ব্যভিচার-বেশ্যাবৃত্তি সম্পর্কে মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী
মহর্ষি শ্রীমৎ দয়ানন্দ সরস্বতী তাঁর আর্যোদ্দেশ্যরত্নমালা গ্রন্থে ব্যভিচারের সংজ্ঞা এভাবে দিয়েছেন -
❝ নিজের স্ত্রী ব্যতীত পরস্ত্রীর সাথে সমাগম করা, স্বীয় স্ত্রীকেও ঋতুকাল ব্যতীত বীর্যদান করা, স্বীয় স্ত্রীর সাথে সহবাসেও বীর্যের অতিশয় নাশ করা তথা যুবাবস্থা ব্যতীত বিবাহ করা – এসকল [আচরণকে] ‘ব্যভিচার’ বলে এবং এগুলো পরিত্যাগ করাকে ‘ব্যভিচার ত্যাগ’ বলে।❞
বৈদিক শাস্ত্রে আমরা ব্যভিচারের বিরুদ্ধে নানা উক্তি পাই । উদাহরণস্বরূপ ~
১. শ্বশুরায় বয় উষো…..শ্নথিতা বৈতসেন [ঋগ্বেদ ১০।৯৫।০৪] = ব্যভিচার দণ্ডনীয়;
২. জহতীষ্বৎকমমানুষীষু মানুষো নিষেবে [ঋগ্বেদ ১০।৯৫।০৮] = শাসক ব্যভিচারী ও নির্যাতনকারীদের থেকে প্রজাদের (নারী ও শিশু) রক্ষা করবেন;
৩. সনাদগ্নে মৃণসি য়াতুধানান্ন ত্বা রক্ষাংসি পৃতনাসু জিগ্যুঃ [সামবেদ ৮০] = পরমাত্মা আমাদের ব্যভিচারের নিমিত্তে আগত অবৈধ কাম নষ্ট করুন;
৪. প্রমিনতী মনুষ্যা য়ুগানি য়োষা জারস্য [ঋগ্বেদ ১।৯২।১১] = ব্যভিচারী নারী পুরুষ নিজেদের আয়ু নাশ করে।
সত্যার্থ প্রকাশের ৪র্থ সমুল্লাসে মনুস্মৃতির ৪।১৫৬,১৬০ ব্যাখ্যার পরবর্তীতে মহর্ষি দয়ানন্দ স্বামী-স্ত্রীর কর্তব্য-অকর্তব্য সম্পর্কে লিখেছেন -
১। ব্যভিচার কখনো না করা
২। ব্যভিচার, বেশ্যাগমন, পরপুরুষগম না করা
৬ষ্ঠ সমুল্লাসে মহর্ষি লিখেছেন,
❝ ব্যভিচার ও বিষয়াসক্তির মতো বল-বুদ্ধিনাশক অন্য কোন কাজ নেই । ❞
'সংস্কারবিধি' গ্রন্থের গৃহস্থাশ্রমপ্রকরণে মনুস্মৃতির ৩।৫৭ শ্লোকের ব্যাখ্যায় মহর্ষি লিখেছেন,
❝যে কুলে নারীরা স্ব স্ব পতির বেশ্যাগমনে বা ব্যভিচারাদি দোষে শোকাতুর থাকে, সেই কুল শীঘ্রই বিনাশ প্রাপ্ত হয় এবং যে কুলে নারীরা পতির সদ্ব্যবহারে প্রসন্না থাকে, সেই কুল সর্বদা উন্নতি লাভ করে । ❞
মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী ছেলেদেকে কামভাব থেকে নিজেকে রক্ষার জন্য তথা কামপরবশ মানবের জন্য ৩টি উপায় দিয়েছেন -
১। একস্থানে স্থির থাকো, কোন নৃত্য বা প্রমত্তোল্লাসে যেও না ।নারীদের দিকে তাকিও না । নিরন্তর অভ্যাসের মাধ্যমে এই স্বভাব লাভ হবে ।
২। দিনরাত প্রণব জপ করো, যখন খুব আলস্য লাগবে ঘুমিয়ে পড়ো, একে সুষুপ্তি নিদ্রা বলে । বেশী ঘুমালে মানবীয় কল্পনায় নানারকম ভ্রম দেখা দিতে পারে । ঘুম থেকে উঠে ভজন শুরু করো ও প্রাতঃকালের শৌচাদি সম্পন্ন করে খেয়ে নাও ।
৩। নিন্দনীয় দৃশ্য দেখবে না, শুনবে না, চিন্তাও করবে না । বরং সব সময় ব্রহ্ম ধ্যানে থাকবে ।
[ মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতীর জীবন চরিত্র, পৃষ্ঠা ৮০ ]
মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী যেসময় জন্মগ্রহণ করেছিলেন তখনকার দিনে অনেকস্থলেই ধনী, উচ্চবিত্তরা প্রকাশ্যে নিজেদের কাছে পতিতা রাখতো । মহর্ষি দৃঢ়ভাবে এই কুব্যসনের খণ্ডন শুরু করেন । স্বামীজীর শিক্ষায় মুগ্ধ হয়ে বহু যুবক ও পরিণত মানুষ এই কর্দমাক্ত পথ থেকে বেরিয়ে এসে বৈদিক সনাতন ধর্মের পথে যাত্রা শুরু করে ।
শেঠ পান্নালালজী ছিলেন স্বামীজীর একনিষ্ঠ ভক্ত । একবার এক প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি তাকে বললেন - "আপনি যদি আমার ছেলেকে স্বামীজীর দ্বারা সংশোধিত করেন তবে আমার প্রতি আপনার অনুগ্রহ মনে করবো ।"
