হয়ে গেলেন। আর যোধপুর নরেশের উদাসীন বৃত্তি (মনোভাব)-এর কারণে স্বামীজিও যোধপুর ছেড়ে অন্য কোথাও যাওয়ার চিন্তা করতে শুরু করলেন। চার মাস যোধপুরে থাকার সময়কালে মহারাজা যশবন্তসিংহ স্বামীজি মহারাজের কাছে তিনবার দেখা করতে এসেছিলেন। স্বামীজি মহারাজও তিনবার যোধপুর নরেশের ভবনে গিয়েছিলেন। প্রতি সাক্ষাতেই স্বামীজি মহারাজ তাঁকে রাজধর্ম, ক্ষত্রিয়ের কর্তব্য এবং সদাচারের বিষয়ে উপদেশ দিতেন। মহারাজা যশবন্তসিংহ শ্রদ্ধা সহকারে স্বামীজি মহারাজের উপদেশগুলি শুনতেন তো বটে, কিন্তু সেই অনুসারে নিজের আচরণ তৈরি করতে পারলেন না। ননহী জান নামক গণিকায় তাঁর আসক্তি বজায় রইল।
একবার দয়ানন্দ সরস্বতীর দেহাবসানের (মৃত্যুর) পরে ভাটি অর্জুনসিংহ এবং ননহী জান পরস্পরের সাথে আলাপ-আলোচনা করছিলেন। তাঁরা দয়ানন্দ সরস্বতীর বিষয়ে কিছু অন্যায় শব্দ ব্যবহার করলেন। মহারাজা যশবন্তসিংহ শুনে ফেললেন এবং আবেশপূর্ণ শব্দে বললেন– যে তোমরা তাঁর গুরুত্ব জানো না। যদি আমি মহারাজা তাখ্তসিংহের (তাঁর পিতা) সত্যিকারের অর্থে পুত্র হই, তবে সত্য বলছি যে যদি স্বামী দয়ানন্দ এই সময় জীবিত থাকতেন, তবে আমি সন্ন্যাস গ্রহণ করে তাঁর সাথে চলে যেতাম।
দয়ানন্দ সরস্বতী যোধপুর নরেশকে তাঁর নিজের আচরণগুলির উন্নতির প্রতি উপেক্ষা-বৃত্তি (অবহেলা)-কে দেখে অনেক পত্র লিখেছিলেন। শেষে একটি পত্র লিখলেন, যাতে রাজ্যের শাসন সংশোধন এবং প্রজাদের হিতের সম্পর্কে পরামর্শ দিতে গিয়ে তাঁর ব্যক্তিগত আচরণগুলির ওপর আলোকপাত করলেন এবং স্পষ্ট শব্দে লিখলেন যে , …গণিকা ননহী জানের প্রতি আপনার বিশেষ আসক্তি এবং রাজবংশীয় মহারানীদের প্রতি উপেক্ষা-বৃত্তি আছে। আপনার যে প্রকারের ব্যবহার, তাতে আপনি নিজের মান-মর্যাদা ভঙ্গ করছেন। যে প্রকার পাগল কুকুরের বিষ শরীরে ছড়িয়ে পড়লে তা থেকে মুক্তি পাওয়া কঠিন হয়ে যায়, সেই প্রকার গণিকাদের সঙ্গ, মদ্যপান, ঘুড়ি ওড়ানোয় সময়ের ব্যর্থ যাপন, এবং এই প্রকারের অন্যান্য দুর্ভ্যাসগুলিতে মগ্ন থাকা অত্যন্ত ক্ষতিকারক, এগুলি জীবনকে বিনাশের দিকে নিয়ে যায়। রাজ্যকে অধোগতির (পতনের) দিকে নিয়ে যায়। আমি খুব আশ্চর্য হই যে আপনার মতো বুদ্ধিমান্, সাহসী এবং সদ্গুণ সম্পন্ন ব্যক্তি এই প্রকার দুর্ভ্যাসগুলি পরিত্যাগ করছেন না। যদি আপনি এই দুর্ভ্যাসগুলিতে ফেঁসে থাকেন, তবে আপনার সন্তানও এই অবগুণগুলি আপনার থেকে শিখে পতনের দিকে যাবে।
আপনি কৃপা করে রাজকুমারকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য মুসলমান এবং খ্রিস্টান শিক্ষক নিযুক্ত করবেন না, অন্যথায় তারা তাঁদের খারাপ দিকগুলিই শিখবে। নিজেদের রাজকীয় শুভ পরম্পরাগুলিকে ভুলে যাবে, বৈদিক ধর্ম থেকেও বিমুখ হয়ে যাবে। যে শিক্ষা তাঁরা খ্রিস্টান এবং মুসলমান শিক্ষকদের থেকে পাবে, সেই অনুসারে তাঁদের সংস্কার দৃঢ় হয়ে যাবে। ভবিষ্যতে তাঁদের থেকে মুক্তি পাওয়া কঠিন হয়ে যাবে। আপনার মহারাজকুমারের সকল সংস্কার বৈদিক পদ্ধতি অনুসারে করা উচিত। তাঁকে পঁচিশ বছর পর্যন্ত ব্রহ্মচর্যপূর্বক থাকতে দেবেন। যেমন আপনি গণেশ পুরীর (এটি একজন চক্রাঙ্কিত মহারাজার মিথ্যা প্রশংসাকারী ছিল) সঙ্গ ছেড়ে দিয়েছেন, সেই প্রকার এই মিষ্টিভাষিণী এবং ধোঁকা দেওয়া গণিকাদের সঙ্গ কেন ছাড়ছেন না? আপনার গণিকাদের সঙ্গতিতে থেকে নিজের মূল্যবান সময় এবং সদ্গুণগুলিকে হারানো উচিত নয়। আপনার জীবন ইন্দ্রিয়লোলুপতা এবং বিলাসের জন্য নয়। এই জীবন লক্ষ লক্ষ প্রজাদের মঙ্গল করার জন্য, রাজ্যকার্যে কঠিন পরিশ্রম করার জন্য, প্রজাপালনে রত থাকার জন্য এবং উপযুক্ত ন্যায় প্রদান করার জন্য।
