শাস্ত্রার্থ আয়োজনের সর্বমান্য নিয়ম তথা শাস্ত্রার্থ কলাকৌশলে নিপুণ হওয়ার বীজমন্ত্রসমূহ
তর্কের মাধ্যমে, সত্যাসত্যের বিচারের মাধ্যমে ধর্ম-সিদ্ধান্ত নির্ণয় একমাত্র বৈদিক সনাতন ধর্মই নির্দেশ দিয়েছে । শাস্ত্রার্থ পরম্পরা সনাতন ধর্মের এক অনন্য পরম্পরা ।
শাস্ত্রার্থ তিন প্রকার হয়ে থাকে – বাদ, জল্প এবং বিতণ্ডা
শাস্ত্রার্থের অধ্যক্ষ হতে হবে শ্রোতাগণের উপর প্রভাবকারী এবং সর্বনিয়ম সম্বন্ধে অভিজ্ঞ । শাস্ত্রার্থে জয়-পরাজয়ের নির্ণয় সদা জনতা-শ্রোতাগণের অধিকারে রাখতে হবে । কারণ শাস্ত্রার্থের একটি উদ্দেশ্য জনতার মধ্যে সত্যাসত্য বোধ করানো ।
পক্ষ তথা প্রতিপক্ষের নিয়ম ন্যায়দর্শনে বিশদভাবে বর্ণিত হয়েছে । শাস্ত্রার্থে অসীম পারদর্শী হতে হলে ন্যায়দর্শন হৃদয়াঙ্গম করা অতি আবশ্যক ।
ন্যায়োক্ত শাস্ত্রার্থ প্রক্রিয়া সংক্ষেপে নিম্নে উপস্থাপন করা হল ——
বাদ
" প্রমাণ, তর্ক, সাধনোপালম্ভঃ সিদ্ধান্তাবিরুদ্ধঃ পঞ্চ পঞ্চাবয়বোপপন্নঃ পক্ষ প্রতিপক্ষ পরিগ্রহো বাদঃ।”
[ ন্যায় দর্শন. ১।২।১ ]
অর্থাৎ সঠিক প্রমাণ এবং তর্কের মাধ্যমে স্বীয় পক্ষ স্থাপন করা বিপক্ষীর উপালভ্য (খণ্ডন) করা, সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধ না হওয়া, পঞ্চ অবয়ব দ্বারা যুক্ত পক্ষ এবং প্রতিপক্ষের গ্রহণ করে যে কথোপকথন হয় তা "বাদ" নামে খ্যাত ।
"প্রতিজ্ঞা হেতুদাহরণোপনয়ন, নিগমান্যবয়বাঃ " ॥ [ন্যায় দর্শন. ১।২।৩২]
অর্থাৎ, ১. প্রতিজ্ঞা (সাধ্য) ২. হেতু (সাধনা) ৩. উদাহরণ ৪. উপনয় ৫. নিগমন এই পঞ্চ "অবয়ব" শাস্ত্রার্থ (বাদ) ।
জল্প
"যথোক্তোপপন্নশ্ছল জাতি নিগ্রহ স্থান সাধ্নোপালম্ভে জল্পঃ" । [ন্যায়দর্শন. ১।২।২]
অর্থাৎ প্রতিজ্ঞা আদি দ্বারা যুক্ত ছল জাতি এবং নিগ্রহস্থান দ্বারা খণ্ডন-মণ্ডন "জল্প" ।
“ছল” ? -" বচন বিধাতোঽর্থেপপত্যাছলম্”। [ন্যায়দর্শন. ১।২।৫১]
অর্থাৎ বক্তার ভাব-বিরুদ্ধ কল্পনা করে বক্তার পক্ষে আক্ষেপ করা ছলের অন্তর্গত । বাক্ ছল, উপচার ছল আদি অনেক প্রকার ছল ন্যায় দর্শনে বর্ণিত হয়েছে ।
উদাহরণস্বরূপ, "জাতিঃ " সাধর্ম্য বৈধর্ম্যাভ্যাং প্রত্যবস্থানং জাতিঃ । [ন্যায়দর্শন. ১।২।৫৯]
অর্থাৎ বিবাদ করা এবং সব নিয়মের উপেক্ষা করাকে ‘“জাতি” বলে ।
‘‘নিগ্রহ স্থান”- বিপ্রতিপত্তিরপ্রতিপত্তিশ্চ নিগ্রহ স্থানম্ । [ন্যায়দর্শন. ১।২।৬০]
