মহর্ষি স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী নিম্নলিখিত কাহিনী বখ্শীরাম ও মুন্সি ইন্দ্রমণিকে শুনিয়েছিলেন -
যে দিনগুলোতে আমি একাকী পরিভ্রমণ করতাম, তখন একবার আমি এমন এক জায়গায় গেলাম যেখানে সব শাক্ত বসবাস করে । তারা আমার বহু সেবা- শুশ্রূষা করলো । কয়েকদিন থাকার পর যখন আমি সেখান থেকে চলে যেতে চাইলাম তারা অত্যন্ত আগ্রহ করে আমাকে থেকে যেতে বললো, আমি ভাবলাম যে বোধহয় ভক্তিভাবের জন্য আমাকে থাকতে বলছে । এভাবে বহুদিন কেটে যাওয়ার তাদের অনুষ্ঠানের দিন এলো । সেদিন সমস্ত শাক্ত দেবীর মন্দিরে গিয়ে গান গাইতে লাগলো । সেদিন তারা আমাকেও বললো যে আজকে আমাদের মন্দিরে মহোৎসব, আপনিও চলুন । আমি অনেক বোঝালাম যে দেবী দর্শনে আমার বিশ্বাস নেই কিন্তু তারা শুনতে রাজি না । পায়ে পড়ে আমাকে বলতে লাগলো যদি আজকের উৎসবের দিন আপনি পদার্পণ না করেন তবে আমাদের সমস্ত উৎসাহই নষ্ট হয়ে যাবে । আপনি মূর্তিকে নমস্কার বা অন্য কিছু না করলেন, তবুও আমাদের সাথে চলুন ।
সেই মন্দির নগরের বাইরে এক নির্জন স্থানে ছিলো । তাদের মাধ্যমে বাধ্য হয়ে আমাকে মন্দিরে যেতে হলো । সেসময় উঠানে হোম হচ্ছিলো আর লোকজন উৎসব পালন করছিলো । আমাকে তারা দূর্গা মূর্তি দেখানোর বাহানায় ভিতরে নিয়ে গেলো । আমিও সরল মনে দুর্গা প্রতিমার সামনে দাঁড়ালাম । মূর্তির পাশে এক বলিষ্ঠ ব্যক্তি উন্মুক্ত খড়্গ নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো ।
তারা বললো, ' মহাত্মাজী ! মায়ের সামনে অবশ্যই নত হয়ে নমস্কার করবেন '। আমি স্পষ্টভাবে বললাম আমার কাছে এমন আশা দুরাশা মাত্র । আমার কথা শুনে পূজারী ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলো ও আমার ঘাড় ধরে আমার মাথা নিচু করতে লাগলো । তার এই ব্যবহারে আমি আশ্চর্য হয়ে গেলাম । কিন্তু যখনই আমি পেছনে তাকালাম দেখি সেই খড়্গধারী আমার পাশে চলে এসেছে ও আমার ঘাড়ে খড়্গই চালাতে চাচ্ছে ।
আমি এটা দেখামাত্র সাবধান হয়ে গেলাম । আমি দ্রুত ফিরে তার হাত থেকে খড়্গ ছিনিয়ে নিলাম । পূজারী তো আমার বাম হাতের এক ধাক্কাতেই মন্দিরের দেয়ালে গিয়ে ধাক্কা খেলো । আমি সেই খড়্গ নিয়ে মন্দিরের উঠানে চলে এলাম । তখন উঠানের সমস্ত লোক কুড়াল, ছুরি ইত্যাদি শস্ত্র নিয়ে আমার উপর ঝাপিয়ে পড়লো । দরজার দিকে তাকালাম, দেখলাম তাতে তালা লাগানো । বলির থেকে রক্ষার জন্য আমি লাফিয়ে দেয়ালে উঠে গেলাম ও অপর দিকে নেমে বেরিয়ে গেলাম । দিনভর আমি সেখানেই আত্মগোপন করলাম । কিন্তু যখন গভীর রাত হলো তখন আমি অন্য গ্রামে গিয়ে উঠলাম । সেদিন থেকে আমি কখনো শাক্তদের বিশ্বাস করিনি ।
[ মহর্ষি দয়ানন্দের জীবন চরিত, দেবেন্দ্রনাথ ও ঘাসীরাম, পৃষ্ঠা ৩৬৩-৩৬৪ ]
- বিদ্রঃ
পশুবলির পাশাপাশি কালিকা পুরাণে নরবলিও দেখা যায়। নিচে নরবলি সংক্রান্ত শ্লোকগুলি উদ্ধৃত করা হল-
“ছাগল, শরভ এবং মনুষ্য ইহারা যথাক্রমে বলি, মহাবলি এবং অতিবলি নামে প্রসিদ্ধ।“
[কালিকা পুরাণ ৬৭/৫]
অর্থাৎ সব বলির মধ্যে মানুষ বলি দেয়া শ্রেষ্ঠ বলি!
