সত্যাসত্যবিবেক - মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী প্রণীত ৩৬টি সিদ্ধান্ত


বরেলীতে ১৮৭৯ সালে আর্যসমাজের প্রবর্তক মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী ও পাদ্রী টী০ জে০ স্কট এর মধ্যে হওয়া শাস্ত্রার্থের বর্ণণনা ‘শাস্ত্রার্থ-বরেলী’ অথবা ‘সত্যাসত্যবিবেক’ নামক গ্রন্থে উল্লেখ আছে । এই শাস্ত্রার্থে তিনটি বিষয় ছিল – 
 
1. পুনর্জন্ম,
2. ঈশ্বর কী দেহ ধারণ করেন ?
3. ঈশ্বর পাপের ক্ষমা করেন ? 
 
এই শাস্ত্রার্থে মহর্ষি দয়ানন্দের দ্বারা প্রদত্ত বক্তব্যে বৈদিক ধর্ম বিষয়ক অনেক তাত্ত্বিক তথা দার্শনিক আলোচনার সমাবেশ পাওয়া যায়। পাঠকগণ যেন এমন কিছু মহত্ত্বপূর্ণ বিষয়ে পরিচয় পেতে পারে এই উদ্দেশ্যে এই সঙ্কলন প্রস্তুত করা হয়েছে - 
 
