শাস্ত্রার্থ মহারথী পণ্ডিত গণপতি শর্মা

 



      শাস্ত্রার্থ মহারথী পণ্ডিত গণপতি শর্মা


ঋষি‌ ভক্ত‌ পণ্ডিত গণপতি শর্মা জীর  জন্ম রাজস্থান প্রদেশে চুরু নামক নগরে শ্রী ভানীরাম বৈদ্য জীর গৃহে‌ ১৮৭৩ সনে ।

পণ্ডিত জী পরাশর গোত্রীয় পারীক ব্রাহ্মণ ছিলেন । তাঁর পিতা পরমেশ্বরের মহান  ভক্ত এবং উপাসক ছিলেন । পণ্ডিত‌ জীর  শিক্ষা সম্পন্ন হয় কানপুর এবং কাশী আদি নগরে । তিনি তাঁর জীবনকালে  প্রথম ২২ বর্ষ সমগ্র‌ সংস্কৃত ব্যাকরণ বাঙ্‌ময় এবং দর্শন শাস্ত্রের‌ বিশদ‌ অধ্যয়ন‌ করেন । শিক্ষা সম্পন্ন করার পর তিনি তাঁর জন্মস্থান‌ চুরু নগরে‌ ফিরে‌ আসেন  । রাজস্থান প্রদেশের সর্বত্র‌‌ মহর্ষি দয়ানন্দ জীর শিষ্য পণ্ডিত কালুরাম জোশী সনাতন বৈদিক ধর্ম প্রচারে মনোনিবেশ  ছিলেন । পণ্ডিত‌ গণপতি‌ জী তাঁর সান্নিধ্যে আসেন এবং বৈদিক সিদ্ধান্ত‌ আর‌ মহর্ষি‌ দয়ানন্দ জীর‌ সাহিত্যের‌ বিশদ‌ অধ্যয়ন‌ করে মহর্ষির‌ ভক্ত হন এবং আর্যসমাজে যোগদান‌ করেন । 


আর্যসমাজে যোগ‌দান করার‌ পর পণ্ডিত গণপতি জী বৈদিক ধর্মের প্রচার-প্রসার‌ তথা‌ আর্যসমাজের প্রচারে মনোনিবেশ করেন ।

১৯০৫ সনে গুরুকুল কাঁগড়ী, হরিদ্বার শিক্ষা সংস্থানের বার্ষিক উৎসবে পণ্ডিত‌ জী অংশগ্রহণ করেন । তৎকালীন  সময়ে গুরুকুল‌ কাঁগড়ী‌ ছিলো সমগ্র অখণ্ড‌ ভারতের‌ অদ্বিতীয় অত্যন্ত প্রভাবশালী এবং স্বনাম‌ধন্য‌ বিদ্যার্জন ক্ষেত্র‌ । গুরুকুল কাঁগড়ীর‌ এই উৎসবে ১৫ সহস্র শ্রোতার‌ সম্মুখে পণ্ডিত জী বৈদিক সিদ্ধান্তের‌ উপর ওজস্বী ব্যাখ্যান দেন । এই প্রভাবশালী  ব্যাখ্যানের পর তিনি তাঁর জীবনের‌ অন্তিমক্ষণ‌ অবধি‌  শীর্ষস্থ আর্য‌ বিদ্বান হিসেবে সম্মানিত‌ হয়েছেন । 

পণ্ডিত‌ গণপতি জীর একটি বিশেষ গুণ‌ এই যে‌,  তিনি যেকোনো সভায় কোনো প্রকার  বৈদ্যুতিক যন্ত্র‌ ব্যতীত‌‌ই ৩০ সহস্র‌ শ্রোতার‌ সমক্ষে‌  ৮ ঘণ্টা‌ অবধি‌ ব্যাখ্যান দিতে‌ সমর্থ‌ ছিলেন । তাঁর বিদ্বতা এবং ব্যাখ্যান কলায় রোচকতার কারণে শ্রোতাগণ‌ তাঁর ব্যাখ্যান শ্রবণ‌ করতো নিরন্তর‌ গতিতে । পণ্ডিত‌ জীর‌ মুখনিঃসৃত একেকটি বাক্য‌ সকল‌ শ্রোতার‌ হৃদয়কে প্রভাবিত এবং আনন্দিত করতো ।  গুরুকুল‌ কাঁগড়ীর‌ সংস্থাপক, প্রসিদ্ধ নেতা, সুধারক এবং  জগৎ‌ বিখ্যাত‌ বিদ্বান‌  স্বামী শ্রদ্ধানন্দ জী পণ্ডিত‌ গণপতি জীর‌ বিষয়ে‌ বর্ণনা‌  করেন, “ সাধারণ‌ জনতা‌  পণ্ডিত গণপতি শর্মা জীর‌ প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা রাখতো তাঁর কেবল মাত্র বিদ্বতা এবং ব্যাখ্যান কলার‌ জন্য নয়, বরং‌ তাঁর শুদ্ধ এবং উচ্চ আচরণ, সেবাভাব এবং চরিত্রের জন্য । ”

