স্বামী বিদ্যানন্দ সরস্বতী


    স্বামী বিদ্যানন্দ সরস্বতী 


স্বামী বিদ্যানন্দ সরস্বতী জী বৈদিক ধর্মের এমন এক মনীষী সন্ন্যাসী ছিলেন যিনি তাঁর সমগ্র জীবন আর্যসমাজের কোন‌ও বড় পদে অধিষ্ঠিত না হয়ে‌ও আর্যসমাজকে অনুকরণীয় নেতৃত্ব প্রদান করেছেন এবং বৈদিক সাহিত্য প্রণয়ন ক্ষেত্রে অবিস্মরণীয় কার্য করেছেন । তাঁর জীবন না কেবল সাধারণ, বরঞ্চ আর্য জগতের সমস্ত নেতা, বিদ্বানগণ এবং কার্যকর্তাগণের জন্য‌ অনুকরণীয় । 

 স্বামী বিদ্যানন্দ জীর সন্ন্যাস গ্রহণের পূর্বাশ্রমীয় নাম পণ্ডিত “লক্ষ্মীদত্ত দীক্ষিত” । তাঁর জন্ম‌ ১৯১৪ সনের‌ ২০ আগষ্ট উত্তর প্রদেশের বিজনৌর জেলার অস্করীপুর নামক গ্রামে ‌। তাঁর পিতার নাম কেদারনাথ দীক্ষিত । স্বামী বিদ্যানন্দ জীর‌ পিতা পণ্ডিত কেদারনাথ দীক্ষিত আর্যজগতের প্রমুখ সন্ন্যাসী তথা শাস্ত্রার্থ‌ মহারথী‌ স্বামী দর্শনানন্দ জীর প্রবচন দ্বারা প্রভাবিত হয়ে আর্যসমাজী হয়েছিলেন । স্বামী বিদ্যানন্দ জীর জন্মের সময় তিনি আর্য প্রাদেশিক প্রতিনিধি সভা, পাঞ্জাবের অন্তর্গত লাহোরে উপদেশক পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন।    

বাল্যকাল থেকেই স্বামী বিদ্যানন্দ জী গ্রামের‌ বিভিন্ন গৃহের‌ দেওয়ালে ‘‘বেদ পড়, আর্য হ‌ও” এমন পঙ্ক্তি লিখতেন । এই সময় তিনি দ্বিতীয় শ্রেণীতে‌ পড়তেন । এটি স্বামী জীর‌ জীবনে প্রথম বেদ-প্রচার কার্য‌ ছিল । তাঁর শিক্ষা সম্পন্ন হয় হোশিয়ারপুর তথা লাহোরে অবস্থিত D.A.V কলেজে । স্বামী জী আর্য যুবক সমাজ, হোশিয়ারপুরের এক প্রমুখ ঘটক এবং প্রাণ ছিলেন । 

 

১৯৩৫ সনে স্বামী বিদ্যানন্দ জী লালা দেবীচন্দ্র দ্বারা হোশিয়ারপুরে স্থাপিত “দয়ানন্দ সালবেশন মিশন”-এ শুদ্ধি-কার্য করেন, যার প্রেরণা তাঁর পিতা পণ্ডিত কেদারনাথ দীক্ষিত দ্বারা ১৯২৩ সনে মহাত্মা হংসরাজ জীর নেতৃত্বে শুদ্ধি-কার্যের মাধ্যমে পেয়েছিলেন । স্বামী জী দুইজন প্রসিদ্ধ ব্যক্তির শুদ্ধি সম্পন্ন করেছিলেন । যার মধ্যে একজন ছিলেন খান আব্দুল গফ্ফারের ভ্রাতা, শুদ্ধির‌ পর যার নাম রাখা হয় ধর্মসিংহ । অপরজন ছিলেন শ্রী জ্ঞানেন্দ্র সূফী । যিনি শুদ্ধি‌ হ‌ওয়ার পর আজীবন‌ বৈদিক ধর্ম প্রচারে রত‌ থাকেন । তার পুত্র আগাশাহী বেশ কয়েক বছর পাকিস্তানের বিদেশমন্ত্রী ছিলেন । স্বামী বিদ্যানন্দ জীর মাধ্যমে‌ তিনি‌ও শুদ্ধি‌ হন এবং আজীবন‌ বৈদিক ধর্ম প্রচারে রত‌ থাকেন ।