1. জীব অল্পজ্ঞ, এইজন্য পূর্বজন্মের কথা মনে রাখতে পারে না।
2. শব্দ হচ্ছে গুণ এবং তা কখনো দ্রব্য হতে পারে না।
3. পরমেশ্বর নিজের স্বভাবের বিরুদ্ধ কোন কার্য চরিতার্থ করেন না ।
4. যখন সেই [পরমেশ্বর] সর্বব্যাপক তখন এক দেহে আসা বা এক দেহ থেকে বের হওয়া সর্বদা অসম্ভব।
5. তর্ক, শাস্ত্র, প্রমাণ এবং অনুভব আপ্ত পুরুষেরই সত্য হয়, প্রত্যেক জনসাধারণের নয় ।
6. যে যে জীবে স্বাভাবিক গুণ আছে, তা কখনো ন্যূনাধিক হয়না।
7. জীবের স্বাভাবিক গুণ একরকম থাকে, কিন্তু নৈমিত্তিক গুণ হ্রাস-বৃদ্ধি হয়।
8. জীবের কর্ম ইত্যাদি অনাদি এবং ঈশ্বরের ন্যায় করা ইত্যাদিও অনাদি।
9. ‘ন্যায়’ অর্থ যে ততটুকু যেমন কর্ম করে তাকে ততটুকু তেমন ফল দেওয়া ।
10. বেদ ও বেদানুকূল পুস্তকে কৃতপাপের ক্ষমা করা কোথাও লেখা নেই ।
11. জীবাত্মা ব্যতীত স্থূল, সূক্ষ্ম এবং কারণ শরীরে সুখ-দুঃখের ভোগ করা অসম্ভব।
12. সত্যের বলায় কখনো অশিষ্টতা হতে পারে না । অশিষ্টতা তো মিথ্যার বলার ফলে হয়।
13. যার সাথে যার বিরোধ হয়, সে তার বিষয়ে উল্টা-পাল্টা বলে থাকে।
14. আশাবাদ ছাড়া মানব সংশোধিত হতে পারে না।
15. এটা অত্যন্ত আশ্চর্যের বিষয় যে শুধুমাতে ইংরেজি জানা ব্যক্তি বেদের সিদ্ধান্ত নির্ণয় করে । এই কথা তো এমন, যেন কেউ সংস্কৃত পড়ে ইংরেজির সিদ্ধান্তের নির্ণয় করে ।
16. আমি অদ্বৈতবাদী, কারণ আমি ঈশ্বরকে এক মনে করি... ‘অদ্বৈত’ বিশেষণ পরমেশ্বরের, অন্য কারো নয়। এই কথায় এটা প্রমাণিত হয় পরমেশ্বর এক, জীব অনেক এবং জগতের কারণ অনেক প্রকারের।
17. পরমেশ্বর নিজের স্বাভাবিক গুণের অনুকূল কার্য করার জন্য কখনো ব্যর্থ হন না, কিন্তু অবতার ধারণ করলে ব্যর্থ হতে হয়।
18. সেই [পরমেশ্বর] ন্যায়াধীশ। জীবের যেমন পাপ-পুণ্য হয়, তেমনি ফল দেয়া আবশ্যক, কারণ তিনি বাস্তবিক ন্যায়কারী।
19. পরমেশ্বরের গুণ গতিশীল – এটা সর্বদা মিথ্যা, কারণ তা গুণ, দ্রব্য নয়। গতিশীল দ্রব্য হয়, গুণ নয়।
20. যিনি সর্বব্যাপক তিনি দেহ ধারণ করেন বা ছাড়েন – এটা সর্বদা অসম্ভব। এবং যখন সেই [পরমেশ্বর] সর্বব্যাপক, তখন দেহ ধারণ করার জন্য কোথা থেকে এলেন ? উপর বা নীচে থেকে অথবা বাহির বা কাছে থেকে? যখন বলা হয় কোথাও থেকে এসেছে তবে তো তিনি সর্বব্যাপক না। এবং যদি বলা হয় সর্বব্যাপক, তবে কোথাও থেকে আসা সম্ভব না।
21. যখন [পরমেশ্বর] সর্বব্যাপক তবে তিনি দেহ ধারণ করেননি, কিন্তু তিনি তো সংসারের অণু-অণু ধারণ করে আছেন।
22. যখন পরমেশ্বর সৃষ্টি করেন, তখন নিরাকার স্বরূপ থেকে অথবা সাকার স্বরূপ থেকে? যদি বলে নিরাকার স্বরূপ থেকে, তবে ঠিক আছে; আর যদি বলে দেহধারী হয়ে সৃষ্টি রচনা করেন তবে তা সর্বদা অসম্ভব, কারণ ধূলিকণা আদি পদার্থ সৃষ্টির [উপাদান] কারণ রূপ, তার বশীভূত কখনো হতে পারে না।
23. পরমেশ্বরের পুনর্জন্ম [অবতার] হতে পারে না, করণ তিনি অনন্ত এবং সর্বব্যাপক। তিনি শরীরে আসতে পারেন না, তিনি তো নিত্য মুক্ত । বন্ধনের কাজ কখনো করেন না।
24. যখন জীবের পাপ অধিক এবং পুণ্য কম হয় তাহলে তাকে বানর আদির শরীর ধারণ করা লাগে। এবং যখন পাপ-পুণ্য বরাবর হয় তখন মানুষের। যখন পাপ কম এবং পুণ্য অধিক হয় তখন বিদ্বান্ মানব রূপে পরিগণিত হয়।
