ঋষি
দয়ানন্দ জীবন - চরিত্রের বিভিন্ন প্রসঙ্গের সংকলন প্রমাণ করার জন্য যথেষ্ট
যে স্বামীজি জন্মসূত্রে জাতিপ্রথার বিরুদ্ধে ছিলেন এবং তিনি তাঁর যুগের
সবচেয়ে শক্তিশালী কণ্ঠে প্রচলিত জাতিপ্রথাকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন।
- হরিদ্বারের কুম্ভ মেলায় পুরুষসূক্তের মন্ত্র নিয়ে আলোচনা
১৮৬৭
খ্রিস্টাব্দে হরিদ্বারের বিখ্যাত কুম্ভ মেলায় অনুষ্ঠিত হয়েছিল। স্বামীজি
হরিদ্বারে পৌঁছলেন। স্বামীজি 'পাখণ্ড খণ্ডনী পতাকা' উড়িয়ে বিপ্লবের
শঙ্খধ্বনি করলেন। মেলায় কাশীর বিখ্যাত পণ্ডিত স্বামী বিশুদ্ধানন্দ
উপস্থিত ছিলেন। তিনি যজুর্বেদের ৩১ তম অধ্যায়ের একাদশ তম মন্ত্র পাঠ করেন -
ব্রাহ্মণোঽস্য মুখমাসীদ্বাহূ রাজন্যঃ কৃতঃ ।
ঊরূ তদস্য যদ্বৈশ্যঃ পদ্ভ্যাং শূদ্রো অজায়ত ॥
ঊরূ তদস্য যদ্বৈশ্যঃ পদ্ভ্যাং শূদ্রো অজায়ত ॥
এর
ব্যাখ্যা করা হয়েছিল যে, ব্রাহ্মণরা পরমেশ্বরের মুখ থেকে, ক্ষত্রিয়রা
বাহু থেকে, বৈশ্যরা উরু থেকে এবং শূদ্ররা পা থেকে উৎপন্ন হয়েছে।
স্বামীজি
তা খণ্ডন করে বললেন, যদি এর অর্থ এই হয় তাহলে মুখ থেকে কফও তৈরি হয়। এর
শুদ্ধ অর্থ দিয়ে তিনি বলেন, ব্রাহ্মণ সমাজের মুখের মতো, ক্ষত্রিয় বাহুর
মতো, বৈশ্য উরুর মতো এবং শূদ্র পায়ের মতো।
-
(পণ্ডিত দেবেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় - মহর্ষি দয়ানন্দের জীবন- চরিত, প্রথম
সংস্করণ ১৯৯০ বি০, আর্য সাহিত্য মন্ডল আজমের, পৃষ্ঠা ১৩৫ -৩৬, ভাগ-১)
বিশেষ-
এই ঘটনাটি স্বামীজির ধর্ম প্রচারের প্রথমদিকের। সেই সময় পর্যন্ত স্বামীজি
অনেক দার্শনিক তথা আদর্শিক বিষয় সম্পূর্ণরূপে নিশ্চয় করতে সক্ষম হননি ।
কিন্তু তাঁর জীবনের এই ঘটনা প্রমাণ করে যে, প্রথম থেকেই স্বামীজি
জন্মগতভাবে নয়, গুণ ও কর্ম অনুসারে বর্ণব্যবস্থা বিশ্বাস করতেন ।
- মাঝির অর্ধেক রুটি খাওয়া
স্বামীজি
হরিদ্বার থেকে কনখল, লটৌরা, শুক্রতাল, মিরাপুর, মুহম্মদপুর, পরীক্ষিতগড়
হয়ে গড়মুক্তেশ্বরে পৌঁছেছিলেন। এখানে তিন দিন না খেয়ে থেকেছেন। কারণ
তখনকার দিনে স্বামীজির নিয়ম ছিল যে, তিনি কারো কাছে কিছু চাইতেন না, যে
তাকে কিছু দিতেন, তিনি শুধু তাই খেতেন। তিন দিন পর মাঝি (নৌকা চালনাকারী )
তার অর্ধেক রুটি ছিড়ে তাঁকে দিয়ে দিলেন এবং তিনি শুধু সেইটুকুই খেয়ে
রইলেন।
- (ম০ দ০ এর জীবন- চরিত্র, পৃষ্ঠা ১৩৭- ১৩৮, ভাগ-১)
- সাধের বাড়ির ভাত খাওয়া
একদিন
সুখবাসীলাল সাধ স্বামীজির জন্য তরকারি ও ভাত নিয়ে এলেন এবং স্বামীজি তা
খেলেন। এতে তথাকথিত ব্রাহ্মণরা বললেন, আপনি সাধের বাড়ির খাবার খেয়ে
কলুষিত হয়ে গেছেন। মহারাজ উত্তরে বললেন, খাবার দুভাবে নষ্ট হয়,
প্রথমত, কাউকে দুঃখ দিয়ে এবং তা থেকে অর্থ আয় করে সেটা দিয়ে অন্নাদি ক্রয় করলে,
দ্বিতীয়ত খাবার নোংরা হয়ে গেলে বা তাতে কিছু নোংরা জিনিস পড়ে গেলে।
সাধ লোকদের কষ্টার্জিত অর্থ, তা থেকে প্রাপ্ত খাদ্যই উত্তম। অতঃপর ব্রাহ্মণরা বাকরুদ্ধ হয়ে রইলেন।
- (১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দ, ফররুখাবাদ, পৃষ্ঠা ১৬৯, ভাগ - ১)
টিপ্পনী-
সাধ একটি সম্প্রদায়, ফররুখাবাদে তাদের অধিক পাওয়া যায়। তারা ঈশ্বরকে
নিরাকার মনে করে, হিন্দুদের মতো আচার-অনুষ্ঠান করে না। তারা মৃতকে পোড়ায়,
কিন্তু পরিবারে মৃত্যু হলে কাঁদে না ,পীড়িত হয় না। তারা গানবাজনা করতে
করতে লাশ শ্মশানে নিয়ে যায়। - দেবেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়
- নাপিতের রুটি
একদিন
একজন নাপিত স্বামীজির জন্য তার বাড়ি থেকে খাবার নিয়ে এসে তাকে অনুরোধ
করে বললেন "আজ আমার ভিক্ষা গ্রহণ করুন"। স্বামীজি সানন্দে তা গ্রহণ করলেন।
উপস্থিত লোকেরা বলতে লাগল " মহারাজ এটি তো নাপিতের দেয়া রুটি"। তেজস্বী
ভঙ্গিতে মহর্ষি উত্তর দিলেন, "এটা নাপিতের রুটি নয়, এটা গমের রুটি " এবং
পরম ভালোবাসায় সেটি গ্রহণ করলেন।
- (১৮৭০ খ্রিস্টাব্দ, অনূপশহর, পৃষ্ঠা ২৩৯, ভাগ - ১)
- ভুট্টার রুটি
“স্বামীজির
জন্য তার ক্ষত্রিয় শিষ্যদের কাছ থেকে প্রায়ই খাবার আসতেন। একদিন মহারাজ
একটি চত্ত্বরে বসে ছিলেন। তার জন্য তখনও খাবার আসেনি। এক কৃষক ভুট্টার মোটা
মোটা রুটি নিয়ে বাড়ি থেকে আসছিলেন। যখন তিনি চত্ত্বরে পৌঁছলেন তখন তার
রুটি মহারাজের সেবায় উৎসর্গ করার ইচ্ছা জাগলো। তিনি বিনীতভাবে প্রণাম
করলেন এবং অনুরোধ করলেন যে, মহারাজ আজ আমার শুকনো মোটা রুটি খেয়ে আমাকে
কৃপা করুন। মহারাজ কৃপাপূর্বক তার প্রার্থনা গ্রহণ করলেন এবং অত্যন্ত
আনন্দের সাথে তার খাবার গ্রহণ করলেন। কৃষকের মন প্রফুল্ল হয়ে উঠল এবং তার
চোখ প্রেমের জলে ভরে উঠল।"
- (১৮৭০ খ্রিস্টাব্দ, ছলেসর, পৃষ্ঠা ২৪২, ভাগ- ১)
- কার হাতে খাওয়া যাবে এই নিয়ে পাদ্রী লালবিহারী দের সাথে কথোপকথন
১৮৭২
সালের এপ্রিল মাসে স্বামীজি বাংলায় যাওয়ার সময় মুঘলসরায় অবস্থান করেন।
সেখানে তিনি ১০ দিন অবস্থান করেন। একদিন কলকাতার বিখ্যাত পাদ্রী লালবিহারী
দে স্বামীজির সঙ্গে দেখা করতে আসেন এবং ধর্ম বিষয়ে স্বামীজির সঙ্গে কথা
বলেন। এই কথোপকথনে, প্রকৃতি-বিষয় সম্পর্কিত কথোপকথনটি নিম্নরূপ হয়েছিল-
পাদ্রী- আপনি কি আমাদের হাতের খাবার খেতে পারবেন?
