"আর্য সনাতন ধর্ম একদিন বিশ্বধর্ম হয়ে উঠবে।”
— রাজর্ষি শাহু মহারাজের ঐতিহাসিক ভাষণ
১৯২০ সালের ৮ই মার্চ সৌরাষ্ট্রের ভাবনগরে সর্বভারতীয় আর্যসভার (আর্য সমাজ) এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সভার প্রধান অতিথি রাজর্ষি শাহু মহারাজ ভাষণ দেন। তাঁর বক্তব্যে তিনি স্বামী দয়ানন্দ মহারাজের জীবন ও কর্ম বর্ণনা করে বলেন যে, স্বামী দয়ানন্দ পুনঃনির্দেশিত বৈদিক সনাতন ধর্মই দেশকে জাগ্রত করতে সক্ষম, এবং এজন্য এই ধর্মের গুরুত্ব অপরিসীম। তিনি জানান, তিনি নিজে বৈদিক সনাতন ধর্ম আত্মস্থ করেছেন এবং আশীর্বাদ দেন যে এই ধর্ম একদিন বিশ্বধর্ম হয়ে উঠবে।]
সজ্জনবৃন্দ,
আমরা যদি ভারতবর্ষের হাজার বছর আগের ইতিহাসের দিকে তাকাই, তবে আজকের ভারতের সঙ্গে সেই সময়কার ভারতের আকাশ-পাতাল পার্থক্য দেখতে পাব। আজ বীরত্ব, জ্ঞান, ধর্মীয় নিষ্ঠা, উদারতা – সব সদ্গুণ হারিয়ে গিয়েছে। হাজারো কুসংস্কার ও গোঁড়ামিতে আজকের ভারত পরিপূর্ণ। বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, মদ্যপান, নারীশিক্ষার নিষেধ, বর্ণাশ্রমধর্মের অপব্যবস্থা – এসব সমাজকে নিঃসাড় করে তুলেছে।
উদাহরণস্বরূপ, বর্ণব্যবস্থার কথা ধরা যাক। ভারতে বিশেষ করে মহারাষ্ট্রের দক্ষিণাঞ্চলে ব্রাহ্মণবহির্ভূত জাতিগুলোর অবস্থা খুবই শোচনীয়। তাদের অগ্রগতি ও উন্নতির কোনো সুযোগই দেওয়া হয় না। আজ ২০তম শতাব্দীতেও [বর্তমানে একবিংশ শতাব্দী] কিছু মানুষ অচ্ছ্যুত বলে জীবন কাটাচ্ছেন, শুধুমাত্র তাদের জন্ম একটি নির্দিষ্ট জাতিতে হয়নি বলেই। সমাজে আজ কোথাও প্রেম, ঐক্য বা শ্রদ্ধা দেখা যায় না। এর মূলে রয়েছে আমাদের নিজেদের অজ্ঞতা।
ভারতে এমন মানুষও রয়েছেন যারা নিজের ভাইয়ের ছায়া গায়েও পড়তে দেন না। নিজেকে শ্রেষ্ঠ মনে করা এই জাতিবাদী ব্রাহ্মণেরা নিচু জাতির উপর অত্যাচার করে। অথচ প্রাচীন ঋষিরা বলেছিলেন:
“ধর্মচ্যুত ব্যক্তি নিচু বর্ণে গমন করে এবং ধর্মাচরণকারী নিচু বর্ণের ব্যক্তিও উন্নত বর্ণে উত্তীর্ণ হতে পারে।” [ii]
কিন্তু পরবর্তীকালে স্মার্ত-পৌরাণিক ব্যাখ্যায় “ব্রাহ্মণ জন্ম থেকেই ব্রাহ্মণ” – এই মত চালু হয় এবং জাতি ভিত্তিক বৈষম্য গড়ে ওঠে। তদুপরি, “স্ত্রী ও শূদ্রকে পড়তে দেওয়া যাবে না” এই মিথ্যা ধারণাকে “বেদমন্ত্র” [iii] বলে চালিয়ে দেওয়া হয়। ফলত, শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করা হয় নারী ও শূদ্রদের। বহু সময় ধরে এই অবস্থা চলার ফলে শূদ্রেরা নিজেদের অচ্ছুত ভাবতে শুরু করে। এর ফলে ব্রাহ্মণদের সুবিধা হয়, তারা নিজেদের ব্রাহ্মণ্যত্বের ঠিকাদার বলে প্রতিষ্ঠিত করে।
আজকের ব্রাহ্মণদের মধ্যে অনেকেই সাধুতা ও জ্ঞানের অভাবে জন্মসূত্রেই ব্রাহ্মণত্ব দাবি করে। তারা জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সাধারণ মানুষকে শোষণ করে এবং পরলোকগতের ক্ষেত্রেও শ্রাদ্ধ ইত্যাদির নামে ভণ্ডামি বাড়িয়ে তোলে।
সজ্জনবৃন্দ!