মনুস্মৃতির সপ্তম, অষ্টম এবং নবম অধ্যায়গুলিতে রাজার কর্তব্য এবং না করার যোগ্য কাজগুলির প্রতিপাদন করা হয়েছে। আপনি সেগুলির অধ্যয়ন করুন। আমি বিশ্বাস করি যে আপনি আমার এই পরামর্শগুলির ওপর পূর্ণ বিচার করবেন। আমার পরামর্শগুলি তিক্ত অবশ্যই, কিন্তু এইগুলি দ্বারা আপনার কল্যাণ হবে। আপনি বাস্তব শান্তি লাভ করবেন।
মহর্ষির জীবনকথায় বর্ণনা এসেছে যে, একদিনের ঘটনা– দয়ানন্দ সরস্বতী যখন যোধপুর নরের ভবনে তাঁর সাথে দেখা করতে গিয়েছিলেন, তখন তাঁর প্রিয় গণিকা ননহী জান মহারাজার কাছে বসা ছিল। দয়ানন্দ সরস্বতীকে আসতে দেখে মহারাজা ভৃত্যদের দিয়ে ননহী জানকে ডোলি (পালকি)-তে বসিয়ে বাইরে পাঠানোর চেষ্টা করতে গিয়ে ডোলির ওপর নিজের কাঁধও লাগালেন। স্বামীজি মহারাজ এইটি দেখে নিলেন। এই ঘটনা দেখে তাঁর খুব দুঃখ হল। তিনি একজন ক্ষত্রিয় নরের এই প্রকার পতন সহ্য করতে পারছিলেন না। তিনি যোধপুর নরেশ মহারাজা যশবন্তসিংহকে দুই-তিন ঘণ্টা রাজনীতি এবং ক্ষত্রিয়োচিত আচার-ব্যবহারের ওপর উপদেশ দিতে গিয়ে বললেন— ক্ষত্রিয় রাজারা সিংহের সমান মনে করা হয়। গণিকাদের স্থান সমাজে কুকুরীর সমান। সিংহদের কুকুরীর সাথে সম্পর্ক কতটা শোভা দেয়?
মহারাজা যশবন্তসিংহের মাথা লজ্জায় ঝুঁকে গেল। ননহী জান যখন এই সংবাদ পেল, তখন তার ক্রোধের সীমা রইল না। তার মনে এই ভয় উৎপন্ন হল যে পাছে মহারাজা যশবন্তসিংহ তাকে ছেড়ে না দেন। শত্রুতা এবং প্রতিশোধ নেওয়ার ভাবনা তার মনে দৃঢ় হয়ে গেল।
- স্বামীজির ওপর অন্তিম বিষ-প্রয়োগ
পঁচিশে সেপ্টেম্বরের রাত্রির সময় স্বামীজি মহারাজের সেবক কাল্লু কাহার তাঁর ছয়-সাত শত টাকার সামগ্রী চুরি করে জানালার পথ দিয়ে পালিয়ে গেল। এই কাহার পরিশ্রম এবং ভক্তিভরে স্বামীজির কাজ করত। ব্রহ্মচারী রামানন্দকে (স্বামীজির শিষ্য) স্বামীজি মহারাজ আদেশ দিয়েছিলেন যে সে যেন জানালার সামনে শোয়। সেও সেদিন সেখানে শয়ন করেনি। যে কোঠিতে মহারাজ নিবাস করছিলেন, সেই কোঠির প্রহরীগণও সেদিন নিদ্রার বশীভূত হয়ে পড়েছিল।
কাল্লু কাহার স্বামীজি মহারাজের সঙ্গেই প্রথমবার যোধপুর এসেছিল। সে যোধপুরের ভেতরে-বাইরে অপরিচিত ছিল।
যোধপুরের শহর কোতোয়াল মহিনুদ্দিন খাঁ এবং অন্যান্য পুলিশ আধিকারিকেরা শীঘ্র সংবাদ পাওয়া সত্ত্বেও চোরকে খুঁজে বের করতে অসমর্থ রইলেন। এতে কী রহস্য ছিল, তা ইতিহাসের সূক্ষ্ম বিশ্লেষকগণই বলতে পারবেন।
স্বামীজি মহারাজকে জিজ্ঞাসা করা হল যে আপনি কোন কোন ব্যক্তির ওপর চুরিতে অংশ নেওয়ার সন্দেহ করেন? মহারাজ নিজের সরল স্বভাব অনুসারে কারও ওপর সন্দেহ প্রকাশ করলেন না।
আশ্বিন মাসের কৃষ্ণা চতুর্দশী, সংবৎ ১৯৪০ বিক্রমী (২৯ সেপ্টেম্বর ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দ)-এর রাত্রির সময় স্বামীজি মহারাজ রন্ধনকারী এর কাছ থেকে দুধ নিয়ে পান করলেন এবং ঘুমিয়ে পড়লেন। অর্ধরাত্রির সময় তীব্র উদরশূল (পেটে ব্যথা) শুরু হল। মহারাজের নিদ্রা ভেঙে গেল। তিনবার বমন হল, কিন্তু তিনি রাত্রির সময় কাউকে জাগিয়ে কষ্ট দেওয়া উচিত মনে করলেন না। ত্রিশ সেপ্টেম্বর সকালবেলা মহারাজ বিলম্বে উঠলেন। উঠতেই পুনরায় বমন হল। তাঁর সন্দেহ হল যে কেউ দুধে বিষ মিশিয়ে দিয়েছে। বিষ-দোষের নিরাকরণের জন্য মহারাজ জলপান করে পুনরায় বমন করলেন। শূল-বেদনা বাড়তেই থাকল।