দয়ানন্দ
- আপনি কেন, যদি আপনার চেয়ে নিচু কোনো লোক থাকে এবং তার হাতের খাবার
খাওয়ার যদি রুচি হয় তাহলে আমি তার হাতের খাবার খেতে পারি।
- (পৃষ্ঠা ২৪৪- ২৪৫, ভাগ- ১)
- বর্ণ কর্মের উপর নির্ভরশীল, রন্ধন কর্ম হলো শূদ্রের কর্ম
মি.এইচ.ডব্লিউ
আলেকজান্ডারের এর সাথে আরায় স্বামীজির কথোপকথন হয়। বাবু রজনীকান্ত
স্বামীজির সংস্কৃত কথাবার্তা ইংরেজিতে অনুবাদ করতেন। প্রকৃত প্রেক্ষাপট
সম্পর্কিত কথোপকথনের অংশ-
“এরপর
হিন্দুদের রীতিনীতি ও সমাজ ব্যবস্থা নিয়ে অনেক কথাবার্তা হয়। বর্ণ
বৈষম্য সম্পর্কে স্বামীজি বলেছিলেন যে বর্ণ কর্ম এবং চরিত্রের উপর নির্ভর
করে। এ প্রসঙ্গে স্বামীজি আরও বলেন যে, আগে ব্রাহ্মণরা পাচকের কাজ করত না,
রন্ধনকর্ম হলো সেবার কাজ আর সেবা হলো শূদ্রের কাজ, প্রাচীন যুগে শুধু
শূদ্ররাই রান্নার কাজ করতো। পরে পুরাণ নির্মাতারা এই প্রথাকে উল্টে দিয়ে
অনিষ্ট করেছে। "
- (সেপ্টেম্বর ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দ, পৃষ্ঠা ২৪৯)
- জাতিভেদ ও বর্ণ নিয়ে প্রশ্নোত্তর ও সংজ্ঞায়ন
কলকাতার
আদি ব্রাহ্ম সমাজের বিখ্যাত প্রচারক পণ্ডিত হেমচন্দ্র চক্রবর্তী একদিন
স্বামীজির কাছে এসে তাঁকে নিম্নলিখিত প্রশ্নগুলি করলেন।
“প্রশ্ন- জাতিভেদ আছে নাকি?
উত্তর- জাতিভেদ আছে, যেমন মানব জাতি, পশু জাতি, পক্ষী জাতি।
স্বামীজির
এই উত্তর শুনে চক্রবর্তী মহোদয় চুপ হয়ে গেলেন পরবর্তীতে স্বামীজি বললেন,
'আপনি সম্ভবত বর্ণভেদ বোঝাচ্ছেন। চক্রবর্তী বললেন- 'হ্যাঁ'।
এই
বিষয়ে স্বামীজী বললেন- পার্থক্য আছে, যারা বেদজ্ঞ ও পণ্ডিত তারা
ব্রাহ্মণ, যারা যুদ্ধ করে এবং জ্ঞানী তারা ক্ষত্রিয়, যারা ব্যবসা করে তারা
বৈশ্য এবং যারা মূর্খ তারা শূদ্র, যারা মহামূর্খ তারা অতিশূদ্র।
- (১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দ, পৃষ্ঠা ২৫৭-২৫৮)
- বর্তমান জন্মগত বর্ণভেদকে অস্বীকার
কলকাতায়
অবস্থানকালে (১৮৭২ সালের ডিসেম্বর থেকে ১৮৭৩ সালের এপ্রিল পর্যন্ত)
ব্রাহ্মসমাজের পত্রিকা (কলকাতা) স্বামীজির বক্তব্যের উপর মন্তব্য করেছে।
সেই মন্তব্যের উদ্ধৃতি- "তিনি জাত-ভেদ মানেন না, তিনি জ্ঞান ও ধর্মের
সামঞ্জস্য অনুসারে বর্ণ-ভেদ বা মর্যাদা-ভেদ গ্রহণ করেন।"
- (পৃষ্ঠা ২৬৫)
- বর্ণ পরিবর্তনে মনুস্মৃতির প্রমাণ
মানব জাতির মধ্যে কোন পার্থক্য নেই।
শূদ্রো ব্রাহ্মণতামেতি ব্রাহ্মণশ্চৈতি শূদ্রতাম্।
ক্ষত্রিয়াজ্জাতমেবং তু বিদ্যাবৈশ্যাত্তথৈব চ।।
"কর্মের
দ্বারা ব্রাহ্মণ শূদ্র হয় এবং শূদ্র ব্রাহ্মণ হয় এটিই পুরানো রীতি। যদি
কোন [তথাকথিত] ব্রাহ্মণ দুশ্চরিত্র, মূর্খ এবং ধর্মহীন হয় তবে তাকে শূদ্র
করা উচিত এবং যদি একজন [তথাকথিত] শূদ্র জ্ঞানী, সচ্চরিত্র এবং ধার্মিক হয়
তবে তাকে ব্রাহ্মণ করা উচিত।
- (পৃষ্ঠা ২৬৬)
- হুগলিতে জন্মগত বর্ণবাদের বিরুদ্ধে বক্তৃতা
স্বামীজি
হুগলিতে বর্ণবৈষম্য নিয়ে বক্তৃতা দেন। তিনি বলেছিলেন- "আজকাল ভারতে শুধু
ব্রাহ্মণ শ্রেণীকেই পাঁচনের কাজ করতে দেখা যায়, প্রাচীনকালে এমনটা ছিল না।
ব্রাহ্মণের কাজ রান্না করা নয়। যদি তাই হতো তবে অজ্ঞাতবাসের সময়
বিরাট-ভবনের প্রধান রাঁধুনী ভীম কিভাবে হলেন? এই কথাটি নেই যে প্রাচীনকালে
বর্ণ জন্মগত ছিল না। জন্মগত তো ছিল, কিন্তু নিম্নবর্ণের ব্যক্তিরা গুণ,
কর্মের মাধ্যমে উচ্চতর এবং উচ্চবর্ণের ব্যক্তিরা তাদের কর্মদোষে নিম্নতর
হয়ে গিয়েছিল।"
বাবু
অক্ষয়চন্দ্র সরকার স্বামীজির কাছাকাছি বসে ছিলেন। স্বামীজি তার দিকে আঙুল
দেখিয়ে বললেন, "যদি প্রাচীনকাল হতো, তাহলে এই বিনয়ী, ভদ্র, গুণী বাবু
অবশ্যই ব্রাহ্মণ হয়ে যেতেন।"
- (পৃষ্ঠা ২৭৫- ২৭৬)
- অস্পৃশ্যতার কলঙ্কে অবিশ্বাস
ঠাকুর
প্রসাদ নামে একজন ছিলেন যিনি স্বামীজির পরম ভক্ত। তিনি প্রতিদিন স্বামীজির
জন্য বাড়ি থেকে খাবার নিয়ে আসতেন। প্রথম দিন খালি পায়ে খাবার নিয়ে
আসলে মহারাজ এর কারণ জিজ্ঞেস করলেন। তিনি বলেন, জুতা পরে খাবার আনা ভালো