অর্থাৎ বক্তার মূল বক্তব্যকে বিপরীতভাবে গ্রহণ করা এবং বিবাদ করা “নিগ্রহ" স্থানের অন্তর্গত । জাতি এবং নিগ্রহস্থানের বিবিধ প্রকার বর্ণনা হয়েছে ন্যায় দর্শনে ।
“হেত্বাভাসঃ” ? – যা হেতু হিসেবে গৃহীত হয় পরন্তু সাধ্য এর নিয়ম বহির্ভূত, তা হেত্বাভাস । যথা - "সব্যভিচার, বিরুদ্ধ, প্রকরণসম, সাধ্যসম, কালতীতা হেত্বাভাসঃ"। [ন্যায়দর্শন.১।২।৪৫]
অর্থাৎ সব্যভিচার অর্থাৎ অনৈকান্তিক, অতিব্যাপ্তি, বিরুদ্ধ প্রকরণসম, সাধ্যসম, অতীত কাল এগুলো " হেত্বাভাস" এর অন্তর্গত ।
বিতণ্ডা
"স প্রতিপক্ষস্থাপনা হীনো বিতণ্ডা" । [ন্যায়দর্শন.১।২।৪৪]
অর্থাৎ প্রতিপক্ষ, পক্ষ স্থাপন বিনাই বিবাদ করলে তা বিতণ্ডা ।
শাস্ত্রার্থ দুই প্রকারের – (১) সত্যাসত্য নির্ণয়ের জন্য (২) কেবল জয়-পরাজয়ের জন্য ।
অধ্যক্ষ অধ্যক্ষ অধ
শাস্ত্রার্থে উত্তম অধ্যক্ষ নির্বচন করতে হবে, যার বাকশৈলী জনতার উপর প্রভাব পড়বে, প্রবন্ধে হতে হবে নিপুণ, পক্ষপাত রহিত, পরন্তু তার নির্ণয় করার অধিকার নেই । নির্ণয় তো জনতা-শ্রোতাগণ করবে । জনতাও প্রত্যক্ষ নির্ণয় দিতে পারবে না ।
গ্রন্থ গ্রন্থ
শাস্ত্রার্থ যে বিষয়ে হবে সেই বিষয়ের প্রমাণিক গ্রন্থরাজি সাথে রাখতে হবে ।
প্রমাণ
শাস্ত্রার্থে প্রমাণ সেসব গ্রন্থ থেকে দিতে হবে যা বিপক্ষীরও মান্য এবং নিজের প্রমাণের পক্ষে উচ্চ পর্যায়ের বুদ্ধি এবং প্রবল যুক্তি থাকতে হবে ।
অসঙ্গতি এবং প্রকরণ বিরুদ্ধতা
শাস্ত্রার্থে মুখ্য প্রসঙ্গ দূরে রেখে অন্যদিকে নিয়ে যাওয়া "অসঙ্গতি এবং প্রকরণ বিরুদ্ধতা" এর নির্দশন । এই বিষয়ে অত্যন্ত সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে ।
শাস্ত্রার্থ আয়োজনের সর্বমান্য নিয়ম
১. শাস্ত্রার্থ উভয় পক্ষের মন্তব্য তথা অমন্তব্যের "সত্যাসত্য পরীক্ষা করার জন্য হয়ে থাকে, দু'পক্ষের বক্তার বিদ্যাবত্তা নির্ণয়ের জন্য নয়" । এজন্যে ইহা স্পষ্টভাবে প্রযোজ্য শাস্ত্রার্থ সেই ভাষাতেই করা আবশ্যক যে ভাষা শ্রোতাগণ সরলতার মাধ্যমে বোধগম্যে সমর্থ, ব্যাখ্যান যে ভাষাতে প্রদান করা হয়ে থাকে সেই ভাষাতেই শাস্ত্রার্থ হওয়া আবশ্যক । যে ভাষা দ্বারা নিত্য ব্যাখ্যান হয়ে থাকে, তদ্ব্যতীত শাস্ত্রার্থের আয়োজন ভিন্ন ভাষায় করা অনাবশ্যক, অনুপযুক্ত, অযৌক্তিক এবং দুরাগ্রহ মাত্র ।