বিষ-মিশ্রিত দুধ পান করানোর রন্ধনকারীর নাম ধৌল মিশ্র ছিল নাকি জগন্নাথ, এই বিষয়ে লেখকদের ভিন্ন ভিন্ন মত আছে। প্রচলিত কথা তো এটাই যে তাঁর রন্ধনকারী জগন্নাথ, গণিকা ননহী জান দ্বারা প্রলোভিত হয়ে দয়ানন্দ সরস্বতীকে দুধে বিষ মিশিয়ে দিয়েছিল।
পণ্ডিত নানূরাম ব্রহ্মাবর্ত দয়ানন্দ সরস্বতীকে শাহপুরা থেকে যোধপুর নিয়ে যাওয়ার জন্য গিয়েছিলেন। তাঁর ঘোষণা অনুসারে ননহী জানের প্ররোচনায় কলিয়া উপনামধারী জগন্নাথ সেখানকার মালীর সাথে গুপ্ত মন্ত্রণা করে দয়ানন্দ সরস্বতীকে দুধে বিষ মিশিয়ে পান করার জন্য দিয়েছিল।
যোধপুরের প্রসিদ্ধ ইতিহাসবেত্তা দেবীপ্রসাদেরও এটাই মত যে ননহী জান সেখানকার মালীকে প্রলোভন দিয়েছিল এবং মালী স্বামীজি মহারাজের রন্ধনকারী কলিয়াকে মহারাজকে বিষ দেওয়ার জন্য প্রস্তুত করে নিয়েছিল।
রাজকোটের এক মহাশয়-এর তথ্যের ভিত্তিতে 'সদ্ধর্ম প্রচারক' সংবাদপত্রটিতে এই বিষয়ে যে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল, সেই অনুসারেও ব্রাহ্মণবংশীয় জগন্নাথ, যে মহারাজের রন্ধনশালায় রন্ধনকার্যও করত, কারও প্ররোচনায় প্রলোভনের বশে দয়ানন্দ সরস্বতীকে দুধে বিষ মিশিয়ে পান করানোর মহাক্ষতিকারক কাজটি করেছিল।
জ্ঞান হওয়ার পরে মহারাজ তাকে সম্পূর্ণরূপে ক্ষমা প্রদান করে কিছু টাকা দিলেন এবং অবিলম্বে যোধপুর রাজ্যের সীমা পার করে নেপাল চলে যাওয়ার আদেশ দিলেন। পাপী নিজের পাপকর্ম ছাড়ল না। সন্ন্যাসী নিজের ক্ষমা-ধর্মের পরিত্যাগ করলেন না। দয়ার সাগর দয়ানন্দ বিষ দিয়ে হত্যা করতে আসা জগন্নাথকে নিজের দয়ার পাত্র বানিয়ে জীবন-দান দিলেন।
দয়ানন্দ সরস্বতীর নিকটবর্তী শিষ্যজনেরা মহারাজের তীব্র বেদনায় কোনো প্রকারের হ্রাস না দেখে রাওরাজা তেজসিংহকে ডাকালেন। স্বামীজি মহারাজ কোনো হিন্দু চিকিৎসকের দ্বারাই চিকিৎসা করাতে চাইছিলেন। রাওরাজা যোধপুর জেলের ডাক্তার সুরজমলকে ডাকালেন। এই সময় মহারাজের বমন-এর সাথে অতিসার (ডায়রিয়া)ও শুরু হয়ে গিয়েছিল। কিছুটা জ্বরও ছিল। ডঃ সুরজমলের ঔষধিতে জ্বরের বেগ কিছুটা কম হল, কিন্তু উদরশূলে হ্রাস হল না। কর্নেল স্যার প্রতাপসিংহ ডঃ আলিমর্দান খাঁকে স্বামীজির চিকিৎসার জন্য পাঠালেন। ডঃ আলিমর্দান খাঁ একজন সাধারণ সাব-অ্যাসিস্ট্যান্ট সার্জন ছিল। মিথ্যা প্রশংসাকারী হওয়ার কারণে রাজকর্মচারীদের মুখ-লাগা (প্রিয়পাত্র) ছিল। ডঃ আলিমর্দান খাঁ-এর চিকিৎসা সম্পূর্ণরূপে প্রতিকূল প্রমাণিত হল। যত ঔষধ দেওয়া হল, মহারাজের রোগ বাড়তেই থাকল।
দুই অক্টোবরের দিনে ডঃ আলিমর্দান খাঁ মহারাজকে বিরেচক ঔষধি (শক্তিশালী রেচক/মল নরম করার ঔষধ) দিলেন। ঔষধির মাত্রা ছিল চার গুণ বেশি। মহারাজ জিজ্ঞাসা করায় সে বলল যে এতে আপনার ছয়-সাত বার বিরেচন (মলত্যাগ) হবে। তিন অক্টোবর সকাল দশটা পর্যন্ত তো বিরেচন হল না, কিন্তু তার পরে চার অক্টোবর সকাল পর্যন্ত চল্লিশ বার বিরেচন হল। সারাদিন ধরে বিরেচন হতে থাকল। সন্ধ্যায় মহারাজ নিজেকে অত্যন্ত দুর্বল অনুভব করতে লাগলেন মূর্ছা আসতে শুরু হল। তীব্র শূল এবং অতিসারের সাথে মহারাজের গলা, জিহ্বা, তালু এবং মুখে ঘা (ফোস্কা) পড়ে গেল। হেঁচকি শুরু হয়ে গেল। ষোলো অক্টোবর পর্যন্ত ডঃ আলিমর্দান খাঁ-এর চিকিৎসা চালু রইল। প্রতিদিন দশ-পনেরো বার বিরেচন হতে থাকল। শূলে কোনো প্রকারের হ্রাস হল না। হেঁচকি এবং ঘা বাড়তে থাকল। অবস্থা আরও গম্ভীর হয়ে গেল।
এই কষ্টময় অবস্থায়ও মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী শান্ত ছিলেন। চিকিৎসকের মনে কী ভাবনা ছিল, তা তো ইতিহাসের সূক্ষ্ম বিশ্লেষকগণই বলতে পারবেন, কিন্তু স্বামীজির মনে কোনো প্রকারের সন্দেহের ভাবনা ছিল না। ডঃ আলিমর্দান খাঁ রাজকর্মচারীদের এটাই বলতে থাকল যে কোনো প্রকার চিন্তার কথা নেই, দয়ানন্দ সরস্বতী শীঘ্রই সুস্থ হয়ে যাবেন।