নয়। স্বামীজি বলেছিলেন যে, "আমি এই অস্পৃশ্যতায় বিশ্বাস করি না, আপনিও এই
ফাঁদে পা দেবেন না।"
- (প্রয়াগ, সংবত্ ১৯৩১, পৃষ্ঠা ৩১৭)
- গরীব বিদ্যার্থীর প্রতি দয়া
লালা
বংশীধর রামায়ণ ছাপিয়ে গরীব বিদ্যার্থীদের মধ্যে বিতরণের ব্যবস্থা
করেছিলেন। তিনি এই কাজটি একজন পণ্ডিতকে দিয়েছিলেন। তবে তিনি শুধু
পরিচিতদেরই বই দিতেন। একদিন এক দরিদ্র বিদ্যার্থী মহারাজের কাছে এসে
কান্নাকাটি করে বলল, "আমি বারংবার অনুরোধ করেও বইটি পাইনি" । মহারাজ
তৎক্ষণাৎ উঠে দাতার কাছে গেলেন। দরিদ্র বিদ্যার্থীকে বইটি দিয়েছিলেন এবং
দাতাকে সেই কাজটি এমন একজনকে দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন যে বই বিতরণে
পক্ষপাতিত্ব দেখায় না।
- (প্রয়াগ, সংবত ১৯৩১, পৃষ্ঠা ৩১৭)
- নিজের নয়; দুঃখী, গরিব এবং দরিদ্রের মুক্তির চিন্তা
"একদিন
এক গরিব বৃদ্ধ মহাত্মা যিনি গঙ্গার তীরে থাকতেন। তিনি মহারাজকে বললেন,
আপনি যদি পরোপকারে ঝগড়ায় না জড়াতেন, তাহলে এই জন্মেই আপনি মুক্তি পেতেন।
মহারাজ
উত্তরে বললেন, আমি আমার মুক্তির জন্য চিন্তিত নই। আমি সেই লাখ লাখ মানুষের
মুক্তির বিষয়ে উদ্বিগ্ন যারা দুঃখী, গরিব এবং দরিদ্র।"
—(প্রয়াগ, সংবৎ ১৯৩১, পৃষ্ঠা ৩১৭)
- বর্ণ ব্যবস্থা সম্পর্কে স্বামীজির মন্তব্য- বর্ণনা
সংবত
১৯৩১ সালে স্বামীজি আশ্বিন মাসে নাসিকে গিয়েছিলেন। নাসিকে, সাব-জজ রায়
বাহাদুর বিষ্ণু মোরেশ্বর ভিডের বাসভবনে, স্বামীজির সঙ্গে পণ্ডিতদের
শাস্ত্রার্থের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এ প্রসঙ্গে বোম্বাইয়ের সংবাদপত্র
'ইন্দু প্রকাশ' লিখেছে -
"যে
অর্থে 'জাতি' শব্দটি সাধারণত গৃহীত হয় আদৌ এর অর্থে সেভাবে গৃহীত হয় না।
বর্ণ সম্বন্ধে তাঁর অভিমত বেদের উপর নির্ভরশীল বলে বর্ণনা করেছেন যে, বর্ণ
হলো মানুষকে তাদের মানসিক ও আধ্যাত্মিক যোগ্যতা অনুযায়ী বিভক্ত করার নাম।
একজন শূদ্র যদি যথেষ্ট জ্ঞানী হয় তবে সে একজন ব্রাহ্মণ এবং একজন পাপী
ব্রাহ্মণ শূদ্রের চেয়ে নিম্ন বর্ণের। তার মতে, বর্ণ একটি পরিস্থিতির নাম,
যা একজন মানুষ হারাতে পারে যদি সে স্থির ও দ্ব্যর্থহীন নিয়ম অনুসরণ না
করে। পুরো নিয়ম অনুসরণ করার পরই তা প্রাপ্ত করা যেতে পারে।"
- (পৃষ্ঠা ৩১৯- ৩২০)
- আহমেদাবাদে স্বামীজির অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে অবস্থানের প্রভাব
স্বামীজি
১৮৭৪ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে (১৯৩১ বিক্রমী) আহমেদাবাদে ছিলেন। ১৮৭৫
সালের ৭ ই জানুয়ারির 'হিতেচ্ছু' পত্রে একজন লেখক লিখেছিলেন -
"সংস্কৃত
সাহিত্যে পণ্ডিত দয়ানন্দের জ্ঞান যে অত্যন্ত বিস্তৃত তাতে কোন সন্দেহ
নেই। মূর্তিপূজাকে আশ্রয় করে লোভময় এবং অসদ্ভাবপূর্ণ সংস্থা যারা ধর্মের
নামে সাধারণ মানুষদের ভিক্ষুক বানায়, বাল্যবিবাহের কুপ্রভাব, জাতপাতের
বৈষম্য ইত্যাদির কুফল ও ত্রুটি সম্পর্কে তাঁর অকপট বর্ণনা চিরকাল তাদের
হৃদয়ে অঙ্কিত হয়ে থাকবে, যারা তার বক্তৃতা শোনার সৌভাগ্য লাভ করেছেন।
নিঃসন্দেহে পণ্ডিত দয়ানন্দজী এমন ব্যক্তি ছিলেন যে, যাকে বর্তমান হিন্দুদের
অধঃপতিত অবস্থার জন্য প্রয়োজনীয়। আমি নিশ্চিত যে তার মতো বহু মানুষ যদি
সারাদেশে সত্য ধর্ম প্রচার করে এবং খাদ্য, পান, স্থান, ব্রত সম্পর্কে মূর্খ
চিন্তা-ভাবনাকে যারা এই ধর্মের অঙ্গ মনে করে তাদের খণ্ডন করলে ভারতবর্ষের
অবস্থা এইরকম হতো না, অর্থাৎ নির্বল শরীর ও নির্বল বুদ্ধির অধিকারী মনুষ্য
জাতি থাকতো না।"
- (পৃষ্ঠা ৩৫১-৩৫২)
স্বামীজীর বক্তব্যের সারসংক্ষেপ
২১ই জানুয়ারি ১৮৭৫ সালে, স্বামীজি রাজকোট থেকে আহমেদাবাদে পৌঁছালো এবং আমেদাবাদ এসে খুব সুন্দর বক্তৃতা দিলেন, যার সারসংক্ষেপ হলো-
"আর্যদের
অন্তর্দ্বন্দ্ব তথাকথিত ব্রাহ্মণদের সাথে এর কারণ তারা নিজ স্বার্থের জন্য
বাকিদের বেদ পড়াই নেই, আমাদের ধর্মকে এত খণ্ডবিখণ্ড করেছে যে এখন জানা
কঠিন হয়ে গেছে যে কোনটি সঠিক ?
