সত্যার্থ‌ প্রকাশে‌ নির্দেশিত‌ “আর্ষ পাঠবিধি” বিভাগীকরণ‌

 


মহর্ষি দয়ানন্দ জী তাঁর প্রণীত‌ অমর‌ গ্রন্থ‌ সত্যার্থ‌ প্রকাশে‌র তৃতীয় সমুল্লাসে‌ 'পঠনপাঠনবিশেষবিধিঃ' প্রকরণে‌ বিবিধ আর্ষ‌ শাস্ত্র পঠন-পাঠনের নির্দিষ্ট সময়সীমার বর্ণন‌ করেছেন ।
 
তদনুসারে,
ব্যাকরণ → ৩ বর্ষ
নিরুক্ত → ৮ মাস
পিঙ্গল ছন্দ→ ৪ মাস
সাহিত্য → ১ বর্ষ
ষড় দর্শন → ২ বর্ষ
চার বেদসহিত‌ ব্রাহ্মণ → ৬ বর্ষ
আয়ুর্বেদ → ৪ বর্ষ
রাজবিদ্যা → ৪ বর্ষ
গান্ধর্ববেদ → ৪ বর্ষ
অর্থবেদ →৪ বর্ষ
জ্যোতিষ শাস্ত্র → ২ বর্ষ
 
মোট‌ = ৩১ বর্ষ
 
মহর্ষি‌ দয়ানন্দ জী‌র‌ নির্দেশিত এই সম্পূর্ণ পাঠবিধি যথাতথ-রূপে ৩১ বর্ষে অত্যন্ত মেধাবী, পূর্ব সংস্কারে সম্পন্ন বিদ্যার্থী‌ই পূর্ণ করতে সক্ষম । মধ্যমকোটির মেধাবী বিদ্যার্থী উক্ত‌ পাঠবিধি যথাতথ-রূপে সম্পন্ন করতে ৪০ বর্ষে‌ সক্ষম‌ ।
 
উপনয়নের পূর্ব বর্ষসমূহের গণনা করে উক্ত পাঠবিধি ৪৮ বর্ষ পর্যন্ত অথবা অখণ্ড ব্রহ্মচর্য পালনকারী বিদ্যার্থীদের‌ জন্য‌ । যে‌ বিদ্যার্থী ১৬ বর্ষ অথবা ২৪ বর্ষ অধ্যয়ন করতে ইচ্ছুক ; অর্থাৎ ১৬+৮ =২৪ বর্ষ আয়ু‌ পর্যন্ত এক বেদের স্বাধ্যায় অথবা যে‌ ২৪+৮ =৩২ বর্ষ আয়ু‌ পর্যন্ত দুই বেদের স্বাধ্যায়ের‌ পশ্চাৎ গার্হস্থ্য আশ্রমে প্রবেশ করতে ইচ্ছুক, তার‌ জন্য সত্যার্থ প্রকাশে‌ নির্দেশিত‌ পাঠবিধির বিভাগীকরণ আবশ্যক ।
 

  • প্রথম কল্প —— ২৪ বর্ষ পর্যন্ত ব্রহ্মচর্য ধারণকারীর‌ পাঠবিধি - 

 
সাঙ্গোপাঙ্গ সহিত এক বেদের স্বাধ্যায় ১৬ বর্ষে সম্পন্ন‌ হ‌ওয়া সম্ভব । ৫ বর্ষ মহাভাষ্যান্ত ব্যাকরণের অধ্যয়ন, ১ বর্ষ নিরুক্ত তথা একটি সামান্য কোশ, দেড় বর্ষ ছন্দঃশাস্ত্র-সাহিত্য, দেড় বর্ষ জ্যোতিষ শাস্ত্র, ৬ উপাঙ্গ =দর্শনশাস্ত্র ২ বর্ষ বিধিবৎ অধ্যয়ন। উপাঙ্গসমূহের অধ্যয়নের সময় মীমাংসা শাস্ত্রের অধ্যয়নের পূর্বে কল্পসূত্র =শ্রৌত,গৃহ্য, ধর্মসূত্রসমূহের অধ্যয়ন এবং বেদান্ত দর্শন অধ্যয়নের পূর্বে ঈশাদি দশ উপনিষদের অধ্যয়ন আবশ্যক । কেননা মীমাংসাদর্শনে যজ্ঞসম্বন্ধী সূত্রসমূহের‌ বিস্তৃত‌ বিচার‌ করা হয়েছে তথা বেদান্তদর্শনে উপনিষদ্বচন-সমূহের । এবং ৩ বর্ষে যজুর্বেদ বা সামবেদ পদক্রম সহিত সার্থ অধ্যয়ন ।
 