বারো অক্টোবর পর্যন্ত দয়ানন্দ সরস্বতীর অসুস্থতার সংবাদ যোধপুরের বাইরে কারও জানা ছিল না। এই দিন রাজপুতানা গেজেটে প্রথমবার মহারাজের রোগী হওয়ার সংবাদ প্রকাশিত হল। আজমীরের এক ভক্তের দৃষ্টি এই সংবাদের ওপর পড়ল। আর্যসমাজের সদস্যদের মধ্যে এই সংবাদে চঞ্চলতা শুরু হল। লালা জেঠমলকে যোধপুর পাঠানো হল। যোধপুর পৌঁছে লালা জেঠমল মহারাজের অবস্থা দেখে অত্যন্ত বিচলিত হয়ে গেলেন। দয়ানন্দ সরস্বতীকে প্রণাম করে নিবেদন করলেন– "মহারাজ! আপনি এই প্রকার কষ্টময় অবস্থায় আছেন, কিন্তু আপনি কোনো আর্যসমাজকে নিজের রোগগ্রস্ত হওয়ার সংবাদ দেননি।"
মহারাজ উত্তর দিলেন– "প্রিয় জেঠমল! দুঃখ-সুখ তো শরীরের সাথে লেগেই থাকে। আমার কষ্টময় অবস্থা দেখে আপনারা সকলেও নিজেকে দুঃখী অনুভব করতেন। নিজের কষ্টের সাথে সকলকে কষ্ট দেওয়ার আমার ইচ্ছা ছিল না।"
লালা জেঠমল তখনই বম্বাই, ফররুখাবাদ, মীরাট, লাহোর, আজমীর তথা অন্যান্য স্থানের আর্যসমাজগুলিকে তারের মাধ্যমে মহারাজের রোগের গম্ভীর অবস্থার সংবাদ দিলেন। মহারাজের স্বাস্থ্যের খবর জানার জন্য তার (টেলিগ্রাম) আসতে শুরু করল।
এই দেখে সব ভক্তজন আশ্চর্যান্বিত হলেন যে, আমাদের সকলের নবজীবন দানকারী পরম শ্রদ্ধেয় গুরুর জীবন নিয়ে যোধপুরে খেলা করা হচ্ছে। যোধপুরে সেই সময় ডঃ রোডমস এবং ডঃ নবীনচন্দ্র গুপ্ত দুজন সুযোগ্য প্রথম শ্রেণীর চিকিৎসক ছিলেন। এই গম্ভীর অবস্থাতেও মহারাজের দেখাশোনা করা রাওরাজা তেজসিংহ এবং কর্নেল স্যার প্রতাপসিংহ এই দুজনের মধ্যে কোনো ডাক্তারকে মহারাজের চিকিৎসায় পরামর্শের জন্য ডাকালেন না। একজন সাধারণ তৃতীয় শ্রেণীর সাব-অ্যাসিস্ট্যান্ট ডঃ আলিমর্দান খাঁ-এর হাতে দয়ানন্দ সরস্বতীর জীবনের বাগডোর (নিয়ন্ত্রণ) সমর্পন করে নিশ্চিত হয়ে গেলেন। রাওরাজা তেজসিংহ প্রতিদিন মহারাজের অবস্থা দেখতে আসতেন, কিন্তু তাঁর বিগড়ে যাওয়া অবস্থা দেখেও তিনি কোনো যোগ্য চিকিৎসককে চিকিৎসা পরামর্শের জন্য ডাকার চেষ্টা করলেন না। কর্নেল স্যার প্রতাপসিংহ এবং যোধপুর নরেশ মহারাজা যশবন্ত সিংহ তো স্বামীজি মহারাজের স্বাস্থ্য অবস্থা দেখতেও কখনও আসেননি।
লালা জেঠমল দয়ানন্দ সরস্বতীর রোগের গম্ভীর অবস্থা দেখে তাঁকে যত শীঘ্র সম্ভব আজমীর নিয়ে যেতে চাইলেন। পনেরো অক্টোবরের দিনে ডঃ আলিমর্দান খাঁ-ও মহারাজের রোগের গম্ভীর অবস্থা দেখে ভয় পেয়ে গেল। সে চাইছিল না যে স্বামীজি মহারাজ যোধপুরেই শরীর ত্যাগ করুন এবং তাকে এই অপযশের ভাগীদার হতে হোক। ডঃ আলিমর্দান খাঁ দয়ানন্দ সরস্বতীকে বায়ু পরিবর্তনের জন্য আবু নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিলেন। এই দিন প্রথমবার যোধপুর রাজ্যের প্রধান চিকিৎসক ডঃ রোডমসকে দয়ানন্দ সরস্বতীর স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য ডাকা হল। তিনিও মহারাজকে আবু পাঠানোর জন্য সম্মতি প্রকাশ করলেন। আবুতে যোধপুর রাজ্যের ভবনে মহারাজের নিবাসের ব্যবস্থা করা হল।
ষোলো অক্টোবরের দিনে যোধপুর নরেশ মহারাজা যশবন্তসিংহ এবং কর্নেল স্যার প্রতাপসিংহ দয়ানন্দ সরস্বতীকে বিদায় জানানোর জন্য তাঁর নিবাস স্থানে এলেন।