    হায়দ্রাবাদ সরকারের নিরঙ্কুশ শাসনের ফলে সেই প্রদেশের নাগরিকের মান-সম্মান এবং ধার্মিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার রক্ষার জন্য ১৯৩৯ সনে আর্যসমাজ সত্যাগ্রহের ঘোষণা দেয় । স্বামী জী তখন D.A.V কলেজে অধ্যাপনায় নিযুক্ত ছিলেন । স্বামী বিদ্যানন্দ জী চাকরী‌ থেকে অব্যাহতি নিয়ে হায়দ্রাবাদ সত্যাগ্রহে অংশ নেন ।

  স্বামী বিদ্যানন্দ জী হোশিয়ারপুর থেকে ১১জন সত্যাগ্রহীদের‌ নিয়ে ক্ষুদ্র একটি দল‌ গঠন করে হায়দ্রাবাদ পাড়ি দেন । যাওয়ার‌ পথে জালন্ধর, লুধিয়ানা, অম্বালা, দিল্লী, আগরা, মুম্বাই এবং পুনায় রাত্রি‌ পার করতে অবস্থান করেন । এসব প্রদেশে অবস্থানকালে বিদ্যানন্দ জী প্রভাবপূর্ণ‌ প্রবচন দেন । এই প্রবচনের‌ প্রভাবে প্রত্যেক‌ প্রদেশ থেকে দুই-চারজন করে ব্যক্তি‌ সত্যাগ্রহে যোগ‌ দেন । সর্বমোট ৬৫ জন সত্যাগ্রহী‌র গঠিত দল‌ নিয়ে স্বামী জী হায়দ্রাবাদে পাড়ি জমান । লুধিয়ানায় প্রাতঃকাল প্রস্থানের সময় বিশাল‌ সংখ্যক স্ত্রীগণ উপস্থিত থেকে সত্যাগ্রহীদের‌ হাতে রাখী পড়িয়ে দেন এবং বিদায় দিতে একত্রিত হন । দিল্লিতে স্বাতন্ত্র্য স্মরের অমর যোদ্ধা ভাই পরমানন্দ, মুম্বাইয়ের জগতগুরু শঙ্করাচার্য তথা পুনার অখিল ভারতীয় হিন্দু মহাসভার অধ্যক্ষ এল.বী. ভোপটকরের অধ্যক্ষতায় স্বামী বিদ্যানন্দ জীর সত্যাগ্রহী দলকে বিদায় দিতে আসেন।‌ 


আর্যসমাজের মূর্ধন্য বিদ্বান এবং শাস্ত্রার্থ মহারথী আচার্য দেবেন্দ্রনাথ জীর কন্যা শকুন্তলাদেবী জীর সাথে ২৪ মে, ১৯৩৯ সনে স্বামী বিদ্যানন্দ জীর বিবাহ স্থির‌ হয় । দেবেন্দ্রনাথ শাস্ত্রী জী বিদ্যানন্দ জীকে হায়দ্রাবাদ সত্যাগ্রহে অংশ‌গ্রহণ থেকে বিরত থাকতে বলেন । তিনি সত্যাগ্রহের‌ প্রধান‌ সঞ্চালক স্বামী স্বতন্ত্রানন্দ জীর মাধ্যমে‌ পত্র প্রেরণ‌ করেন । বিদ্যানন্দ জীকে‌ স্বামী স্বতন্ত্রানন্দ জী পত্রটি দেখান । স্বামী বিদ্যানন্দ জী‌ সত্যাগ্রহ থেকে বিরত‌ নিবেন না জানিয়ে দেন । ফলে বিবাহ অনুষ্ঠান থেমে‌ যায় । কিছুদিন পর আচার্য দেবেন্দ্রনাথ শাস্ত্রী নিজেই আজমের থেকে ৪০০ জন সত্যাগ্রহীর‌ একটি দল‌ নিয়ে হায়দ্রাবাদ সত্যাগ্রহে অংশ‌ নেন । স্বামী বিদ্যানন্দ জীর বিবাহ অনুষ্ঠান সত্যাগ্রহের‌ পরে‌ই সম্পন্ন হয় । ২৬ ডিসেম্বর, ১৯৩৯ সনে বিবাহ অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয় । বিবাহ অনুষ্ঠানে আর্য জগতের প্রসিদ্ধ বিদ্বান পণ্ডিত রামচন্দ্র দেহলবী, পণ্ডিত বুদ্ধদেব বিদ্যালঙ্কার, পণ্ডিত হরিদত্ত শাস্ত্রী জী সপ্ততীর্থ, প্রফেসর ব্যাসদেব জী, পণ্ডিত বিহারী লাল জী শাস্ত্রী এবং ঠাকুর অমর সিংহ জী আদি উপস্থিত ছিলেন ।