যথাবিধি প্রদত্ত একটি নরবলিতে দেবী সহস্র বৎসর তৃপ্তি লাভ করেন, আর তিনটি নরবলিতে লক্ষ বছর তৃপ্তি লাভ করেন।
[কালিকা পুরাণ ৬৭/১৯]
মনুষ্য মাংস দ্বারা কামাখ্যা দেবী এবং আমার রূপধারী ভৈরব তিন হাজার বৎসর তৃপ্তি লাভ করেন।
[কালিকা পুরাণ ৬৭/২০]
যেহেতু বলির মস্তক এবং মাংস দেবতার অত্যন্ত অভিষ্ট, এই হেতু পূজার সময় বলির শির এবং শোণিত দেবীকে দান করিবে।
[কালিকা পুরাণ ৬৭/২১-২২]
বিচক্ষণ সাধক ভোজদ্রব্যের সহিত লোমশূণ্য মাংস দান করিবে এবং কখন কখন পূজোপকরণের সহিতও মাংস দান করিবে।
[কালিকা পুরাণ ৬৭/২৩]
রক্তশূণ্য মস্তক অমৃত তুল্য পরিগণিত হয়।
[কালিকা পুরাণ ৬৭/২৪]
নরপতি মনুষ্যের রক্ত মৃন্ময় অথবা তৈজস পাত্রে রাখিয়া সর্বদা উৎসর্গ করিয়া দিবে, পত্র নির্মিত দ্রোণাদিতে কখনোই দিবে না।
[কালিকা পুরাণ৬৭/৪৭]
এইরূপে পূজা করিয়া পূর্ব তন্ত্র দ্বারা বিধিপূর্বক পূজা করিবে। নরবলি পূজিত হইয়া আমার স্বরূপ দিকপালগণ কর্তৃক অধিষ্ঠিত হয়।
[কালিকা পুরাণ৬৭/৯১]
এবং ব্রহ্মা প্রভৃতি অন্যান্য সকল দেবগণ কর্তৃক অধিষ্ঠিত হইয়া সেই বলিরূপ নর পূর্বে পাপাচারী হইলেও নিষ্পাপ হইয়া যায়।
[কালিকা পুরাণ ৬৭/৯২]
সেই পাপশুণ্য বলিরূপ নরের শোণিত অমৃত তুল্য হয়, উহা দ্বারা জগন্ময়ী জগন্মায়া মহাদেবী প্রীতিলাভ করেন।
[কালিকা পুরাণ ৬৭/৯৩]
সেই বলিরূপী নর মনুষ্যদেহ পরিত্যাগ করিয়া মরিতে মরিতেই গণদিগের অধিপতি হইয়া আমার অধিক সৎকারের পাত্র হয়।
[কালিকা পুরাণ ৬৭/৯৪]
এতদ্ব্যতীত অন্যপ্রকার পাপযুক্ত মলমূত্র ও বসাযুক্ত বলি কামাখ্যা দেবী নামমাত্রেও গ্রহণ করেন না। [কালিকা পুরাণ ৬৭/৯৫]
পশু-স্ত্রী, পক্ষিণী বিশেষত মনুষ্য স্ত্রীকে কখনোই বলিপ্রদান করিবে না। স্ত্রীকে বলিদান করিলে কর্তা নরকপ্রাপ্ত হয়।
[কালিকা পুরাণ ৬৭/১০১]
অর্থাৎ নারীরা বেঁচে গেলেন,ধরে ধরে খালি পুরুষদের বলি দিবেন!