মহারাজের গম্ভীর অবস্থা দেখে চিন্তা প্রকাশ করলেন। মহারাজের আবু পর্যন্ত যাওয়ার জন্য সকল প্রকারের সুবিধাদির ব্যবস্থা করলেন। মহারাজা যশবন্তসিংহ ২৫০০ টাকা এবং দুটি শাল মহারাজকে উপহার দিলেন। নিজের ফ্ল্যানেলের পেটি (কোমরবন্ধ) নিজের হাত দিয়ে মহারাজকে বাঁধলেন, যাতে তাঁকে শোয়ার সময় কষ্ট না হয় এবং পেটে শীতল বাতাসের খারাপ প্রভাবও না পড়ে। ডঃ সুরজমল এবং চারণ নবলদানকে আবু রোড পর্যন্ত স্বামীজি মহারাজের সাথে যাওয়ার আদেশ দিলেন।
দয়ানন্দ সরস্বতীকে ধীরে ধীরে পালকিতে শোয়ানো হল। সম্মান প্রদর্শনের জন্য যোধপুর নরেশও পালকিতে কাঁধ লাগালেন। নিজের কর্মচারীদের সাথে কোঠির দরজা পর্যন্ত স্বামীজি মহারাজকে ছাড়তে গেলেন। বিদায়ের সময় যোধপুর নরেশ স্বামীজি মহারাজের স্বাস্থ্য লাভ হওয়ার পরে পুনরায় যোধপুরে পদার্পণ করার প্রার্থনা করলেন।
পথ লম্বা ছিল। দেহের অবস্থা গম্ভীর ছিল। অতিসার, বমন এবং উদরশূল ইত্যাদি সকল কষ্ট প্রচণ্ড মাত্রায় ছিল। কিন্তু তাতে মহারাজের চিত্ত শান্ত ছিল। কোনো প্রকারের কষ্টের শব্দ ছিল না।
ডঃ সুরজমলের স্ত্রী যোধপুরে রোগে পীড়িত ছিলেন, অতএব মহারাজ পথের অর্ধেক দূরত্বের মধ্যেই তাঁকে যোধপুর ফিরে যাওয়ার আদেশ দিলেন।
আলিগড় জেলার প্রতিষ্ঠিত ঠাকুর ভূপালসিংহ মহারাজের পরম ভক্ত ছিলেন। তিনি মহারাজের সেবা করার জন্য আবুর পথেই মহারাজের কাছে পৌঁছে গেলেন।
তিনি সেবার সম্পূর্ণ কাজ নিজের হাতে নিলেন। অন্তিম সময় পর্যন্ত মহারাজকে তোলা, বসানো, মল-মূত্র পরিষ্কার করা, বস্ত্র ধোয়া ইত্যাদি সকল কাজ তিনি নিজের হাতে করতেন। আবু পর্বতে মীরাট থেকে লক্ষণস্বরূপ, ফররুখাবাদ থেকে লালা শিবদয়াল, বম্বাই থেকে শ্রীকৃষ্ণদাসও মহারাজের সেবায় এসে পৌঁছালেন। যোধপুর থেকে কর্নেল স্যার প্রতাপসিংহও মহারাজের দর্শন করতে আবুতে পদার্পণ করলেন।
একুশ অক্টোবরের দিন প্রাতঃকালে স্বামীজি মহারাজ আবু রোড পৌঁছালেন। এখানে কিছুক্ষণ থাকার পরে তাঁকে পুনরায় পালকিতে শয়ন করানো হল। মহারাজের পালকি আবু রোড থেকে আবু পর্বত-এর দিকে যাচ্ছিল। পঞ্জাব-এর শাহপুর জেলার নিবাসী ডঃ লছমনদাস আবু পর্বত থেকে আজমীর যাওয়ার জন্য আবু রোডের দিকে আসছিলেন। তিনি রাজকীয় হাসপাতালে কাজ করতেন। তাঁকে আবু থেকে আজমীরের হাসপাতালে সেবার নিমিত্ত যাওয়ার আদেশ দেওয়া হয়েছিল।
পথে স্বামীজি মহারাজকে পালকিতে নিয়ে যেতে দেখে জিজ্ঞাসা করার পরে তিনি জানতে পারলেন যে এতে দয়ানন্দ সরস্বতী বিরাজমান আছেন। তাঁর অবস্থা গম্ভীর। ডঃ লছমন দাস তখনই মহারাজের সাথে পুনরায় আবু পর্বতের দিকে চলতে শুরু করলেন। পথে প্রয়োজনীয় চিকিৎসার ব্যবস্থাও করতে থাকলেন। আবু পর্বত পৌঁছানোর পরেও ডঃ লছমনদাসের চিকিৎসা জারি রইল। এতে মহারাজ কিছুটা শান্তি পেলেন। বমন (বমি) এবং অতিসারেও (ডায়রিয়া) অনেক লাভ হল। চব্বিশ অক্টোবরের দিনে মহারাজ ঘুমালেনও।
রাজস্থানের চিফ মেডিকেল অফিসার কর্নেল স্পেন্সারের আদেশ অনুসারে ডঃ লছমনদাসকে আজমীর যেতে হতো। দয়ানন্দ সরস্বতীর মতো মহাপুরুষের সেবা এবং চিকিৎসার সৌভাগ্য কোনো বিরল ভাগ্যবান মানুষই লাভ করতে পারে। ডঃ লছমনদাস কর্নেলকে প্রার্থনা করলেন যে তাঁকে যেন নিজের গুরু দয়ানন্দ সরস্বতীর সেবার জন্য দুই মাসের অবকাশ (ছুটি) দেওয়া হয়। কর্নেল অবকাশের প্রার্থনা স্বীকার করলেন না। ডঃ লছমন দাস সেবা থেকে ত্যাগপত্র (ইস্তফা) দেওয়ার সংকল্প করলেন, কিন্তু যখন দয়ানন্দ সরস্বতী এই কথা জানতে পারলেন, তখন তিনি ত্যাগপত্রটি ছিঁড়ে ফেলে দিলেন এবং ডঃ লছমনদাসকে আজমীর যাওয়ার আদেশ দিলেন। ভক্ত ডঃ লছমনদাসের মন মানল না। তিনি আবার ত্যাগপত্র লিখে কর্নেল স্পেন্সারের সেবায় পেশ করলেন। কর্নেল স্পেন্সার ত্যাগপত্র অস্বীকৃত করে বললেন যে তোমাকে আজমীর যেতেই হবে। আমি তোমার গুরুর চিকিৎসা স্বয়ং করব।