ফলে
লোকেরা ভুলে মূর্তির সামনে মাথা নত করতে শুরু করে, এই ভেবে যে ব্রাহ্মণরা
মন্ত্রের মাধ্যমে দেবতাদের প্রাণঃপ্রতিষ্ঠা করে এবং তার মধ্যে সত্য ঈশ্বর
বাস করে ভেবে লোক তাদের মাথা নত করা শুরু করতে লাগলো। একমাত্র তারাই তাদের
কাজে সফল, যারা বিশ্বাস করে ঈশ্বর এক, অনাদি, অজর, অমর, নিরাকার। তারা
তাদের ধর্মের প্রসারের পদ্ধতি ছড়িয়ে দেয়, তাদের মন একে অপরের সাথে মিশে
যায়, পারস্পরিক ভালোবাসা বৃদ্ধি পায় এবং ধর্মের গৌরব আসে। তারা একে অপরকে
সম্ভাব্য সব উপায়ে সাহায্য করে। দেখুন অগ্রজ ভারতের দিকে এবং বিশ্বের
অন্যান্য দেশের দিকে কারা কতটা শক্তিশালী। এর কারণ হলো তাদের মনের মিলন
এবং তাদের এক সম্প্রদায় হওয়া।"
- (পৃষ্ঠা ৩৫৮)
- স্বামীজীর জয় ও জন্মগত বর্ণবাদী শাস্ত্রীদের বিরুদ্ধে রায়
বেদার্থের
উপর আলোচনার পর, শাস্ত্রীরা স্বামীজির সাথে মূর্তি পূজা এবং বর্ণাশ্রম
নিয়ে আলোচনা করেন। শাস্ত্রীদের মধ্যে ভোলানাথ সারাভাই এবং অম্বালাল
সাগরমলকে মধ্যস্থতাকারী হিসাবে নিযুক্ত করা হলো। আলোচনা শেষে মধ্যস্থকারীরা
স্বামীজির পক্ষে সম্মতি জানায় এবং শাস্ত্রীদের বিরুদ্ধে মতামত দেয়। শেষে
সকলে স্বামীজিকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন এবং তার বক্তৃতায় সন্তুষ্ট হয়ে
গোপালরাও হরি দেশমুখ একটি সুন্দর পীতাম্বর উপহার দেন।
- (পৃষ্ঠা ৩৬০)
- শূদ্রদের উপস্থিতিতে মহর্ষির বেদপাঠ
সংবত্
১৯৩২ সালে (১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দ) মুম্বাইতে স্বামী দয়ানন্দের সাথে পণ্ডিত
কমলনয়নাচার্যের 'মূর্তিপূজা বেদানুমোদিত নয় ' - এই বিষয়ে বিতর্ক হওয়ার কথা
ছিল। স্বামীজী বেদ মন্ত্র পাঠ করার সাথে সাথে - "পণ্ডিত কমলনয়নাচার্য বলল,
শূদ্ররাও উপস্থিত থাকে এমন সমাবেশে বেদ মন্ত্র পাঠ করা শাস্ত্রে নিষেধ,
তৎক্ষণাৎ তিনি সমাবেশ ত্যাগ করলেন। উপস্থিত লোকেরা তাকে অনেক বাধা দেওয়ার
চেষ্টা করলেন কিন্তু তিনি থামেননি। এ সময় কিছু লোক তাকে নিয়ে উপহাস সূচক
কথাও বলে।
- (পৃষ্ঠা ৩৮২, ভাগ - ১)
- জন্মগ বর্ণবাদ খণ্ডন ও সবার বেদাধিকার দেওয়াতে পৌরাণিকদের তাণ্ডব
যেখানে
তিনি একা এবং সেইসব লোক, যাদের জ্ঞানচক্ষু কিছুটা উত্তলিত হয়েছে তারা
ভক্তি ও শ্রদ্ধার সাথে মহারাজের বক্তৃতা শুনতেন, অন্যদিকে পৌরাণিকদল তার
বক্তৃতা শুনে অত্যন্ত বিরক্ত ও উত্তেজিত ছিল। জন্মগতভাবে বর্ণবৈষম্যের উপর
তার অনির্ভরশীলতা, সকলকে সমানভাবে বেদাধিকার দেয়া, মূর্তিপূজাকে বেদের
বিরুদ্ধে আখ্যায়িত করা ইত্যাদির জন্য পৌরাণিকরা প্রচণ্ড বিরক্ত হয়ে গেলো
যে তারা বিভিন্ন উক্ত সভায় তাণ্ডব শুরু করলো এবং ষড়যন্ত্র করার জন্য
নেমেছিল।
- (পুনা, ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দ, পৃষ্ঠা ৩৮৫, ভাগ - ১)
- গুণ-কর্মগত বর্ণের উপর মনুস্মৃতির প্রমাণ ও প্রক্ষিপ্তবাদ
একদিন
স্বামীজি প্রচার করছিলেন যে বর্ণভেদ গুণের উপর ভিত্তি করে, জন্মের উপর নয়
এবং তার বক্তব্যের সমর্থনে মনুস্মৃতির কিছু শ্লোক পাঠ করছিলেন। এক ব্যক্তি
বললেন যে মনুস্মৃতির অন্যান্য শ্লোকও এর বিরুদ্ধে। স্বামীজি উত্তর দিলেন
সেই শ্লোক প্রক্ষিপ্ত।
- (সাতারা, ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দ, পৃষ্ঠা ৩৯৩, ভাগ- ১)
- মহর্ষি শূদ্রের সামনে বেদপাঠ করায় শাস্ত্রীরা কানে আঙুল দিলেন
১৮৭৬
সালে, বড়ৌদায় স্বামীজির বক্তৃতার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। প্রথম বক্তৃতা
ছিল দেশোন্নতি এবং দ্বিতীয়টি বেদাধিকারের ওপর। স্বামীজি 'যথেমাং বাচং
কল্যাণী' প্রভৃতি বেদ-মন্ত্র পাঠ করে বক্তৃতা শুরু করার সাথেসাথে
শাস্ত্রীরা তাদের কানে আঙুল দিয়ে দাঁড়িয়ে কোলাহল করতে শুরু করেছিলেন।
কারণ ওইসব লোকের বিশ্বাস অনুযায়ী শূদ্র ও যবনদের সামনে বেদ মন্ত্র উচ্চারণ
করা উচিত নয়। শূদ্র ও যবনদের সামনে বেদ-জপ নিষিদ্ধ ছিল। কিছু শাস্ত্রী
এমনও বলেছেন যে স্বামীজী ব্রাহ্মণ নন, তা না হলে তিনি এই কাজ করতেন না।
- (পৃষ্ঠা ৩৯৪, ভাগ- ১)
- 'বঙ্গদর্শন'-এ স্বামীজির কাজের সমীক্ষা
১৮৭৬
খ্রিস্টাব্দে স্বামীজির বোম্বে ও পুনাতে অবস্থান এবং এই সময়ের মধ্যে
স্বামীজির কাজের আলোচনা কলকাতা থেকে প্রকাশিত 'বঙ্গদর্শন' পত্রিকায় পাওয়া
যায়। এই বিষয় সম্পর্কিত কিছু অংশ-
“সর্বত্র