১৯০৪ সনে অখণ্ড ভারতের পশ্চিমী পাঞ্জাবের পসরূর নগরে একজন খ্রিষ্টান পাদরি ব্রাণ্ডন একটি সর্ব ধর্ম সম্মেলনের আয়োজন করে । আর্যসমাজের পক্ষ‌ থেকে  এই আয়োজনে অংশগ্রহণ করেন পণ্ডিত গণপতি শর্মা জী । পণ্ডিত জীর অসীম বিদ্বতা এবং সদ্ব্যবহার পাদরি ব্রাণ্ডনের উপর গভীর প্রভাব পড়ে এবং সে পণ্ডিত জীর মিত্র এবং প্রশংসক হয়ে যান‌ । তৎপশ্চাৎ  সেই পাদরি যখ‌ন‌ই কোথাও‌  আয়োজন করতো তখন‌ই আর্যসমাজ মন্দিরে উপস্থিত  হয়ে স্বশরীরে‌ পণ্ডিত‌ গণপতি জীকে আমন্ত্রণ করতো । 


১৯০৪ সনে পণ্ডিত‌ জীর পিতা এবং পত্নী দেহত্যাগ‌ করেন । তাঁর পিতার অন্ত্যেষ্টি সম্পন্ন করার পর তিনি বৈদিক‌ ধর্ম প্রচারের জন্য গৃহ‌ ত্যাগ‌ করেন এবং  জন্মস্থান‌ চুরূ থেকে কুরুক্ষেত্রে চলে আসেন । সেই দিন গুলোতে‌ কুরুক্ষেত্রে  একটি মেলা হচ্ছিলো । এই আয়োজনের প্রসঙ্গে‌ ‘পাওনিয়ার’ নামক পত্রিকায় একজন ইউরোপীয় লেখক বর্ণনা করে, উক্ত‌ মেলায়‌ আর্যসমাজের প্রভাব অন্য মতাবলম্বীদের প্রচার থেকে অধিক ছিলো । এক্ষেত্রেও ছিলো পণ্ডিত‌ গণপতি জীর‌  মহৎ‌ অবদান ।  পণ্ডিত‌ জীর সহধর্মিণীর দেহান্তের‌ পর পণ্ডিত জী তাঁর সমস্ত সম্পদ‌ গুরুকুল মহাবিদ্যালয়, জ্বালাপুরে দান করে দেন ।


পণ্ডিত জী সমগ্র‌ ভারতে পৌরাণিক, ঈসাঈ, মুসলমান এবং শিখ‌ মতাবলম্বীদের সহিত‌ শত-সহস্র‌ শাস্ত্রার্থ করেছেন এবং সমস্ত  শাস্ত্রার্থেই বিজয়ী হয়ে বৈদিক সনাতন ধর্মের সত্যতা সিদ্ধ করেছেন  । 

মহত্ত্বপূর্ণ এবং প্রভাবশালী কিছু শাস্ত্রার্থের সংক্ষিপ্ত‌ বিবরণ নিম্নে‌ বর্ণনা‌ করা হলো –


এক বার গুরুকুল মহাবিদ্যালয়,  জ্বালাপুরের উৎসবে রুড়কী নগরের পাদরি জে. বী. ফকের সহিত পণ্ডিতজীর শাস্ত্রার্থের আয়োজন ‌হয় । যদ্যপি পাদরি পণ্ডিত জীর‌ পক্ষ সমর্থন করতে অসমর্থ, পরন্তু সে পণ্ডিতজীর মধুর ভাষণ, সদ্ ব্যবহার এবং পাণ্ডিত্য দ্বারা  প্রভাবিত হয়ে আজীবন তাঁর মিত্র হয়ে যায় ।