১৯৪৪ সনে স্বামী বিদ্যানন্দ জীর একান্ত প্রযত্নে দিল্লির ৩৪ জন আচার্যদের‌ নিয়ে আর্য কেন্দ্রীয় সভা, দিল্লি স্থাপনা করেন । ১৯৫৬ সন পর্যন্ত তিনি এই প্রতিষ্ঠানের মন্ত্রী পদে তথা অনেক বর্ষ‌ পর্যন্ত উপপ্রধান এবং অন্তরঙ্গ সদস্য পদে ছিলেন ।  

১৯৪৭ থেকে ১৯৫২ সন পর্যন্ত তিনি সার্বদেশিক আর্য প্রতিনিধি সভার সংযুক্ত মন্ত্রী পদে ছিলেন । আর্য প্রতিনিধি সভা উত্তরপ্রদেশ, পাঞ্জাব তথা হরিয়াণার অন্তরঙ্গ সভার‌ সদস্য‌ও ছিলেন তিনি ।

প্রায়ঃ ২০ বর্ষ হোশিয়ারপুর তথা পানীপত কলেজে প্রিন্সিপাল পদে নিযুক্ত ছিলেন । ১৯৭২ সনে তিনি পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলো পদে মনোনীত হন । কিছুকাল গুরুকুল বৃন্দাবনের আচার্য‌ও ছিলেন । আর্য প্রতিনিধি সভা, পাঞ্জাবের অন্তর্গত সঞ্চালিত আর্য বিদ্যাপরিষদের‌ও সংস্থাপক ছিলেন ।


আর্যসমাজ কর্তৃক বিভিন্ন আন্দোলনে‌ স্বামীজী অত্যন্ত সক্রিয়‌ এবং কর্মঠভাবে যুক্ত ছিলেন । ১৯৪৪ সনে সত্যার্থপ্রকাশ রক্ষা সমিতি, দিল্লির মন্ত্রী হন । ১৯৪৭ সনে সিন্ধু প্রদেশের‌ মুসলিম লীগ‌ যখন‌ সত্যার্থ‌ প্রকাশের‌ উপর‌ প্রতিবন্ধকতা‌ জারি করে তখন সর্বাপেক্ষা সক্রিয়‌ প্রথম পঞ্চ আন্দোলনকারীর একজন ছিলেন স্বামীজী। ১৯৫৭ সনে পাঞ্জাবে হিন্দী-রক্ষা আন্দোলনের সঞ্চালনার্থ নিযুক্ত কেন্দ্রীয় সংঘর্ষ সমিতি তথা পাঞ্জাব হিন্দী রক্ষা সমিতির সক্রিয় সদস্য ছিলেন তিনি । বিভিন্ন সময়ে চলা আন্দোলনে মুখ্য‌ ভূমিকা পালন করায়‌ স্বামীজী‌ অনেক বার কারাবাস‌ও করেছেন । 