দয়ানন্দের কথা হচ্ছে। দয়ানন্দের বক্তৃতা শক্তি, দয়ানন্দের সামাজিক
মতামত, দয়ানন্দের নতুন ধরনের বেদব্যাখ্যা সর্বত্র আলোচিত হয়। সামাজিক
বিষয়ে তার দৃষ্টিভঙ্গি অত্যন্ত বিশুদ্ধ ও উন্নত।
- (পৃষ্ঠা ৪০২- ৪০৩, ভাগ- ১)
- বেদ পড়ার অধিকার সকল মানুষের রয়েছে
সংবত
১৯৩৪ -এ লাহোরে 'বেদ ও বেদোক্ত ধর্ম' বিষয়ে স্বামীজির প্রথম বক্তৃতা ১৮৭৭
সালের ২৫ এপ্রিল হয়েছিল। স্বামীজির এই বক্তৃতার সারসংক্ষেপ 'কোহেনূর'
পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। সেই বক্তৃতার সারসংক্ষেপ পণ্ডিত দেবেন্দ্রনাথ
মুখোপাধ্যায় তার নিজের 'মহর্ষি দয়ানন্দের জীবন-চরিত' গ্রন্থে উদ্ধৃত
করেছেন।
এই বক্তৃতার সারাংশের প্রকৃতি বিষয়ের সাথে সম্পর্কিত অংশটি নিম্নরূপ -
"বেদ
পাঠ করার অধিকার সকল মানুষেরই আছে। যজুর্বেদের ২৬ তম অধ্যায়ের ২ইয়
মন্ত্রে পরমেশ্বর বলেছেন যে, আমি যেভাবে এই কল্যাণকারিনী বাণী সমস্ত
মানুষকে উপদেশ করেছি, তেমনি তোমরা ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য , শূদ্র এবং
অতি শূদ্রদের কাছে তা উপদেশ করতে থাকো।"
- (পৃষ্ঠা ৩৯- ৪০, ভাগ- ২)
- বর্ণ জন্মের উপর নয় কর্মের উপর নির্ভর করে
স্বামীজি
লাহোরে (বাওলী সাহেবের জায়গায়) দ্বিতীয় বক্তৃতাও দিয়েছিলেন শুধুমাত্র
'বেদ ও বেদোক্ত ধর্ম' বিষয়ে, কারণ প্রথম বক্তৃতায় বিষয়টি শেষ হয়নি। এই
বক্তৃতায় তিনি বর্ণনা করেছেন যে – “বর্ণ ব্যবস্থা গুন ও কর্ম অনুসারে,
জন্মের উপর নির্ভরশীল নয়। যে ব্রাহ্মণের কাজ করে সে ব্রাহ্মণ, অন্যথায় সে
শূদ্র। মানুষ এই জন্মেই তার জাত পরিবর্তন করতে পারে, শূদ্র ব্রাহ্মণ হতে
পারে এবং ব্রাহ্মণ শূদ্র হতে পারে। ধর্ম খাওয়া-দাওয়ায় নয়, এক বর্ণের
লোক অন্য বর্ণের হাতের ছোঁয়া রান্না করা খাবার খাওয়া উচিত নয় বেদের
কোথাও এমন নিষেধাজ্ঞা নেই।”
- (পৃষ্ঠা ৪০, ভাগ-২)
- পাদ্রী হুপারের সাথে বর্ণ বৈষম্য নিয়ে কথোপকথন
৯৩৪
সালে (১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দ) ড. হুপার যিনি সংস্কৃতজ্ঞ পাদ্রী ছিলেন, তিনি
লাহোরে স্বামীজির সাথে দেখা করতে আসেন। পাদ্রী সাহেব স্বামীজিকে সংস্কৃতে
কিছু প্রশ্ন করলেন। স্বামীজি তাকে সংস্কৃতেই উত্তর দিয়েছিলেন। বর্ণ বৈষম্য
সম্পর্কিত প্রশ্ন ও উত্তর ছিল নিম্নরূপ-
পাদ্রী সাহেব - বেদ অনুসারে বর্ণভেদ কিভাবে হয়?স্বামীজি - বেদে বর্ণব্যবস্থা গুণ ও কর্ম অনুসারে হয়।
পাদ্রী সাহেব - আমার গুণ ও কর্ম ভাল হলে আমাকেও কি ব্রাহ্মণ বলা যায় ?
স্বামীজি- সন্দেহ নেই ! তোমার গুণ ও কর্ম যদি ব্রাহ্মণ হওয়ার যোগ্য হয়, তবে তোমাকেও ব্রাহ্মণ বলা যায়।
- (পৃষ্ঠা ৪২, ভাগ-২)
- 'ইন্ডিয়ান মিরর' -এর প্রবন্ধ
সংবত
১৯৩৪ (১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দ) সালে লাহোরে স্বামী দয়ানন্দের প্রচারমূলক কাজ
এবং এর প্রভাব সম্পর্কে ২২ জুন, ১৮৭৭ সালে কলকাতার ইংরেজি দৈনিক "ইন্ডিয়ান
মিরর"-এ একটি নিবন্ধ লেখা হয়েছিল-
".........তিনি
বলেছেন যে ব্রাহ্মণরাই ভারতের পতনের প্রধান কারণ এবং তিনি তাদের উপর সমস্ত
দোষ চাপিয়েছেন। ...........তবে তিনি ব্রাহ্মণদের দুটি জিনিসের জন্য
প্রশংসা করেন অর্থাৎ মুসলমানদের থেকে ধর্মগ্রন্থগুলোকে রক্ষার করার জন্য
এবং লোকেদেরকে অন্য ধর্মে ধর্মান্তরিত করা থেকে রক্ষা করার জন্য। তিনি
ব্রাহ্মণদেরকে পাপের কুটুম্ব অর্থাৎ পাপের আত্মীয় বলে ডাকতেন। এটি একটি
নতুন শব্দ এবং এটি ব্রাহ্মণদের প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত করে। -
(পৃষ্ঠা ৫৬- ৫৭, ভাগ- ২)
তারপর ১৮৭৭ সালের ২৩ জুন একজন লেখক ওই দৈনিকে লেখেন-
"যদিও
এই প্রশংসনীয় কাজে শিক্ষিত পুরুষের অবদান রয়েছে, কিন্তু শহরের
ব্রাহ্মণদের সম্পর্কে এইকথা বলা যায় না যারা প্রতিটি সামাজিক ও ধর্মীয়
সংস্কারের প্রকাশ্য শত্রু পণ্ডিত শ্রদ্ধারামের নেতৃত্বে এই নবীন সমাজকে
জন্ম থেকেই নষ্ট করার বৃথা চেষ্টা করছে।" - (পৃষ্ঠা ৫৭, ভাগ-২)
- বেদাধিকার বঞ্চিত করার বানোয়াট শ্রুতি বিরুদ্ধে মহর্ষি
১৮৭৮
সালের জানুয়ারিতে স্বামী দয়ানন্দ গুজরাট (গুজরানওয়ালা) পৌঁছান। তিনি
জালালপুর জট্টার রাস্তার পাশে ফতেহসার নামক উদ্যানে অবস্থান করেন। স্বামীজি
তার প্রথম বক্তৃতায় বলেছিলেন যে- এই 'পৌরাণিকরা অনেক বানোয়াট শ্রুতি