এক বার পণ্ডিতজী কাশ্মীরের রাজধানী শ্রীনগরে অবস্থান করছিলেন । তখন‌ কাশীর‌ অসাধারণ সংস্কৃত ভাষণে দক্ষ পাদরি জনসন শ্রীনগরে‌ আসে । পাদরি কাশ্মীরে অবস্থিত‌ সকল‌ পণ্ডিতকে  শাস্ত্রার্থের জন্য আমন্ত্রণ‌ করে । যখন‌ কোন‌ও পণ্ডিত তার শাস্ত্রার্থের‌ আমন্ত্রণ‌ গ্রহণ‌  না করে তখন কাশ্মীর নরেশকে সেই পাদরি‌ বলে‌ কোনো পণ্ডিত‌ তার‌ সাথে শাস্ত্রার্থ না করলে তাকে বিজয়পত্র প্রদান করতে । তখন কাশ্মীর‌ নরেশ অসহায় হয়ে পড়ে । সেই মূহূর্তে  তিনি জানতে পারেন পণ্ডিত গণপতি শর্মা শ্রীনগরে‌ অবস্থান করছেন । যদ্যপি রাজা কট্টর পৌরাণিক ছিলেন, পরন্তু রাজা‌ পণ্ডিতজীর দ্বারস্থ‌ হয়ে পাদরি জনসনের‌ সাথে শাস্ত্রার্থের অনুরোধ করেন । পাদরি জনসন যখন পণ্ডিত গণপতি জীর নাম শুনলো তখন‌ই ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে বলে, সে শাস্ত্রার্থ কাশ্মীরনিবাসী পণ্ডিতগণের‌ সহিত‌ করতে চায়,অন্য‌ প্রদেশ‌ থেকে আগত পণ্ডিত গণপতি জীর‌ সহিত নয় ।  কিন্তু পাদরির‌ এসব বাহানা কোনো কাজে আসলো‌ না । শাস্ত্রার্থের‌ আয়োজন হল‌ এবং পণ্ডিত‌ গণপতি‌ জী তাকে‌ চূর্ণ-বিচূর্ণ‌ করে দিলেন । পাদরি সংস্কৃত‌ প্রয়োগ‌ বন্ধ‌ করে হিন্দি‌ ভাষা‌ প্রয়োগ‌ করা শুরু করে এবং পরাজিত হয়ে  বিশুদ্ধ পরাজয় পত্র নিয়ে ফিরে যায় । কাশ্মীর নরেশ পণ্ডিত‌ জীকে‌ অনেক সম্মাননায় ভূষিত করেন এবং আপ্যায়ন করেন ।

একবার রোহতক জেলার খাঁড়া গ্রামে জাট জাতিদের‌ যজ্ঞোপবীত দেওয়া শাস্ত্র‌ বিরুদ্ধ‌, এটা প্রচার‌ করতে বহু দক্ষিণা‌ দিয়ে পৌরাণিক  মহাবিদ্বান্‌  মহামহোপাধ্যায় শিবকুমার শাস্ত্রীকে আমন্ত্রণ‌ করা হয় ‌ । এদিকে আর্য সমাজ‌ থেকে পণ্ডিত গণপতি জীকে উক্ত‌ গ্রামে‌ প্রেরণ‌ করা হয় । পণ্ডিত গণপতি জীর‌ উদ্দেশ্য  ছিল জাট জাতিদের‌  যজ্ঞোপবীত প্রদান শাস্ত্র‌ সিদ্ধ‌ করা ।  পণ্ডিত‌ গণপতি জীকে দেখে পৌরাণিক শিবকুমারজী শাস্ত্রার্থ সমরে উপস্থিত‌ হ‌ওয়ার‌ সাহস‌ করে নাই । সে ৮০০ রুপি অগ্রিম প্রাপ্ত দক্ষিণা নিয়ে পুনঃ কাশী ফিরে যান‌  ।

কোটাতে (রাজস্থান)  ২৫শে সেপ্টেম্বর ১৯০৪ সনে  রামপুরা বাজারে সেঠ কম্বরলাল নোহরে'র গৃহে  আর্যসমাজ তথা পৌরাণিকদের মধ্যে‌ বিশাল‌ শাস্ত্রার্থের আয়োজন  হয় । আর্যসমাজের মুখ্য প্রবক্তা ছিলেন পণ্ডিত গণপতি শর্মা তথা পণ্ডিত‌ শিবশঙ্কর শর্মা জী কাব্যতীর্থ ।  কোটা রাজ্যের দী‌ওয়ান চৌবে রঘুনাথদাস বৈষ্ণব মধ্যস্থ হন । পণ্ডিত গণপতি জীর প্রবল‌ এবং অকাট্য যুক্তির খণ্ডন করা প্রতিপক্ষী পৌরাণিক পণ্ডিত আত্মানন্দের জন্য অসম্ভব হয়ে পড়ে ।  অতঃ‌ পৌরাণিক পণ্ডিত দ্রুত‌ সভা‌ হতে প্রস্থান‌ করে । 