ডঃ লছমনদাসকে না চাইতেও আজমীর যেতে হল। স্বামীজি মহারাজেরও এটাই আদেশ ছিল।
কর্নেল স্পেন্সারের চিকিৎসা মহারাজের অনুকূল হল না। পুনরায় রোগ উগ্র রূপ ধারণ করল। স্বামীজি মহারাজের ভক্ত ভূপালসিংহ মহারাজকে আজমীর যাওয়ার জন্য নিবেদন করলেন। বম্বাইয়ের শ্রী সেবকরম করশনদাসও মহারাজকে নম্রতা সহকারে আজমীর যাওয়ার জন্য অনুরোধ করলেন। মহারাজের ইচ্ছা ছিল না যে শরীরের এই বিষম (কঠিন) অবস্থায় ভক্তদের কষ্ট দেওয়া হোক। না চাইতেও ভক্তদের অনুরোধ স্বীকার করতে হল। কার্তিক মাসের কৃষ্ণা একাদশী (২৬ অক্টোবর)-এর দিনে মহারাজ আবু পর্বত থেকে প্রস্থান করলেন। পরের দিন চারটের সময় ব্রহ্ম মুহূর্তে তিনি আজমীর পৌঁছে গেলেন। সেখানে আগ্রা দরজার বাইরে ভিনাই হাউসে মহারাজের বিশ্রামের ব্যবস্থা করা হল।
ডঃ লছমনদাসকে পুনরায় চিকিৎসার জন্য ডাকানো হল। স্বাস্থ্যে উত্থান-পতন দেখা যেতে থাকল, কিন্তু মহারাজ অনুভব করতে লাগলেন যে এখন এই দেহ ত্যাগের সময় এসে গেছে। বিষের প্রভাব সারা শরীরে ছড়িয়ে গিয়েছিল। উদরশূলের সাথে কফের প্রকোপও শুরু হল। অন্তর্দাঘ (ভিতরের জ্বালা) বাড়তে থাকল। সারা শরীরে ঘা (ফোস্কা) ছড়িয়ে পড়তে লাগল।
দীপমালিকা (দীপাবলি)-র এক দিন পূর্বে লাহৌর থেকে পণ্ডিত গুরুদত্ত বিদ্যার্থী এম. এ. (সায়েন্স) এবং লালা জীবনদাসও মহারাজের দর্শনের নিমিত্ত আজমীর পৌঁছে গেলেন। উদয়পুর থেকে মহারানা সজ্জনসিংহ মোহনলাল বিষ্ণুলাল পাণ্ড্যাকে মহারাজের স্বাস্থ্য সংবাদ জানার জন্য পাঠালেন, সাথে এই কথাও বলিয়ে পাঠালেন যে মহারাজের চিকিৎসায় যেন কোনো ত্রুটি না থাকে।
সকল আগত ভক্তজন মহারাজের গম্ভীর অবস্থা দেখে অধীর হয়ে উঠলেন। এই পীড়িত অবস্থায় মহারাজ নিজের শান্ত দৃষ্টি দ্বারা সকলকে ধৈর্য দিচ্ছিলেন। লালা জীবনলাল মহারাজকে পণ্ডিত গুরুদত্তের পরিচয় করালেন।
- দীপাবলির দিন, মহর্ষির মহাপ্রয়াণ
কার্তিক অমাবস্যা (৩০ অক্টোবর)-এর দিনে ডঃ লছমনদাস মহারাজের জীবনের সকল আশা ছেড়ে দিলেন। ভক্তদের অনুরোধ করলেন যে অন্য কোনো সুযোগ্য ডাক্তারকেও মহারাজকে দেখানোর জন্য ডাকা হোক। আজমীরের সিভিল সার্জন ডঃ নিউম্যানকে ডাকা হল। ডঃ নিউম্যান মহারাজের অবস্থা দেখে আশ্চর্য হলেন। বিষের প্রভাব সারা শরীরে ছেয়ে ছিল। প্রতিটি লোমকূপে বেদনা ছিল। এই কষ্টদায়ক গম্ভীর অবস্থায় এই সাধু শান্ত ছিলেন। সাহস এবং সহনশীলতার চরম সীমা (পরাকাষ্ঠা) ছিলেন। ডঃ নিউম্যান রোগ পরীক্ষার পরে ডঃ লছমনদাসের চিকিৎসা-ক্রমের সাথে সম্মতি প্রকাশ করে বুকে কফের প্রকোপ কমানোর জন্য পুলটিস লাগানোর পরামর্শ দিলেন। কিন্তু দশার কোনো পরিবর্তন হল না।
যদিও আজ এই দিনটিতে অবস্থা অধিক গম্ভীর ছিল। কিন্তু দয়ানন্দ সরস্বতী নিজেকে কিছুটা ভালো অনুভব করছিলেন। প্রাতঃকালে নাপিতকে ডাকালেন। আজমীর আর্যসমাজের মন্ত্রী বাবু মথুরাপ্রসাদ নাপিতের সন্ধানে গেলেন। নাপিত বলল– আজ দীপমালিকার দিন, আমি ক্ষৌর-কর্মের (দাঁড়ি-চুল কাটার) পাঁচ টাকা নেব, তাঁরা তাঁকে স্বামীজির কাছে নিয়ে এলেন। ক্ষৌর-কর্মের পরে মহারাজ স্বয়ং মথুরাপ্রসাদকে বললেন যে একে পাঁচ টাকা দিয়ে দাও। কক্ষের বাইরে আসার পরে তাকে এক টাকা আরও দেওয়ালেন।
এগারোটার সময় মহারাজ শৌচের জন্য উঠতে চাইলেন। চারজন লোক তাঁকে ওঠালেন। নিবৃত্ত হওয়ার পরে পুনরায় পালঙ্কে শুইয়ে দেওয়া হল। এই সময় শ্বাসের গতি তীব্র ছিল। ভক্তজনেরা মহারাজকে জিজ্ঞাসা করলেন– আপনি কেমন অনুভব করছেন?