তৈরি করেছেন'। যেমন- 'স্ত্রীশূদ্রৌ নাধিয়াতাম্'। এ বিষয়ে গোস্বামী
শব্দদাস বলেন শ্রুতি আছে এবং আমরা এই বেদে থেকে দেখাব। স্বামীজি বললেন,
এইখানে চারটি বেদ আছে, এর থেকে দেখান, তারপর তিনি বললেন, 'আগামীকাল আমাদের
বেদ থেকে দেখাবো'।........... গোস্বামী শব্দদাস পরেরদিন যে বইগুলি
এনেছিলেন তা বেদ ছিল না, তাই তিনি বেদ থেকে সেগুলো দেখাতে পারেননি।"
- (পৃষ্ঠা ৮২, ভাগ- ২)
- সবার জন্য গায়ত্রী মন্ত্র
ফতেহসারে
(গুজরাট) এক সন্ধ্যায় স্বামীজির (১৯৩৪ সংবত) তৃতীয় বক্তৃতা ছিল। তাতে
স্বামীজি বলেছিলেন যে- “আমি যদি শুধুমাত্র 'ও৩ম্' শব্দটি ব্যাখ্যা করতে
শুরু করি তবে অনেক দিন এবং অনেক ঘন্টা লাগবে, তাই তিনি 'ও৩ম্' সংক্ষেপে
ব্যাখ্যা করে সন্ধ্যার পদ্ধতিটি ব্যাখ্যা করেছিলেন এবং গায়ত্রী মন্ত্রটি
এত সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন যে সরকারি বিদ্যালয়ের এক ফারসি অধ্যাপক
মৌলভী মুহম্মদদীন এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে তিনি সমাবেশের সামনে দাঁড়িয়ে
সবার সামনে বললেন যে যদি গায়ত্রীর এই অর্থ স্বামীজি করে থাকেন তবে আমি
নামাজ না পড়ে সন্ধ্যা করবো। স্বামীজি প্রথমেই অবগত ছিলেন যে সকলের সামনে
বেদ মন্ত্র এবং বিশেষ করে গায়ত্রী মন্ত্র পাঠ করা ব্রাহ্মণদের খুব
বিরক্তবোধ করবে এবং তাই তিনি তার বক্তৃতায় তাদের ভবিষ্যৎ আক্ষেপের উত্তর
দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, যদিও আমাদের কাছে একটি রত্ন আছে যা বিশ্বকে
দেখানো উচিত, কিন্তু স্বার্থপর লোকেরা স্বার্থপরতার কারণে তা লুকিয়ে রাখে।
এই বোকারা জানে না এই রত্ন চুরি করা যায় না। আমি পুরো বিশ্বকে দেখাবো
তারপর দেখবো পৃথিবীতে কে কে আছে যে এটাকে বানোয়াট বলে। স্বামীজির যা আশঙ্কা
ছিল তা পূর্ণ হলো। নগরের ব্রাহ্মণরা স্বামীজিকে অভিশাপ দিতে থাকে এই বলে
যে তিনি একজন খ্রিস্টান একজন সন্ন্যাসীর ছদ্মবেশে লুকিয়ে আছেন। ম্লেচ্ছ ও
শূদ্রদের সামনে গায়ত্রী ও বেদ মন্ত্র পাঠ! হরে রাম! হরে রাম!! ব্রাহ্মণরা
বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতিতে পড়লেন, কিন্তু কিছুই করতে পারলেন না।
- তথাকথিত অস্পৃশ্যদের প্রতি স্বামীজির প্রেম
"সফরমৈনার
পল্টন থেকে শিখ সম্প্রদায়ের একজন শ্রোতাদের মধ্যে ছিলেন এবং একপাশে বসে
খুব আগ্রহ নিয়ে স্বামীজির কথা শুনছিলেন। তিনি সাদা পোশাক পরেছিলেন।
ইতিমধ্যে ছাবনীর একজন পোস্টম্যান স্বামীজিকে ডাকতে এসেছিলেন। তিনি একজন
মুসলমান এবং তিনি সেই শিখকে চিনতেন।
তাকে
সেখানে বসতে দেখে তিনি আগ বাড়িয়ে গিয়ে তাকে বললেন- । "তুমি হতভাগ্য নাপাক!
তুমি এতো সম্মানীয় ও বিখ্যাত ব্যক্তির সেবা করতে এসেছ তাও অসম্মানের সাথে
এবং তুমি তোমার জাত সম্পর্কে তাদের জানাওনি । একথা শুনে তিনি খুব লজ্জিত
হয়ে একপাশে গিয়ে বসলেন। পোস্টম্যান তাকে সেখান থেকেও সরিয়ে দিতে চাইলো,
কিন্তু অস্পৃশ্যদের মুক্তিদাতা দয়ানন্দ কখন এটা সহ্য করতে পারে না।
স্বামীজি খুব বিনম্রতার সহিত পোস্টম্যানকে বললেন,
“নিঃসন্দেহে
এই লোকটি সামান্য ভুল করেছে, যার জন্য যথেষ্ট শাস্তি সে পেয়েছে, এখন
আলাদা বসে তার কথা শোনায় কোনো ক্ষতি নেই, তাকে কিছু বলা উচিত নয়।”
লোকটি
অশ্রুসিক্ত চোখে হাত জোড় করে বললো আমি কারো ক্ষতি করিনি, আমি সবার থেকে
পিছনে জুতা রাখার জায়গায় বসে আছি। স্বামীজি পোস্টম্যানকে বলেছিলেন যে আপনার
এত কঠোর আচরণ করা উচিত নয় এবং বুঝিয়ে দিলেন যে ঈশ্বরের সৃষ্টিতে সবাই
সমান এবং লোকটিকে উপদেশ শোনার জন্য প্রতিদিন আসতে বললেন।
আপনি
মুসলমানদের যতই ঘনিষ্ঠ হন না কেন, এখানে কেউ আপনাকে ঘৃণার চোখে দেখে না।
স্বামীজির সান্ত্বনার কথা তাকে খুব খুশি করেছিল এবং তারপর তিনি প্রতিদিন
উপদেশ শুনতে আসতে থাকেন।
- (পৃষ্ঠা ১১০, ভাগ- ২)
- বাঙালি ভদ্রলোকের সাথে প্রশ্নোত্তর
স্বামীজি
১৮৭৮ সালের আগস্ট মাসে রুড়কিতে ছিলেন। যেখানে একজন বাঙালি ভদ্রলোক পণ্ডিত
মেঘনাদ ভট্টাচার্যের সহিত ধর্মবিষয়ক বার্তালাপ হয়েছিলো। প্রশ্নোত্তরে
প্রকৃতবিষয় সম্বন্ধিত অংশ-
"মেঘনাদ - আমাদের বর্ণবৈষম্যের চর্চা কি ঈশ্বর সৃষ্ট নাকি?
স্বামীজি - না। শ্রেষ্ঠ কর্ম করার মাধ্যমেই ব্রাহ্মণদের শ্রেষ্ঠত্ব নিহিত।
মেঘনাদ- তাহলে যজ্ঞোপবীত পরার প্রয়োজন কি ?