সুতরাং যে ভাষাতে সচারচর ব্যাখ্যান দেওয়া হয়, অর্থাৎ যে ভাষা শ্রোতাগণের বোধগম্য, সেই ভাষাতেই শাস্ত্রার্থের আয়োজন হবে । কেননা শাস্ত্রার্থের মূল উদ্দেশ্য'র একটি হলো শ্রোতাগণকে শোনানো, বুঝানো তথা তাদের উপর সত্যাসত্য প্রকট করার জন্য ; শাস্ত্রার্থ কর্তার যোগ্যতা প্রদর্শন করার অথবা তার যোগ্যতার পরীক্ষা নেওয়ার জন্য নয় ।
২. শ্রোতাগণের সমক্ষে শাস্ত্রার্থ কেবল মৌখিকভাবে হতে হবে ।
৩. শাস্ত্রার্থের নির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ করা তথা বক্তাগণের বিষয়ান্তর প্রসঙ্গে চলে যাওয়ার বাধা প্রদানে তথা শ্রোতাগণকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য অধ্যক্ষ নিযুক্ত করা আবশ্যক ।
৪. যে পক্ষ যেসব গ্রন্থকে প্রামাণিক মানে, সেই পক্ষকে সেসব গ্রন্থ থেকে প্রমাণ দিতে হবে ।
৫. একটানা তিন ঘণ্টার অধিক শাস্ত্রার্থ অনুষ্ঠান হওয়া যাবে না, প্রথম ধাপে ১৫-১৫ মিনিট করে তথা পরবর্তী ধাপে ১০-১০ মিনিট করে উভয়পক্ষ সময় নিবে, খুব প্রয়োজন হলে অন্তিম ধাপে ১৫-১৫ মিনিট করে বক্তব্য রাখার সময় নির্ধারণ করতে হবে ।
৬. “অধ্যক্ষ” শাস্ত্রার্থের বিষয়ে কোনো প্রকার কোনো মতামত দিতে পারবে না , অধ্যক্ষ কেবল আবশ্যকতানুসারে ধন্যবাদ তথা সভা প্রারম্ভ তথা সমাপ্তির বচন দিবেন । শ্রোতাগণ যেনো কোনও অসভ্যতা তথা অশিষ্টাচার ব্যবহার না করে, হট্টগোল না করে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে ।
৭. উভয়পক্ষের শাস্ত্রার্থকর্তা পরস্পর সভ্যতার সহিত বাক্য প্রয়োগ ব্যবহার করে এবং ব্যক্তিগত আক্রমণ যেনো না করে ।
৮. উভয়পক্ষের সম্মাননীয় মহানুভাবগণের নাম শিষ্টতা এবং সম্মানের সহিত প্রয়োগ করবে তথা অপমানজনক শব্দ প্রয়োগ থেকে বিরত থাকতে হবে।
শাস্ত্রার্থ কলাকৌশলে নিপুণ হওয়ার বীজমন্ত্র
১. শাস্ত্রার্থের জন্য সদা প্রস্তুত থাকতে হবে । যুদ্ধ আজও হতে পারে কিংবা কয়েক বর্ষ পরেও হতে পারে, পরন্তু সৈনিক সর্বদা যুদ্ধাভ্যাসে রত থাকে, শাস্ত্রার্থীদের স্মরণে রাখতে হবে "অনভ্যাসে বিষং বিদ্যা" ।
২. অনেক তথ্য-উপাত্ত কণ্ঠস্থ রাখতে হবে, গ্রন্থ কেবল প্রমাণের নিমিত্তে সংগ্রহে রাখতে হবে । স্মরণে রাখতে হবে "পুস্তকস্থা যথা বিদ্যা, পরহস্তগতং ধনম্ । কার্য কালে চ সম্প্রাপ্তে, ন সা বিদ্যা ন তদ্ধনম্ ॥”
৩. বিপক্ষীর প্রত্যেক প্রশ্ন-উত্তর-আক্ষেপ বা প্রমাণ নোট করতে হবে, তার বক্তব্য সাবধানে শুনতে হবে এবং পয়েন্ট আকারে নোট করতে হবে ।
৪. অনাবশ্যক কথাগুলো সংক্ষিপ্ত আকারে বলতে হবে, এসবে অধিক সময় নষ্ট করা যাবে না ।