25. পরমেশ্বর নিজের গুণ থেকে ‘সগুণ’ অর্থাৎ সর্বজ্ঞ আদি গুণ থেকে; এবং ‘নির্গুণ’ – [উপাদান] কারণের জড় আদি গুণ, তথা জীবের অজ্ঞান, জন্ম, মরণ, ভ্রম আদি গুণ থেকে রহিত হওয়ায় পরমাত্মা ‘নির্গুণ’। এইজন্য এটা নিশ্চয় জানা উচিত যেকোনো পদার্থ এই রীতিতে সগুণতা এবং নির্গুণতা থেকে রহিত নয়।
26. পাপসমূহ ক্ষমা করা তো চার বেদে কোথাও লেখা নেই। যখন কৃতপাপের ক্ষমা করাই ব্যর্থ, তখন এমন মিথ্যা কথার উপদেশ বেদে কী করে থাকতে পারে ?
27. জীব এবং জীবের স্বাভাবিক গুণ, কর্ম এবং স্বভাব অনাদি। আর পরমেশ্বরের ন্যায় করা আদি গুণও অনাদি।
28. যেসকল জীবের পাপ এবং পুণ্য আদি কর্ম প্রবাহ থেকে অনাদি চলে আসছে, তার সঠিক ফল পৌঁছানো ঈশ্বরের কাজ।
29. বারম্বার শরীর ধারণ করাও জীবের আবশ্যক, কারণ ক্রিয়মান কর্ম নতুন করে সঞ্চিত হয় এবং প্রারব্ধও নতুন হতে থাকে।
30. পরমেশ্বর এবং জীব – উভয় অনাদি হওয়ায় বরাবর [অভিন্ন বা সমান] হয় না, যতক্ষণ পর্যন্ত তাঁদের সব গুণ বরাবর না হয়। পরমেশ্বর অনন্ত এবং জীব অনন্ত নয়। পরমেশ্বর সর্বজ্ঞ, জীব অল্পজ্ঞ । পরমেশ্বর সদা পবিত্র এবং মুক্ত তথা জীব কখনো পবিত্র, কখনো বদ্ধ এবং কখনো মুক্ত । এইজন্য উভয় বরাবর হতে পারে না।
31. যদি কর্মের সিদ্ধান্ত না মানা যায় তবে সৃষ্টিতে বুদ্ধিমান্, নির্বুদ্ধি, দরিদ্র, রাজা এবং কাঙ্গালের অবস্থা ঈশ্বর কী প্রকারে করতে পারে ? কারণ এতে পক্ষপাতিত্ব এসে পরে এবং পক্ষপাতের জন্য তার ন্যায়ই নষ্ট হয়ে যায়। যখন কর্মের ফল থাকে তখন পরমেশ্বর পূর্ণ ন্যায়কারী হন, অন্যথা নয়। এবং ঈশ্বর কখনো অন্যায় করেন না।
32. আগুনের সংযোগে জলে উষ্ণতা আসে তা নৈমিত্তিক, এবং আগুনের মধ্যে যে উষ্ণতা বা দাহকতা আছে তা স্বাভাবিক।
33. সত্য তো ঐ গ্রন্থের কথা হতে পারে যাতে আরম্ভ থেকে অন্ত পর্যন্ত একটি কথাও মিথ্যা না; কারণ ঈশ্বরের গুণ-কর্ম-স্বভাবের অনুকূল পুস্তকই বেদ, অন্য কোনটা নয়। বেদের উপদেশ ব্যতিত কোন গ্রন্থে সঠিক সব কথার নিশ্চয়তা নজরে আসে না। এজন্য সবচেয়ে উত্তম বেদরই শিক্ষা, অন্যের নয়।
34. যখন ঈশ্বর সর্বজ্ঞ তখন তাঁর ন্যায় আদি গুণ এবং কর্মও ভূল এবং ভ্রান্তি আদি সব দোষ থেকে রহিত। এজন্য যখন ঈশ্বর নিজের স্বভাবের বিরুদ্ধ কোন কার্য কখনো করতে পারে না তাহলে ন্যায়ের প্রতিকূল ক্ষমা তিনি কীভাবে করতে পারেন ?
35. ঈশ্বর যিনি দয়ালু তার দয়ারও সেই অর্থ হয়, যা ন্যায়ের। ক্ষমা করা দয়া নয়। যেমন এক ডাকাতকে কেউ দয়া করে অর্থাৎ ক্ষমা করে তবে কি তাকে দয়ালু বলা যেতে পারে? কখনো না। কারণ হাজার জীবকে সে দুঃখ দিয়েছে । যখন ডাকাতকে ক্ষমা করে দেয়া হবে তখন তো সে বড়ো সাহসের সাথে আরো ডাকাতি করবে।
36. যা শাস্ত্রার্থের বিষয় এবং যা সিদ্ধ করার প্রতিজ্ঞা প্রথম...করা হয়েছে, তাতে অন্য কথন [করা] ন্যায়-শাস্ত্রের অনুসারে পরাজয়ের সূচক। এই প্রকারের পরাজয়কে দার্শনিক ভাষায় ‘প্রতিজ্ঞান্তর’ বলা হয়। 

© বাংলাদেশ অগ্নিবীর

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.