যখন ব্রাহ্মণরা জাতির নেতা হয়ে স্বার্থপর হয়ে উঠেছিল, তখন থেকেই জাতীয়তাবোধ লোপ পায়। ঠিক সেই সময়, এই কাঁঠিয়াওয়ার অঞ্চলের মোরবি গ্রামে জন্ম নেন মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী। তিনি কঠোর তপস্যা করে, ভেদাভেদহীনভাবে বেদের প্রচার করেন। জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সত্যপথে মানুষকে ফিরিয়ে আনেন। যদিও তাঁকে অনেক গালমন্দ ও আক্রমণের সম্মুখীন হতে হয়েছে, তবু তিনি বিরত হননি। তাঁর প্রচারের ফলে ব্রাহ্মণরা অস্থির হয়ে ওঠে, তাঁকে থামানোর চেষ্টা করে। কিন্তু ঈশ্বরের আশীর্বাদ থাকলে কেউ রুখতে পারে না। [iv]
মাত্র দশ বছরেই তাঁর প্রচারের ফলে পাঞ্জাব, উত্তর প্রদেশ, রাজপুতানা, লাহোর, মধ্যপ্রদেশ জেগে উঠেছিল। লক্ষ লক্ষ মানুষ তাঁর শিষ্য হয়েছিলেন। উত্তর ভারত তো বটেই, সমগ্র ভারতেই অবৈদিক আচার পরিত্যাগ করে বৈদিক আচার পালন আবার শুরু হয়।
উদাহরণস্বরূপ, শাস্ত্র বলে:
“ব্রহ্মচর্য পালন করে কন্যা উপযুক্ত যুবককে বরণ করুক।” [v] “শূদ্রও ব্রাহ্মণ হতে পারে।” [vi]
আর্য সমাজ জাতিভেদ দূর করে, সামাজিক সমতা ও মানবিক গৌরব প্রতিষ্ঠা করে। বিদেশযাত্রা, যা আগে পাপ বলে বিবেচিত হতো, আজ গর্বের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আর্য ধর্ম পূর্ণরূপে মানবসমাজের কল্যাণের জন্য উৎসর্গিত। উল্লেখযোগ্য যে, অনেক ইউরোপীয় নারী-পুরুষও এই ধর্ম গ্রহণ করেছেন। আমি বিশ্বাস করি, লর্ড কিচনার, স্যার হেগ, লর্ড ফ্রেঞ্চ – এইসব যোদ্ধাদের ক্ষেত্রেও আমরা বলতে পারি তারা আর্য সমাজের আদর্শ পালন করেছেন।
আমার বিশ্বাস, এই ধর্ম শিক্ষার মাধ্যমে প্রেম ও একতা গড়ে তুলবে। রাজা প্রতাপসিংহ, সজ্জনসিংহ প্রমুখ এই ধর্মের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন, যা গর্বের বিষয়। আমরাও তাদের পথ অনুসরণ করব।
আমি রাজারাম কলেজ, হাইস্কুল, গুরুকুল, অনাথ আশ্রম, সরদার বোর্ডিং – সব আর্য প্রসারক সভার হাতে তুলে দিয়েছি, যাতে মানসিক পরিবর্তন সম্ভব হয়। আমি বিশ্বাস করি, মানসিক পরিবর্তনের চাবিকাঠি হলো জ্ঞান, আর সেই জ্ঞানের ধারক আর্য সমাজ।
আমার দায়িত্ব আমি শেষ করেছি। এখন দায়িত্ব আপনারা নিন। যদি এর পরেও আর্য ধর্মের প্রসার না ঘটে, তবে এর দায় আপনি এবং আর্য সমাজের প্রচারকগণ বহন করবেন। আমি চাই, কিছু সৎ কর্মবীর আমার মতো এই কাজে আত্মনিয়োগ করুন।
আজও আমরা বৈদিক-কর্মহীন। কিন্তু ঋষিরা শিক্ষিত সমাজে প্রেরণা দিচ্ছেন। সকল সামাজিক প্রতিষ্ঠান যেন বৈদিক নীতির ভিত্তিতে পরিচালিত হয়।
“যথেমাং বাচং কল্যাণীম্…” এই মন্ত্র [যজু০ ২৬।২] অনুসারে, আর্য সমাজ গুরুকুল, অনাথাশ্রম, কলেজ স্থাপন করে বেদবাণী প্রচার করছে। তবুও অনেকেই এখনও কর্মবীর হয়ে উঠতে পারেনি। এখন আর অলস বসে থাকার সময় নয় – এখন কাজ করার সময়।
আমাদের আচরণ শুরু হওয়া উচিত বৈদিক নিয়ম অনুসারে। আমরা যে গুণ ও কর্ম অনুযায়ী সমাজ গঠনের কথা বলি, তা এখন কাজে প্রমাণ করার সময় এসেছে।
আমি অনেক সময় নিলাম, কিন্তু আপনারা মনোযোগ সহকারে শুনেছেন বলে ধন্যবাদ জানাই। এবং বিনীতভাবে আপনাদের বলতে চাই, যদি সত্যিই মহর্ষি দয়ানন্দের কাজ আপনাদের হৃদয় স্পর্শ করে, তাহলে এই পুণ্যভূমি থেকে যাওয়ার সময় প্রতিজ্ঞা করুন – আমরা বৈদিক আদর্শ ও নীতিকে জীবনে গ্রহণ করব এবং এতে এক বিন্দুও পিছপা হব না।
বন্ধুগণ!