৫. আবশ্যক বিষয় প্রমাণের সহিত অবশ্যই বলতে হবে ।
৬. শাস্ত্রার্থে অধিক-বিস্তার বক্তব্য রাখা সফলে বাঁধা প্রদান করে । অতঃ বিপক্ষী মতের খণ্ডন এবং স্বীয় সিদ্ধান্তের মণ্ডন সংক্ষেপে হতে হবে, পরন্তু অধিক সংক্ষেপ নয় ।
৭. শাস্ত্রার্থ কর্তার নিকট প্রবল যুক্তি এবং প্রমাণের সমুদ্র থাকতে হবে ।
৮. যে বিষয়ে শাস্ত্রার্থের আয়োজন হবে সেই বিষয়ে স্বীয় পক্ষ তথা বিরোধী পক্ষের মান্যতার পক্ষে প্রচুর জ্ঞান রাখতে হবে ।
৯. যখন শাস্ত্রার্থের আয়োজন নির্ধারিত হবে তখন শাস্ত্রার্থের বিষয়ে বিশেষ প্রস্তুতি নিতে হবে ।
১০. স্বীয় সঙ্গীসাথিদের সাথে বিচার-বিনিময় করা, আবশ্যক বিষয় জিজ্ঞাসা করা তথা যে কোনো তথ্য-উপাত্ত নিয়ে আলোচনা করতে কখনও সঙ্কোচবোধ করা যাবে না ।
১১. অতীব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নসমূহ এবং প্রবল যুক্তি তথা প্রমাণ সমূহের সূচি প্রস্তুত করে পয়েন্ট আকারে বা নিজের সুবিধামতো চিহ্ন আকারে ছোট প্যাড বা নোটবুকে লিখিত আকারে রাখতে হবে এবং সেটি নিজের কাছে সর্বদা রাখতে হবে । সাথে যেসব পুস্তক থেকে প্রমাণ নোট করা হয়েছে সেই পুস্তকরাজির প্রমাণ চিহ্ন আকারে, পৃষ্ঠা নাম্বার, প্রকাশনীর নাম লিখে রাখতে হবে ।
১২. শাস্ত্রার্থ কর্তার সহযোগী, যিনি প্রমাণ মূল পুস্তক থেকে বের করবেন তাকে প্রথমে সমস্ত প্রমাণ দেখে নিতে হবে এবং স্মরণে রাখতে হবে ।
১৩. শাস্ত্রার্থে যে গ্রন্থ থেকে প্রমাণ দেওয়া হবে তখন সেই গ্রন্থ সমক্ষে রাখতে হবে । যে গ্রন্থ নিজের কাছে নাই অথবা যে প্রমাণের সঠিক পাতা সম্বন্ধে জ্ঞাত নেই, তার প্রমাণ দেওয়া পরাজয়ের কারণ ।
১৪. শাস্ত্রার্থ কর্তার কোনো অবস্থাতেই ক্রোধান্বিত হওয়া যাবে না ।
১৫. শাস্ত্রার্থ করার জন্য তাকেই নির্ধারণ করতে হবে অথবা তার সাথেই করতে হবে, যার নিকট প্রমাণরাজির সাগর বিদ্যমান, যার নিকট প্রবল যুক্তির বাহুল্য রয়েছে, যার নিকট তাৎকালিক বুদ্ধি-জ্ঞানের প্রাচুর্যতা রয়েছে, যে প্রত্যুৎপন্নমতি, যে স্বীয়পক্ষ তথা বিপক্ষীর মান্যতা সম্বন্ধে প্রবল জ্ঞাত ।
১৬. বক্তার বচন মিষ্ট, শিষ্টাচার বিশিষ্ট, বল, তেজস্বী, চমৎকার, রোচকপূর্ণ, প্রভাবপূর্ণ হতে হবে, খণ্ডন-মণ্ডন তথা প্রশ্ন করার সময় অনেক মনোরঞ্জক বাক্য শৈলীর প্রয়োগের অভ্যাসী হতে হবে ।
১৭. প্রারম্ভিক উপক্রম এবং অন্তিম ধাপের উপসংহার অত্যন্ত প্রভাবোৎপাদক হতে হবে।