স্বামীজি মহারাজ শান্তভাবে উত্তর দিলেন– আজ আমি ভালো অনুভব করছি। এক মাস পরে আজকের দিন শান্তি অনুভব করছি।
লালা জীবনদাস জিজ্ঞাসা করলেন– আপনি কোথায় আছেন?
মহারাজ বললেন– ঈশ্বর-ইচ্ছার।
চারটের সময় মহারাজ নিজের শিষ্য আত্মানন্দকে ডাকালেন। তাঁকে নিজের পেছনে মাথার কাছে বসার আদেশ দিলেন। তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, আত্মানন্দ! তুমি কী চাও?
আত্মানন্দ বললেন- মহারাজ! আমি ঈশ্বরের কাছে এটাই প্রার্থনা করি যে আপনি যেন সুস্থ হয়ে যান।
মহারাজ তাঁকে সান্ত্বনা দিতে দিতে বললেন- এই দেহ পঞ্চভৌতিক। এর ভালো কী হবে? পুনরায় তাঁর মাথায় সস্নেহে আশীর্বাদের হাত রেখে বললেন- আনন্দের সাথে থেকো।
মহারাজের দর্শনের জন্য কাশী থেকে স্বামী গোপালগিরিও এসেছিলেন। তাঁকেও এই প্রকার আশীর্বাদ দিলেন।
এর পরে দুই শত টাকা এবং দুটি দুশালা (শাল) আনিয়ে বললেন– আত্মানন্দ এবং ভীমসেন, দুজনকে এইগুলি দিও।
দূর প্রদেশগুলি থেকে আসা সকল ভক্তজন শোকাশ্রুসিক্ত শ্রদ্ধাপূর্ণ ভাবনা নিয়ে মহারাজের সামনে দাঁড়িয়ে গেলেন। মহারাজ তাঁদের কৃপাভরা দৃষ্টিতে দেখলেন, যেন মৌন উপদেশ করছেন– ভক্ত পুরুষগণ! ধৈর্য এবং সাহস ধারণ করো। অধীর হয়ো না। উদাস হওয়ার কোনো কারণ নেই। এই শরীর তো নশ্বর।
মহারাজের মুখমণ্ডল শান্ত এবং প্রসন্ন ছিল। কোনো প্রকারের শোক অথবা আক্ষেপের চিহ্ন ছিল না। কোনো প্রকারের দুঃখের ধ্বনি ছিল না। ধৈর্যের সাথে ভক্তজনদের সাথে কথা বলছিলেন। এই সময়ে আলিগড় থেকে মহারাজের সর্বপ্রথম ভক্ত শিষ্য সুন্দরলালও আসলেন।
পাঁচটার পরে মহারাজ সকল আগত ভক্তজনদের আদেশ দিলেন যে তাঁরা যেন তাঁর পেছনে দাঁড়িয়ে যান। দরজা এবং রোশনদান (ভেন্টিলেটর) খুলে দেওয়া হল। জিজ্ঞাসা করলেন– আজ কোন মাস, পক্ষ এবং দিন?
