আমি 'পরমসহায়ক' নই, বাকিদের মতোই এক সাহায্যকারী মাত্র - মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী
অবিভক্ত ভারতের লাহোরে একবার শ্রী শারদা প্রসাদ আর্যসমাজের সদস্যদের সঙ্গে পরামর্শ করে এক প্রস্তাব আনেন, স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী মহারাজকে সমাজের ‘সংরক্ষক’ বা এমন কোনো মর্যাদাসূচক উপাধি দেওয়া হোক। সভায় উপস্থিত সকলে করতালির মাধ্যমে এই প্রস্তাবের প্রতি তাদের সমর্থন জানান।
এই প্রস্তাবে স্বামীজী মৃদু হেসে বললেন, “এই ‘সংরক্ষক’ শব্দটির মধ্যে যেন একরকম গুরুবাদের গন্ধ পাই। অথচ আমার জীবনের লক্ষ্যই তো গুরুবাদ ও অন্ধ পরম্পরার সমূলোৎপাটন—নিজেই গুরু হয়ে আরেকটি নতুন মতবাদ রচনা করা নয়।”
মহর্ষি আরও বললেন, “ধরুন, ভবিষ্যতে এমন কোনো পদবীর মোহে আমিই যদি পথভ্রষ্ট হই? আর যদি আমি নিজেকে সংযত রাখতে পারি, তাহলেও আমার পরে যে আসবে, সে যদি এমন কিছু করে বসে যা আর্যসমাজের মূল উদ্দেশ্যের বিপরীত, তখন আপনাদের যে কী ভোগান্তি পোহাতে হবে! তখন আর্যসমাজও ঠিক সেই একই সমস্যায় পড়বে, যেগুলো অন্য নতুন মতপন্থীগণ সম্মুখীন হয়েছেন। সুতরাং এমন কোনো প্রস্তাব মোটেও গ্রহণ করা উচিত নয়।”
তখন শ্রী শারদা প্রসাদ বললেন, “তাহলে অন্তত আপনাকে আমরা ‘সমাজের পরম সহায়ক’ উপাধিতে অভিষিক্ত করি? ”
স্বামীজী আবার হেসে বললেন, “আমাকে যদি তোমরা ‘পরম সহায়ক’ বল, তবে সেই জগৎস্রষ্টা, জগদ্গুরু, সর্বশক্তিমান ঈশ্বরকে কী বলবে?"
শেষ পর্যন্ত মহর্ষি শুধু এটুকু বললেন—"আমার নামটি ‘সহায়ক সভ্য’ হিসেবে আর্যসমাজের তালিকায় লিখে রাখো। যেমন অন্যরা সহায়ক, আমিও তেমনই একজন সহায়ক মাত্র।"
পৃথিবীর কোনো প্রান্তেই কখনো দেখা যায়নি যে কেউ ঈশ্বরকে গালি দেওয়ায়, নিন্দা করায়, তাঁকে অস্বীকার করায় ঈশ্বরের মাধ্যমেই প্রাণ হারিয়েছে, জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে কিংবা ফাঁসিতে ঝুলানো হয়েছে। আসল সমস্যা ঈশ্বরে নয়—সমস্যার শিকড় হলো সেই সব মধ্যস্থ ব্যক্তি, যারা নিজেকে ঈশ্বর ও ভক্তের মাঝে নিজেকে ঐশ্বরিক দূত বলে অপরিহার্য করে তুলেছে। ধর্মজগতের (মতবাদের প্রকৃতপক্ষে) যাবতীয় বিরোধ, বিদ্বেষ ও রক্তক্ষয়ী সংঘাতের মূল কারণ হলো এই ‘মধ্যবর্তী ব্যবস্থাপনা’—যেমন দূতবাদ, প্রেরকবাদ, গুরুবাদ। মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী এজন্য বারংবার বলেছেন তিনি বেদ ও তদানুকূল আর্ষ পরম্পরারই একজন পুনর্জাগরণের সহায়ক মাত্র।
পণ্ডিত গঙ্গাপ্রসাদ উপাধ্যায় তাঁর এক অনন্য গভীর উপলব্ধিতে, যা ইতিহাসের সারনির্যাসস্বরূপ, লিখেছেন—
"Much of the bitterness which we find in religious circles is due not to God or His worship but to the mediators, prophets, agents, priests and the like who pretend to have monopolised the benefits of spirituality for themselves or for their followers."
[গ্রন্থ: Vedic Culture, পৃষ্ঠা ৫৩]
অর্থাৎ, মতবাদের জগতে যে তিক্ততা, বিদ্বেষ ও সংঘাত দেখা যায়, তা ঈশ্বর বা তাঁর উপাসনার কারণে নয়—বরং সেই মধ্যস্থাকারীদের জন্য, যারা ভাব প্রকাশ করেন যে, আধ্যাত্মিকতার যাবতীয় কল্যাণ কেবল তাঁরাই বা তাঁর অনুসারীরাই পেতে পারেন, মূল ধর্মগ্রন্থের বাক্য অনুসরণ মাত্রই যথাযথ নয়।
এজন্য সনাতন ধর্মাবলম্বী মাত্রেই ধর্মের প্রকৃত লক্ষণ নিরূপণে সর্বাগ্রে বেদ রেখে তারপর গুরু নির্বাচন করা আবশ্যক।
এই কারণেই ধর্মের নামে বস্তুত মতবাদের বিভাজন, দাঙ্গা ও বিদ্বেষ ছড়িয়ে পড়ে। তাই এসব মিথ্যা গুরুবাদের বিষয়ে বলা হয়,
"গুরু নিজের সঙ্গে শিষ্যদের যুক্ত করেন,
কিন্তু ঈশ্বর থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেন।"
ছবি: শ্রী অর্ণব মণ্ডল
মূল: শ্রী রাজেন্দ্র জিজ্ঞাসু
© বাংলাদেশ অগ্নিবীর