গণহারে নরবলির উল্লেখ নিচের শ্লোকে পাওয়া যায়-
যেখানে
বিশেষ গণনা না করিয়া একেবারে দলে দলে বলি প্রদান করা হয় সেইস্থলে সমুদয়
দল একেবারে অর্চিত করিয়া ভক্তি পূর্বক পশু পক্ষীর স্ত্রী এবং মানুষীকে
বলি দিতে পারে।
[কালিকা পুরাণ, ৬৭/১০২]
এখন প্রশ্ন হল যারা এসব মারাত্মক মস্তিস্ক বিকৃত বই থেকে এক দুটি রেফারেন্স দেখিয়ে সাধারণ জনগণকে বিভ্রান্তির প্যাচে ফেলতে চান,এইসব বইয়ের দোহাই দিয়ে বলেন দেবীকে সন্তুষ্ট করতে পাঠাবলি দেয়া উচিত তারা খুব চালাকি করে নরবলির শ্লোকগুলোকে এড়িয়ে যান চুরি করে।কালিকা পুরাণ ৫৫ তম অধ্যায় মতে তো নরবলি হল অতিবলি বা পাঠা ইত্যাদির মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ বলি।
কালিকা পুরাণ ৫৫ নং অধ্যায়ের ১-৩ নং শ্লোকে বলা হয়েছে নবমৃগ-বরাহ,ছাগল,মহিষ,শশক এইসব বলি দেয়া নির্দিষ্ট।অর্থাৎ মহিষও বলি দেয়া যাবে!
আরও মারাত্মক বিষয় হলো কালিকা পুরাণ ৬৭ নং অধ্যায়ের ৯ নং শ্লোক অনুযায়ী গোমাংস ও গোরক্ত(গো রুধি) নিবেদন করলে দেবী পুরো ১ বছর তৃপ্ত থাকেন-
গোধিকাবাং গোরুধিরৈর্বার্ষিকীং তৃপ্তিমাপ্নুয়াৎ।
এদিকে আবার মানুষের রক্তের দাম গরুর চেয়ে কম,কারণ ৮ নং শ্লোকে বলা হয়েছে মনুষ্য শোণিত দ্বারা মানে মানুষের রক্ত দ্বারা দেবী মাত্র ৮ মাস তৃপ্ত হন!
তার মানে তন্ত্র-শাক্ত অনুযায়ী গরু,মহিষ ও মানুষ বলি দেয়া অনুমোদিত।
অর্থাৎ আমরা দেখছি যেসব গ্রন্থ দেখিয়ে পশুবলির পক্ষে কেউ কেউ কথা বলে তন্ত্রের পক্ষ নিয়ে সেইসব বই অনুযায়ী গোমাংস,গোরক্ত,মনুষ্য মাংস,মনুষ্য বলি দিতে হবে দেবীকে। এই শ্লোকগুলো সেই ধূর্ত লোকেরা লুকিয়ে রেখে অন্য শ্লোকগুলো দেখিয়ে ঈশ্বরকে সন্তুষ্ট করতে বলি প্রয়োজন এমনটা বলে সাধারণ হিন্দুদেরকে বিভ্রান্ত করে থাকে।কারো ভোজন কী হবে তা নিতান্তই তার ব্যক্তিগত ইচ্ছে। কিন্তু সেটা না করে বৈদিক ধর্মের নামে মিথ্যাচার করা,অর্ধেক তথ্য দিয়ে মানুষকে ঈশ্বর সন্তুষ্টি করতে পশুবলির হাস্যকর প্রয়োজনীয়তা দেখানো উচিত নয়। ঈশ্বর তো সর্বমহান,সর্বশ্রেষ্ঠ,তাঁকে সন্তুষ্ট করতে মানুষের,গরুর,রক্তমাংসের কী দরকার? এগুলো নিতান্তই আদিম যুগীর চিন্তাভাবনা যেমনটা আমরা বিভিন্ন সিনেমায় অনুন্নত বন্য উপজাতিদের দেখি মানুষ বলি দিতে।তাই যারা এইসব বলির সমর্থক তারা গোমাংস ভক্ষণেরও সমর্থক,মানুষ বলি দেয়ারও সমর্থক উপরে উপরে যতই ভালো ভালো কথা বলুক না কেন।
শেষ করব পবিত্র বেদবাণী দিয়ে-
অনাগো হত্যা বৈ ভীমা কৃত্যে মা নো গাম অশ্বম পুরুষং বধী।
(অথর্ববেদ ১০।১।২৯)
- নির্দোষের হত্যা অবশ্যই ভয়ানক। আমাদের গাভী, অশ্ব, মনুষ্যকে মেরো না।
ইমং মা হিংসীদ্বিপাদ পশু সহস্রাক্ষ মেধায় চীয়মান।
(যজুর্বেদ ১১।৪৭)
-হে সহস্র প্রকার দৃষ্টি যুক্ত রাজন! সুখ প্রাপ্ত করানোর জন্য নিরন্তর বৃদ্ধিশীল এই দ্বিপদী মনুষ্য এবং পশুকে কখনো হত্যা করো না।