ঝালাবাড় নগরে ( রাজস্থান)  ১৪‌ই জানুয়ারি ১৯০৬ সনে  ঝালাবাড় নরেশ জীর‌ মাতামহ মহারাজ বলভদ্র সিংহ জীর‌ অধ্যক্ষতায়‌ আর্যসমাজ এবং পৌরাণিকদের‌ সহিত‌ শাস্ত্রার্থের‌ আয়োজন করা হয় । আর্যসমাজের পক্ষ‌ হতে প্রবক্তা ছিলেন পণ্ডিত‌ গণপতি জী।   বিপক্ষে ছিলেন পৌরাণিক  পণ্ডিত‌  জয়দেব ঝা মীমাংসাচার্য । পৌরাণিক জয়দেব ঝা‌'র পূর্বপক্ষ‌ পণ্ডিত‌ জী তৎক্ষণাৎ বিস্তারিতভাবে সপ্রমাণতার‌ সহিত‌ খণ্ডন করে দেন । নিগ্রহ স্থানে পৌঁছে পৌরাণিক  জয়দেব জী বলেন, “আপনি এটা ভাববেন না যে‌, আমি হেরে‌ গিয়েছি । আগামীকাল  পুনঃ শাস্ত্রার্থ হবে এবং সেই সময়ে পণ্ডিত গণপতি জী‌ যা‌ কিছু বলবেন তা‌ আমি অক্ষরশঃ খণ্ডন করে দিবো । ” প্রত্যুত্তরে‌  প্রত্যুৎপন্নমতি পণ্ডিত গণপতি জী বলেন, “পণ্ডিত জয়দেবজী এক বিচিত্র প্রতিজ্ঞা করেছেন । ধরুন, যদি‌ আমি কোনো প্রসঙ্গে‌ বলে ফেলি‌ পণ্ডিত জয়দেবজী তার মাতা-পিতার সন্তান নয় ।  তাহলে কি এই কথার‌ও অক্ষরশঃ খণ্ডনে পণ্ডিত জয়দেব জী বলবেন তিনি তার মাতা- পিতার‌ সন্তান‌ নয় ? ” শ্রোতা মণ্ডলী এই কথা শোনা মাত্র‌ অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে  ।  তৎক্ষণাৎ পৌরাণিক পণ্ডিত‌ জয়দেব‌ জী সভা‌ ত্যাগ‌ করেন এবং ছয় মাস‌ কাউকে মুখ দেখান না ।

ইটাবা-নিবাসী পণ্ডিত ভীমসেন শর্মা জীর সাথে পণ্ডিত‌ জী‌ এক মহত্ত্বপূর্ণ শাস্ত্রার্থ করেছিলেন। শাস্ত্রার্থটি‌ ঝালাবাড় নগরে‌ অনুষ্ঠিত হয়  ।

 এরূপভাবে মহা বিদ্বান্‌ স্বামী দর্শনানন্দ জীর‌ সহিত পণ্ডিত গণপতি শর্মা জী “বৃক্ষে জীব অবস্থানে‌ বিষয়ে‌ ” প্রসিদ্ধ শাস্ত্রার্থ  করেন ৮/৪/১৯১২ সনে মহাবিদ্যালয় জ্বালাপুরের উৎসবে । 


২৭শে জুন ১৯১২ সনে মাত্র‌ ৩৯ বর্ষ‌ আয়ুতে মহান‌ এই ওজস্বী বক্তা তথা শাস্ত্রার্থ কলার অদ্বিতীয় মহারথী দেহত্যাগ করেন ।



সমগ্র‌ জীবন পণ্ডিত‌ জী বেদ প্রচার‌ এবং অবৈদিক‌ মত খণ্ডনে‌ কাটিয়েছেন ।  এইজন্য তিনি তাঁর জীবদ্দশায়  ‘ঈশ্বর ভক্তি বিষয়ক ব্যাখ্যান ’ নামক একটি পুস্তক‌ রচনা করতে পেরেছিলেন ।  

পণ্ডিত নাথূরাম শঙ্কর শর্মা জী পণ্ডিত জীকে স্মরণ‌ করে কিছু পঙ্‌ক্তি লিখেন  —


“ভারত রত্ন ভারতী কা বড়ভাগী ভক্ত, 

শঙ্কর প্রসিদ্ধ সিদ্ধ সাগর সুমতি কা।

মোহতম হারী জ্ঞান পূষণ প্রতাপশীল, দূধন বিহীন শিরো ভূষণ বিরিতিকা॥

লোকহিতকারী পুণ্য কানন বিহারী বীর, বীর ধর্মধারী অধিকারী শুভগতি কা।

দেখ লো বিচিত্র চিত্র বাঞ্চ লো চরিত্র মিত্র, নাম লো পবিত্র স্বর্গগামী ‘গণপতি’ কা॥”

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.