স্বামী জী সংস্কৃত, হিন্দী, ইংরেজি তথা উর্দু ভাষায় বিবিধ বিষয়ে ৬০ এর অধিক পুস্তক প্রণয়ন করেছেন । ফলে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সংস্থা থেকে একের‌ অধিক‌ পুরষ্কারে সম্মানিত হয়েছেন । ১৯৯৭ সনে উদয়পুরের এক সম্মেলনে দেশ-বিদেশের অনেক বিদ্বান‌ এবং মনীষী সম্মিলিত হন। উক্ত সম্মেলনে রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী শ্রী ভৈরোসিংহ শেখাওয়াত স্বামী বিদ্যানন্দ জীকে‌ “সন্ত শিরোমণি” উপাধিতে বিভূষিত করেন এবং ৩১ লাখ রুপি উপহার হিসেবে প্রদান করে সম্মানিত করেন । স্বামী জী এই অর্থ 'ইদং সত্যার্থপ্রকাশায় ইদন্ন মম' উচ্চারণ করে শোধ কার্যে সমর্পণ করেন । ১৯৯০ সনে মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী শ্রী নীলঙ্গেকর জীর অধ্যক্ষতায় ডা. কর্ণসিংহ স্বামী জীকে 'বেদবেদাঙ্গ’ পুরস্কারে সম্মানিত করেন । ১৯৮৫ সনে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রী রাজীব গান্ধী স্বামী জীকে তিনমূর্তি ভবনে আমন্ত্রিত করে উক্ত বর্ষের সর্বশ্রেষ্ঠ দর্শনশাস্ত্রের বিদ্বান্ রুপে পুরস্কৃত করেন । স্বামী জী দ্বারা লিখিত 'তত্ত্বমসি' গ্রন্থ‌ দর্শনশাস্ত্রের শ্রেষ্ঠতম গ্রন্থ হিসেবে ঘোষিত করেছিলেন তৎকালীন মুখ্য-মুখ্য পৌরাণিক বিদ্বানগণ।

৩০শে জানুয়ারি, ২০০৩ সনে স্বামী জী দেহত্যাগ‌ করেন ।


গ্রন্থরাজিঃ


১. স্বরাজ্য‌ দর্শন‌


২. রাজধর্ম


৩. পলিটিক্যাল‌ সাইন্স‌ ( রাজধর্ম‌ গ্রন্থের‌ ইংরেজি অনুবাদ )


৪. অনাদিতত্ত্ব দর্শন


৫. বেদ মীমাংসা 


৬. অধ্যাত্ম মীমাংসা 


৭. ত্যাগবাদ


৮. তত্ত্বমসি 


৯. প্রস্থানত্রয়ী‌ ঔর‌ অদ্বৈত বেদান্ত


১০. সত্যার্থ ভাস্কর


১১. ভূমিকা ভাস্কর


১২. সংস্কার ভাস্কর‌


১৩. দ্বৈত সিদ্ধি‌


১৪. The theory of reality 


১৫. The Age of Shankar


১৬. Vedic Concept of God


১৭. The Brahma Sutras: A New Approach


১৮. আর্য কা আদি দেশ ওর উনকী সভ্যতা


১৯. খট্টী মীঠী য়াদে


২০. তিন ব্রহ্মচারী 


২১. জন্ম-জীবন-মৃত্যু


২২. বিদ্রোহী দয়ানন্দ


২৩. সৃষ্টিসম্বৎ


২৪. দ্রৌপদী কা চীরহরণ‌ ওর শ্রীকৃষ্ণ 


২৫. শঙ্করাচার্য‌ বেদান্তী‌ নহী থে


২৬. ঋষি‌ দয়ানন্দ, মেরী‌ দৃষ্টি মে


২৭. রামায়ণ‌ ভ্রান্তিয়া‌ ঔর‌ সমাধান


২৮. বিবেকানন্দ কী বিচার ধারা


২৯. পরা পূজা


৩০. ১৮৫৭ ঔর স্বামী দয়ানন্দ


৩১. আর্য‌-ধ্বজ 


৩২. On The Vedas


৩৩. আর্য‌ কা আদি দেশ


৩৪. গৌ কী গুহার 


৩৫. সৃষ্টি বিজ্ঞান ঔর বিকাশ বাদ


৩৬. The anatomy of Vedanta 


৩৭.  মূল গীতা মে‌ শ্রী কৃষ্ণার্জুন সংবাদ


৩৮. বেদার্থ ভূমিকা 

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.