স্বামীজি - এটি লৌকিক আচরণ এবং উচ্চ বংশের (বর্ণ) চিহ্ন মাত্র। "
- (পৃষ্ঠা ১১৮, ভাগ- ২)
- ব্রাহ্মণের গায়ত্রী জপ ও তাতে অব্রাহ্মণের পাপ- পুণ্য
একজন
ব্যক্তি স্বামীজির কাছ থেকে গায়ত্রী মন্ত্র শিখেছিলেন এবং স্বামীজি নিজেই
তার উচ্চারণ সংশোধন করেছিলেন। ব্রাহ্মণরা বলেছিল যে এটি ব্রহ্ম গায়ত্রী
নয় এবং ব্রাহ্মণ ব্যতীত গায়ত্রী মন্ত্র জপ করা পাপ। তিনি যখন স্বামীজিকে
এই কথা বললেন, স্বামীজি বললেন যে বা যারা আমাদের দেওয়া গায়ত্রীকে ব্রহ্ম
গায়ত্রী বলে না তাদের নিয়ে আসুন এবং এই গায়ত্রী মন্ত্র উচ্চারণ করে
আপনার যদি পাপ হয় তা আমার হবে আর পুণ্য হলে তা আপনার হবে।
- (পৃষ্ঠা ১৪৭, ভাগ- ২)
- কানপুরে আর্যসমাজ প্রতিষ্ঠার কারণের একটী জন্মগত বর্ণ বিরোধ
"ইন্ডিয়ান
মিরর" কলকাতা ২৮/১২/১৮৭৯ সালের সংখ্যায় মহারাজের এবারের কানপুর সফর
সম্পর্কে লেখা ছিল- "ইন্ডিয়ান চার্চ গেজেট" এর সংবাদদাতা বলেছেন যে
দয়ানন্দ সরস্বতীর অনুসারী দ্রুত বাড়ছে বলে মনে হচ্ছে। তার বাণের লক্ষ্য
মূর্তিপূজা, ভ্রান্ত বিশ্বাস এবং বর্ণভেদের ব্যবস্থার উপর। প্রায় এক মাস
আগে ঘটে যাওয়া তার শেষ সফরটি অনেক আলোড়ন ও উত্তেজনা সৃষ্টি করেছিল এবং
তার আগমনে কানাপুরে বৈদিক (আর্য) সমাজ প্রতিষ্ঠা হয়েছিল।
- (পৃষ্ঠা ২০৯- ২১০, ভাগ- ২)
- দলিতদের ধর্মান্তর নিয়ে চিন্তিত স্বামীজি
একদিন
রাতে স্বামীজি হঠাৎ উঠে এদিক ওদিক হাঁটা শুরু করলেন। পায়ের আওয়াজ শুনে
এক কর্মচারীরও চোখ খুলে গেল। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন মহারাজ কোন সমস্যায় আছেন
কি না। তিনি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, " খ্রিস্টানরা দলিতদের খ্রিস্টান
বানানোর জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করছে এবং জলের মতো টাকা ঢালছে। এখানে
হিন্দুদের ধর্মীয় নেতারা কুম্ভকর্ণের মতো ঘুমাচ্ছেন। এই দুশ্চিন্তা আমাকে
কষ্ট দিচ্ছে। "
- (দানাপুর, নভেম্বর ১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দ, পৃষ্ঠা ২২১, ভাগ- ২)
- জলে কোন দোষ নেই
আনন্দবাগের
ঘরে স্বামীজি একটি চেয়ারে বসতেন এবং আগন্তুক দর্শক মেঝেতে বসতেন। একদিন
দর্শনার্থীদের মধ্যে একজন মুসলমান ছিল। স্বামীজি কাহারের কাছে পান করার
জন্য জল চাইলেন, তিনি একটি পাত্রে জল আনলেন। তখন এক ব্যক্তি কাহারকে ধমক
দিয়ে বললেন, এই জল স্বামীজির পান করার উপযুক্ত নয়। কাহার আবার পাত্র
ধুয়ে পানি আনলো। স্বামীজি সেই ব্যক্তির অর্থ বুঝতে পেরেছিলেন। সংযুক্ত
প্রান্তের পূর্বাঞ্চলীয় জেলার এই ঘরে মুসলমান বসে ছিলেন বিধায় কোনো খাবার
বা পানীয় গ্রহণ করা হতো না। তাই কাহার ঘরে ঢোকার আগেই স্বামীজি ঘর থেকে
বেরিয়ে গেলেন এবং সেখানে নিজেই জল পান করলেন। ঘরে এসে স্বামীজি বললেন,
আপনি জলকে অপেয় বলেছেন কারণ ঘরে একজন মুসলমান বসেছিল। এটা ঠিক হয়নি, জলের
কোনো দোষ ছিল না।
- (১৮৮০ খ্রিস্টাব্দ, কাশী, পৃষ্ঠা ২২৮, ভাগ - ২)
- জন্মগত বর্ণপ্রথার খণ্ডণ
স্বামীজি কাশীতে সংবত ১৯৩৭ সালে (১৮৮০ খ্রিস্টাব্দ) উপস্থিত ছিলেন। সে সময়ের একটি প্রসঙ্গ নিম্নরূপ-
"একদিন এক ব্যক্তি মহাভাষ্যের একটি শ্লোক পেশ করলেন জন্মসূত্রে বর্ণপ্রথা প্রমাণ করার লক্ষ্যে-
বিদ্যা তপশ্চ যোনিশ্চ এতদ্ ব্রাহ্মণ্যকারকম্।
বিদ্যা তপোভ্যাং যো হীনো জাতিব্রাহ্মণ এব সঃ।।
- (মহাভাষ্যম্ ৪/১/৪৮)
স্বামীজি এর খন্ডন করে মনুর এই শ্লোক পেশ করেন-
যথা কাষ্ঠময়ী হস্তী যথা চর্মময়ো মৃগঃ।
যশ্চ বিপ্রোऽনধীয়ানস্ত্রয়স্তে নাম বিভ্রতি।।
(মনু০ ২/১৫৭)"
- (পৃষ্ঠা ২৩১, ভাগ - ১)
- বর্ণ জন্মগত নয়
১৮৮০
সালে স্বামীজি কাশীতে অবস্থান করছিলেন। “একদিন এক ব্যক্তি স্বামীজির কাছে
জাতিভেদের বৈষম্যের বিষয়টি তুলে ধরেন। স্বামীজি বলেছিলেন ব্রাহ্মণাদি
বর্ণ জন্মগত হওয়া সম্ভব নয়। যদি এমন হয়, ব্রাহ্মণের দুই ছেলের একজন যদি
খ্রিস্টান হয়ে যায় এবং অন্যজন মুসলমান হয়ে যায়, তাহলেও কি তারা
ব্রাহ্মণ বলে গণ্য হবে? তুমি যদি রাজি না হও, তাহলে জন্ম থেকেই
ব্রাহ্মণ্যত্ব কোথায় ছিল?"
- (পৃষ্ঠা ২৩৪, ভাগ- ২)
- শূদ্র ও নারীদের বেদাধিকার
মহারাষ্ট্রের
বিখ্যাত প্রসিদ্ধ সংস্কৃত বিদুষী রমাবাঈ স্বামী দয়ানন্দের সান্নিধ্যে
কয়েকদিন মিরাটে অবস্থান করেছিলেন। তিনি স্বামীজির কাছ থেকে বৈশেষিক দর্শন
পড়েছিলেন। স্বামীজি চেয়েছিলেন রমাবাঈ প্রাচীনকালের বিদুষী গার্গীর মতো
ব্রহ্মচারী হয়ে নারী সম্প্রদায়ের মধ্যে শিক্ষা ও বৈদিক ধর্ম প্রচার করুক।
কিন্তু তিনি তার বন্ধু বাঙালি বাবু বিপিন বিহারীকে এম.এ.বি.এল. (যিনি তার
সাথে মিরাটে থাকতেন) বিয়ে করতে চেয়েছিলেন এবং গৃহস্থ আশ্রমে যেতে
চেয়েছিলেন। চারিত্রিক তথা ধর্মীয় বিষয়ে অব্যবস্থিত হওয়ার কারণে তিনি
স্বামীজির প্রস্তাব গ্রহণ করতে পারেননি। তাই স্বামীজি তাকে বিদায় দিলেন।
স্বামীজির জীবনী রচয়িতা পন্ডিত দেবেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় পণ্ডিতা
রমাবাঈকে একটি চিঠি লিখেছিলেন। ১৯০৩ সালের ১৩ই নভেম্বর রমাবাঈ দেবেন্দ্রনাথ
বাবুর চিঠির জবাব দেন। রমাবাঈ স্বামীজির সাথে দেখা করার সিদ্ধান্ত
নিয়েছিলেন এই ভিত্তিতে- "স্বামীজি বিশ্বাস করতেন যে প্রাচীন ভারতে বর্ণ