কোনো ভক্ত বললেন— মহারাজ, আজ কার্তিক মাসের অমাবস্যার দিন। মঙ্গলবার।
এই শুনে মহারাজ ওপরের দিকে দৃষ্টিপাত করলেন, পুনরায় চারিদিকে চমৎকারভরা দৃষ্টিতে দেখলেন এবং বেদ মন্ত্রের পাঠ করতে শুরু করলেন। কিছুক্ষণ বেদমন্ত্র পাঠ করে সংস্কৃতে ঈশ্বরের স্তুতি করলেন। গুণগানের সাথে আনন্দ মগ্ন হয়ে গায়ত্রী মন্ত্রের উচ্চারণ করলেন এবং শান্ত সমাধিস্থ হয়ে গেলেন। পুনরায় চোখ খুলে "ओ३म्" উচ্চারণ করলেন এবং বললেন,
" হে দয়াময় সর্বশক্তিমান ঈশ্বর! তোমার এটাই ইচ্ছা, তোমার এটাই ইচ্ছা, তোমার এটাই ইচ্ছা, তোমার ইচ্ছা পূর্ণ হোক। তোমার লীলা অদ্ভুত। ”
এই শব্দগুলির সাথে স্বয়ং পাশ ফিরলেন একবার শ্বাসকে রোধ করে পুনরায় চিরকালের জন্য বাইরে বের করে দিলেন। দীপাবলীর দিন সন্ধ্যার ছয়টার সময় ছিল। দয়ানন্দ সরস্বতী ইহলীলা সমাপ্ত করে জ্যোতির্ময় প্রভুর শরণে চলে গেলেন।
ভক্তজন তাকিয়ে রইলেন। পণ্ডিত গুরুদত্ত বিদ্যার্থী প্রথমবার দয়ানন্দ সরস্বতীর দর্শন করতে এসেছিলেন। পাশ্চাত্য বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলেন। ঈশ্বরের ওপর বিশ্বাস কিছুটা কম ছিল। ভক্তদের সাথে এই যোগীপুরুষের লীলা দেখছিলেন। অসহ্য বেদনা এবং অন্তর্দাঘেও ইনি তাঁর শরণে প্রসন্নচিত্তে যাচ্ছেন। এই যোগী চিরকালের জন্য অমর পদ লাভ করছেন। গুরুদত্তেরও এই দিব্য শক্তির দর্শন হয়ে গেল। তাঁর চিত্তের অন্ধকার নষ্ট হল। দিব্য জ্যোতি অন্তরে প্রবেশ করলো। আজ থেকে তিনি পূর্ণ আস্তিক হয়ে গেলেন। ঈশ্বর-বিশ্বাসী হয়ে উঠলেন এবং মহর্ষি দয়ানন্দের শিষ্যরূপে বৈদিক ধর্মের সেবায় নিজের জীবনকে উৎসর্গ করে দিলেন
সকল উপস্থিত ভক্তজনদের চোখ এই যোগীর বেদনাময় বিদায় দেখে অশ্রুতে ভরে উঠেছিলো। কিন্তু এই বিদায়ের দিব্যতাপূর্ণ দৃশ্য দেখে তাঁরা নিজেদের হৃদয়ে অদ্ভুত জ্যোতির অনুভব করছিলেন। যদিও তাঁদের ঘরে আজ অন্ধকার ও শোক, কিন্তু হৃদয়ে দীপাবলির অম্লান প্রকাশ ছিল।
পরের দিন (৩১ অক্টোবর ১৮৮৩) এই যোগীর দেহের অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়া-র প্রস্তুতি হল। কাঠের অর্থী-র (শববাহী খাট) ওপর চন্দন, কাষ্ঠ, কর্পূর ইত্যাদি সুগন্ধিত পদার্থ রাখা হল। শরীরে চন্দনের লেপ দেওয়া হল। অর্থীর ওপর রেখে এক বিশাল শোভাযাত্রার সাথে শ্মশানঘাটে নিয়ে যাওয়া হল। এই শোভা যাত্রায় আজমীরের জনতার সাথে সেখানে বসবাসকারী বাঙালি, পাঞ্জাবি, দাক্ষিণাত্য তথা অন্যান্য ভক্ত পুরুষেরা বৃহৎ সংখ্যায় অংশগ্রহণ হলেন। শ্রী হরবিলাস সারদাও এই অর্থীর সাথে ছিলেন। তাঁর কথা অনুসারে ষোলো জন পুরুষ এক সময়ে সেই অর্থীটিকে তুলে নিয়ে যাচ্ছিলেন। সকল সজ্জন ক্রমশঃ কাঁধ দিচ্ছিলেন। সাথে সাথে বেদ মন্ত্রগুলির উচ্চস্বরে গান হচ্ছিল।
শ্মশানঘাটে অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়ার জন্য বিশেষ রূপে বেদীর নির্মাণ করা হল। সংস্কার-বিধি অনুসারে বৈদিক পদ্ধতি দ্বারা অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়া সম্পন্ন করা হল।
যে তেজস্বী বিশাল দেহকে দেখে সকল ভক্তজন নতমস্তক হয়ে অভিনন্দন করতেন, আজ তাকে নিজের হাতে চিতায় রেখে অগ্নির শিখাগুলির কাছে সমর্পণ করছিলেন। উপস্থিত সকলের চক্ষু অশ্রুতে পরিপূর্ণ ছিল। বাক্যে স্পন্দন নেই। মনে শোকাবেগের চিন্তা নেই। কিন্তু সেই মহামানবের কার্যকে ভবিষ্যতে কীভাবে বাড়াবেন, এই চিন্তায় তারা মগ্ন হয়ে রইলেন। অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়া সমাপ্তির পরে নীরব শ্রদ্ধা-র সাথে উপস্থিত শোকাকুল জনগণ ধীর গতিতে নিজেদের বাড়িতে চলে গেলেন।
স্বামীজীর মহাপ্রয়াণের সংবাদ বিদ্যুৎগতিতে ছড়িয়ে পড়লো, সর্বত্র শোক, সমগ্র ভারতবর্ষে শোকের ঘনঘটা ছেয়ে গেল। নগর-নগরে শোক সভা আয়োজিত হল। দেশজুড়ে প্রায় সকল সংবাদপত্রে তাঁর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করা হল এবং প্রবন্ধ লিখে তাঁর গুণ এবং কার্যগুলির প্রশংসা স্মরণ করা হল।
সন্দর্ভ - মূল গ্রন্থ: “ ऋषि दयानन्द की संघर्ष-यात्रा ”/ চতুর্থ অধ্যায়/ প্রকাশক: আর্যসমাজ সেক্টর-23, 24, রোহিনী, দিল্লি-85, প্রথম সংস্করণ, চৈত্র শুক্ল প্রতিপদা - সম্বৎ ২০৭১ বিক্রম০, ৩১ মার্চ ২০১৪।
বিদুষামনুচরঃ
ভাষান্তর: সুব্রত দেবনাথ