সত্যমেব জয়তে ~ শেষ পর্যন্ত সত্যেরই জয় হয়। এই বিশ্বাস নিয়ে এগিয়ে চলুন, প্রচার করুন ঋষিদের আদর্শ। ঈশ্বর আপনাদের শক্তি দেবেন, কারণ ঈশ্বর সবসময় সত্য কর্মীদের পাশে থাকেন।
- টীকা:
[i] রাজর্ষি শাহু মহারাজ (২৬শে জুন, ১৮৭৪ খ্রি. – ৬ই মে, ১৯২২ খ্রি.) ভোঁসলে বংশের কোহলাপুরের রাজা ছিলেন। তিনি প্রগতিশীল চিন্তাধারার বৈদিকধর্মী শাসক ছিলেন। তিনি স্বামী দयानন্দ সরস্বতীজীকে তাঁর অনুপ্রেরণার উৎস বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি দলিত ছাত্রদের বিদেশে শিক্ষালাভের জন্য বৃত্তি প্রদান করেন।
[ii] বর্ণব্যবস্থা গুণ ও কর্মের উপর ভিত্তি করে ছিল, অথচ জাতিভেদ প্রথা জন্ম ও কুলের উপর নির্ভরশীল। এই বিভাজন জাতিপ্রথা নামক বিষবৃক্ষের জন্ম দিয়েছে। বৈদিক যুগে ‘ব্রাহ্মণ’ পদবাচ্য ছিল এক আদর্শ, জ্ঞানী ব্যক্তির জন্য, যা কালের প্রবাহে বিকৃত হয়ে এক অহঙ্কারী জাতিভেদবাদী ব্যক্তির অর্থে ব্যবহৃত হয়ে অপবিত্র হয়ে যায়।
[iii] চারটি বেদেই কোথাও কোনো মন্ত্রে নারীদের বা শূদ্রদের শিক্ষালাভ থেকে বিরত রাখার কোনো বিধি নেই। সুতরাং এই বেদবিরোধী বক্তব্যকে অসত্য ও মিথ্যা বলে পরিত্যাগ করতে হবে।
[iv] মহর্ষি দয়াनন্দ স্বামী লিখেছেন—
"বেদ পাঠ করার ও শ্রবণ করার অধিকার সকল মানুষেরই আছে। দেখো! গার্গী প্রভৃতি নারী এবং যজুর্বেদের ২৬তম অধ্যায়ের দ্বিতীয় মন্ত্রে স্পষ্টভাবে লিখিত রয়েছে যে—বেদ পাঠ ও শ্রবণের অধিকার মনুষ্যমাত্রের জন্য সংরক্ষিত।"
[v] অথর্ববেদের [১১।৫।১৮] একটি স্পষ্ট বার্তা হলো—ব্রহ্মচর্য পালন করে কন্যা যেন পাত্র গ্রহণ করে। এখানে 'ব্রহ্মচর্য' শব্দের অর্থ হচ্ছে—‘ব্রহ্ম’ অর্থাৎ বেদে ‘চর’ অর্থাৎ গমন, জ্ঞান বা প্রাপ্তি করা; অর্থাৎ বেদজ্ঞান অর্জনের পথ অনুসরণ।
[vi] বেদে শূদ্রদের জন্যও প্রীতিকর বাক্য ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন প্রার্থনায় বলা হয়েছে—“হে পরমাত্মা! আপনি যেন আমাকে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, শূদ্র এবং বৈশ্যদের প্রিয় করে তুলেন।” [অথর্ববেদ ১৯।৬২।১] আরও বলা হয়েছে—“হে পরমাত্মন! আপনি যেন আমাদের রুচি ব্রাহ্মণদের প্রতি, ক্ষত্রিয়দের প্রতি, বৈশ্যদের প্রতি এবং শূদ্রদের প্রতিও উৎপন্ন করেন।” [যজুর্বেদ ১৮।৪৬]
© বাংলাদেশ অগ্নিবীর