উল্লেখ্য সেই যুবকটি খুবই উশৃঙ্খল ছিল । সে তার নিজের বাড়ি, কৃষিকাজ দেখাশোনা করতো না। সে প্রতিদিন পতিতাদের কাছে ঘোরাঘুরি করতো এবং দিনরাত তাদের কাছেই পড়ে থাকতো ।
পান্নালালজী স্বামীজীর কাছে সেই যুবকের অবস্থা বর্ণনা করলেন এবং তাকে সংশোধন করার জন্য প্রার্থনা করলেন। মহারাজ বললেন, " আপনি তাকে একবার আমার কাছে নিয়ে আসুন । আমি তার পাপপ্রবৃত্তি দূর করব । "
পান্নালালজী দু'জন সদাচারী যুবককে ডেকে বললেন কোনোভাবে সেই অসভ্য বেশ্যাসক্ত যুবককে রাজি করাতে এবং তাকে স্বামীজির কাছে নিয়ে যেতে । এই দুই যুবক বেশ্যাসক্ত যুবককে তিনদিন ধরে বারবার স্বামীজীর সাথে দেখা করতে অনুপ্রাণিত করে স্বামীজীর নিকট নিয়ে আসে এবং বিনম্রভাবে প্রণাম করে সামনে বসে পড়ে ।
মহারাজ স্বীয় প্রেমপূর্ণ চোখের পবিত্র জ্যোতিতে যুবকদের মুখমণ্ডলকে উজ্জ্বল করে উপদেশ দিতে লাগলেন –
“সৌম্য যুবকগণ ! যদিও সকল আসক্তিই খারাপ, কিন্তু বেশ্যাসক্তি সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক। এই আসক্তি মদ পানের আসক্তিকেও সহজে হারিয়ে দেয় । সভ্য পোষাক, সভ্য ভাষা, সভ্য আচার ইত্যাদি গুণ বিনষ্ট হয় । কুলাচারের উপর কঠোর কুঠারাঘাত হয় । দিনরাত আমোদ-প্রমোদে মগ্ন থাকার কারণে আচরণ ও বুদ্ধিমত্তার অভাব দেখা দেয়। এমন আসক্তিগ্রস্ত ব্যক্তি সব সময় ধর্ম থেকে দূরে চলে যায়। বারাঙ্গনা সর্বদা তার বশীভূত ব্যক্তিকে কৃত্রিম প্রেম, কৃত্রিম শব্দ এবং অঙ্গভঙ্গি দিয়ে উত্তেজিত করে, যার কারণে আসক্ত লোকেরা অল্প সময়ের মধ্যে নিস্তেজ ও জীর্ণ হয়ে যায়। বেশ্যার প্রেম স্বার্থপর। যখন স্বার্থ হাসিল হয় না তখন সে জিজ্ঞেসও করে না।
বেশ্যাসক্তের পরিবারে আচার-আচরণে শুদ্ধতা থাকে না। তার বংশ বিনষ্ট হয়। বংশ বিনষ্ট না হলেও তার সন্তানদের পুণ্যবান হওয়া খুবই কঠিন। "
স্বামীজী আরো বললেন - " যুবকগণ ! আমাকে বলো তো বেশ্যাসক্তি থেকে যদি একটি মেয়ে জন্ম নেয়, তবে সেই মেয়েটি কার মেয়ে ? "
যুবকেরা বলল - "সেই বেশ্যাসক্ত পুরুষের।"
তারপর স্বামীজি জিজ্ঞেস করলেন - "সেই মেয়ে যুবতী হয়ে কি কাজ করবে?"
যুবক বলল - "সে আর কি করবে? সে বেশ্যা হয়ে বাজারে বসবে।"
তখন স্বামীজী মর্মস্পর্শী কণ্ঠে বললেন- “দেখো, পৃথিবীর কোনো ভালো মানুষ চায় না যে তার মেয়ে পতিতা হয়ে বাজারে বসুক, কিন্তু বেশ্যাদের প্রতি আসক্ত ব্যক্তি তাদেরই মেয়েদের পতিতা বানায়, চৌরাস্তায় বসায় এবং তারা দ্বারে দ্বারে নাচায় । তোমারা চিন্তা করো এটা কি খুব খারাপ কিছু নয় ? "
এই উপদেশ শুনে কদাচারী যুবকের গায়ের লোম যেন দাঁড়িয়ে গেল। তার বিবেক কেঁপে উঠল নিজের করা পাপকর্মের জন্য । তার সারা শরীরে চাঞ্চল্য ছড়িয়ে পড়ে এবং সে তাঁর সঙ্গী-সাথীদের সাথে বললো,
" স্বামীজী ! আপনার কথা সত্য । প্রকৃতপক্ষে, বেশ্যাসক্তি একটি জঘন্য কাজ । "
সেই নেশাগ্রস্ত যুবক স্বামীজীর পা ছুঁয়ে শপথ নিল যে আজ থেকে আমি পতিতাদের কাছে যাব না এবং যাদের রাখা হয়েছে তাদের ত্যাগ করব।
ভগবৎপাদ মহর্ষি দয়ানন্দ তাকে সাধুবাদ দিয়ে আশীর্বাদ করে বললেন, "সৌম্য ! তোমার জীবন ঈশ্বরের কৃপায় পবিত্র হোক এবং এই সময়ের এই তোমার বুদ্ধি চিরকাল বিদ্যমান থাকুক। "
© বাংলাদেশ অগ্নিবীর