ব্যবস্থা গুণ, কর্ম, স্বভাবের উপর ভিত্তি করে হতো।" পণ্ডিতা রমাবাঈ তার
চিঠিতে আরও লিখেছেন- "স্বামী দয়ানন্দ নারীদের জন্য ধর্মের প্রয়োজনীয়তা
স্বীকার করতেন। তিনি বলতেন যে নারীরা বেদ পড়তে পারে, যা হিন্দু ধর্ম
অনুমতি দেয়নি। হিন্দু ধর্ম নারী ও শূদ্রদের ঘৃণা করতো বলেই আমার আত্মা তার
বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিল। নারীদের বেদ, দর্শন এবং ধর্মতত্ত্ব
অধ্যয়নের অধিকার দেওয়ার বিষয়ে আমি তার শিক্ষায় সন্তুষ্ট হয়েছি।"
- (পৃষ্ঠা ২৪৪-২৪৫, ভাগ- ২)
- নারী শিক্ষা লাভ করলে চরিত্র খারাপ হবে এই আপত্তির উত্তর
স্বামীজি
১৮৮০ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে মুজাফফরনগরে ছিলেন। একদিন এক ভদ্রলোক
নারীশিক্ষা নিয়ে স্বামীজিকে আপত্তি করলেন যে নারীরা লেখা-পড়া করে কুটিল
হয়ে যাবে। স্বামীজি উত্তর দিলেন যে এটি প্রকৃতি এবং সংগতির উপর নির্ভর
করে। কারণ অনেক শিক্ষিত পুরুষও চরিত্রহীন।
- (পৃষ্ঠা ২৫০, ভাগ- ২)
- শিষ্টাচার তথা সমান ব্যবহার
১৮৮২ সালে স্বামীজির বোম্বেতে থাকার ঘটনা -
"একদিন
একজন বাঙালি ভদ্রলোক স্বামীজির সাথে দেখা করতে এসেছিলেন, তার দাড়ি ছিল।
গুজরাটে হিন্দুরা দাড়ি রাখে না, ভদ্রলোক স্বামীজির সাথে কথা বলতে থাকেন।
কিছুক্ষণ পরে তিনি জল পান করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন, তাই স্বামীজি তার
গুজরাটি শিষ্যকে জল আনতে বলেন। শিষ্যটি ভাবলেন আগন্তুক মুসলমান তাই তিনি
পাতার তৈরি পাত্রে জল দিলেন। যখন তিনি চলে গেলেন তখন স্বামীজি তার শিষ্যকে
ক্রোধান্বিত ভঙ্গিতে বললেন যে তোমার এখনও সভ্যতার সহজ নিয়মগুলির জ্ঞান
নেই, কেন তুমি অতিথিকে গ্লাসে জল দিলেন না? শিষ্য বললেন, "মহারাজ! আমি
কীভাবে একজন মুসলমানকে পাত্রে জল দেব। " স্বামীজি বলেছিলেন যে , " তিনি
মুসলমান নন, কিন্তু একজন বড় জমিদার ছিলেন। সমস্ত মুসলমান এবং খ্রিস্টান
আমার কাছে আসে তোমার উচিত সকল অতিথিকে সমানভাবে আপ্যায়ন করা, ভবিষ্যতে যদি
কোন অতিথি জল চায় তাহলে জল দেয়ার সময় বিচার করবে না সে কোন মতের। "
- (পৃষ্ঠা ২৯৪, ভাগ- ২)
- এক জোড়া জুতা বনাম সমগ্র পৃথিবীর দান
স্বামীজি
১৮৮২ খ্রিস্টাব্দে উদয়পুরে ছিলেন। একদিন উদয়পুরের মহারানার সামনে
সমাবেশে একটি ধর্মীয় গ্রন্থের কিছু অংশ পাঠ করা হয়েছিলো। সেই সভায়
স্বামীজিও উপস্থিত ছিলেন। সেই ধর্মগ্রন্থে পড়া লেখাটির অর্থ ছিল- “কেউ
একজন ব্রাহ্মণকে এক জোড়া জুতা দিলে সে সমগ্র পৃথিবী দান করার পুণ্য পায়।
স্বামীজি মহারানাকে বললেন, যদি এটা সত্যি হয়, তাহলে আপনি ব্রাহ্মণদের যে
লাখ টাকা মূল্যের সম্পদ দিয়েছেন তা স্বায়ত্তশাসিত করুন এবং একজন
ব্রাহ্মণকে জুতা দান করুন, আপনি সমগ্র পৃথিবী দান করার পুণ্য পাবেন। "
- (পৃষ্ঠা ৩০৪, ভাগ- ১)
- অধিকারানধিকার ঝঞ্ঝট
একদিন
দু'জন সাধু স্বামীজির সাথে দেখা করতে এসেছিলেন এবং তার সাথে অনেক বিষয়ে
কথোপকথন করেছিলেন। তিনি যখন হাঁটতে শুরু করেছিলেন, তখন তিনি স্বামীজিকে
বলেছিলেন যে আপনি কেবলমাত্র কর্তৃত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের কাছেই প্রচার
করুন। আপনার বক্তৃতায় আসা সমস্ত লোকই কর্মকর্তা নয়। স্বামীজির উত্তর ছিল,
"ধর্মের বিষয়ে কর্তৃত্বের প্রশ্ন তোলা বৃথা, উপদেশ শোনার অধিকার শুধু
মানুষেরই আছে। আপনার জাত-ধর্মের শত-হাজার মানুষ পাষণ্ড হয়ে বসে আছে
অধিকারানধিকার ঝঞ্ঝটে। আগে তাদের বাঁচান, অধিকারানধিকারের বিচার পরে হবে।"
- (১৮৮২ খ্রিস্টাব্দ, উদয়পুর, পৃষ্ঠা ৩০৬-৩০৭, ভাগ- ২)
এই প্রসঙ্গে স্বামীজির জীবনী রচয়িতা দেবেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের সংক্ষিপ্ত মন্তব্যটি নিম্নরূপ-
স্বামীজির
এই উত্তরটি কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল এবং এতে তার উদারতা কতটা স্পষ্টভাবে
প্রতিফলিত হয়েছে তা ভেবে দেখার মতো। এই অধিকারানধিকারের প্রশ্ন নারী জাতি ও
শূদ্রদের শিক্ষা থেকে চিরকালের জন্য বঞ্চিত করেছে এবং এর ফলে ধর্মীয়
মহন্তো ও ঠিকাদারদের সিংহাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যারা মানুষের মনে তালা
লাগিয়ে দেশকে রসাতলে নিয়ে গেছে। দয়ানন্দ তো এসেছিলেন শুধুমাত্র এই
তালাগুলো ভাঙতে এবং মানুষকে মানসিক দাসত্ব থেকে মুক্ত করতে এবং আজ
দয়ানন্দকে বলা হচ্ছে সেই তালাগুলো না ভাঙতে, যাতে তালার উপর তালা লাগানো
যায়। দয়ানন্দ কেন এটা মানবেন ?
- (পৃষ্ঠা ৩০৭, ভাগ- ২)
- চার চুলার ভণ্ডামি
স্বামীজি
কাঁচা-পাকা, পরিপক্ক- অপরিপক্ক রান্নাঘরের ঝঞ্ঝট মানতেন না। একদিন এক
সন্ন্যাসী, যিনি তার কাছে পড়াশোনা করতেন, চারের প্রশ্নে বাবুর্চির সাথে
ঝগড়া করেছিলেন, তখন স্বামীজি তাকে তিরস্কার করেছিলেন যে সন্ন্যাসী হওয়া
সত্ত্বেও চারটি চুলার ভণ্ডামি থেকে মুক্তি পায়নি। যেখানে তোমার চার বর্ণের
পারস্পরিক ভেদাভেদ মুছে সার্বজনীন ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা উচিত, কিন্তু
তুমি নিজেই এই নোংরামিতে পড়ে আছো ।
- (শাহপুরা [রাজস্থান] ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দ, পৃষ্ঠা ৩২২, ভাগ- ২)
বাংলাদেশ অগ্নিবীর