বিশেষ বিবেচ্য‌ – মীমাংসাদর্শন অধ্যয়নের‌ পূর্বে ন্যূনাতিন্যূন এক বেদ এর স্বাধ্যায় অর্থাৎ কণ্ঠস্থীকরণ অত্যাবশক‌ । ইহা‌ সমস্ত মীমাংসকের মত, পরন্তু মহর্ষি দয়ানন্দ জী‌ যেমনভাবে ব্রহ্মসূত্র‌ অধ্যয়নের পূর্বে দশ উপনিষদ অধ্যয়নের পাঠবিধি উল্লেখ করেছেন ; তদ্বৎ মীমাংসা শাস্ত্রের অধ্যয়নের পূর্বে ন্যূনাতিন্যূন এক বেদ স্বাধ্যায়ের উল্লেখ‌ করেন নাই । এর কারণ‌, প্রাচীন আর্ষ পরম্পরা অনুসারে বেদারম্ভসংস্কারের অনন্তর বেদাধ্যয়ন অনিবার্য । স্বয়ং মহর্ষি দয়ানন্দ জী উপনয়নের অনন্তর পরম্পরানুসারে সমগ্র শুক্ল যজুর্বেদ কণ্ঠস্থ করেছিলেন ।
 
২৪ বর্ষ পর্যন্ত ব্রহ্মচর্য ধারণকারী বিদ্যার্থীর‌ জন্য ৮ বর্ষ আয়ুতে বিহিত উপনয়ন সংস্কারের অনন্তর ১৬ বর্ষের সাঙ্গ বেদাধ্যয়নের যে পাঠবিধি দর্শানো‌ হলো‌ তার প্রমাণ - “ব্রাহ্মণেন নিষ্কারণো ধর্মঃ ষডঙ্গো বেদোঽধ্যেয়ো জ্ঞেয়শ্চ” ; ইহা পাতঞ্জল মহাভাষ্যের বচন‌ ।
 

  • দ্বিতীয় কল্প —— ৩২ বা‌ ৩৬ বর্ষ পর্যন্ত ব্রহ্মচর্য পালনকারীর‌ পাঠবিধি - 

 
প্রথম কল্পে‌ বর্ণিত ২৪ বর্ষ পর্যন্ত অধ্যয়ন‌ করার‌ পাঠবিধি‌র এক‌ই নিয়ম‌ এই কল্পে‌র ক্ষেত্রে‌ও প্রযোজ্য‌ ।
পরবর্তী ৮ বর্ষের পাঠবিধি‌ নিম্নরূপ-
প্রথম কল্পে যজুর্বেদ স্বাধ্যায়কারী ব্রহ্মচারী ৪ বর্ষে শতপথ ব্রাহ্মণ, আয়ুর্বেদ এর নিঘণ্টু, চরক, সুশ্রুত গ্রন্থের অধ্যয়ন করবেন। সামবেদ স্বাধ্যায়কারী ৪ বর্ষে বাদিত্রবাদন সহিত সামগান এবং নাট্যশাস্ত্র অভিনয়পূর্বক আয়ত্ত‌ করবেন । শেষ ৪ বর্ষে পূর্ব অনভ্যস্ত যজুর্বেদ অথবা সামবেদ এর পদ-ক্রম সহিত সার্থ অধ্যয়ন সম্পন্ন‌ করবেন । এরূপভাবে‌ দুই বেদের স্বাধ্যায় সম্পন্ন হবে ।
৩৬ বর্ষ পর্যন্ত ব্রহ্মচর্য পালনকারী এই ৪ বর্ষে পদ-ক্রম এবং ঐতরেয় ব্রাহ্মণ সহিত ঋগ্বেদ এর যথাশক্য অধিকতম ভাগ অধ্যয়ন সম্পন্ন করবেন । ‌ অথবা বাস্তুশাস্ত্র বা শিল্পশাস্ত্র অথবা ভৌতিক বিজ্ঞান বা রাজনীতিশাস্ত্রের বিধিবৎ অধ্যয়ন করবেন ।
 

  • তৃতীয় কল্প —— ৪০ বা ৪৪ বর্ষ পর্যন্ত ব্রহ্মচর্য পালনকারীর পাঠবিধি - 

 
এই কল্পে‌‌ও পূর্বের‌ কল্পদ্বয়ে‌র‌ অনুরূপ‌ পাঠবিধি‌ প্রযোজ্য‌ । অর্থাৎ ৩২ বর্ষ‌ পর্যন্ত‌ এক‌ইধারায়‌ পঠন-পাঠন‌ সম্পন্ন করতে হবে।
 
৩২ বর্ষ থেকে ৪০ বর্ষের মধ্যে পদক্রম এবং ঐতরেয় ব্রাহ্মণ সহিত সম্পূর্ণ ঋগ্বেদ এর অধ্যয়ন‌ করতে হবে ; সাথে সামবেদ এর তাণ্ড্যব্রাহ্মণ অধ্যয়ন অথবা বাস্তুশাস্ত্র, শিল্পশাস্ত্র অথবা রাজনীতি আদির মধ্যে‌ কোনো এক‌টি শাস্ত্রের বিধিবৎ‌ অধ্যয়ন‌ করতে হবে । তথা যে‌ বিদ্যার্থী ৪৪ বর্ষ পর্যন্ত ব্রহ্মচর্য‌ ধারণের‌ মনস্থির করেন তিনি পরবর্তী চার বর্ষে পদক্রম এবং গোপথ ব্রাহ্মণ সহিত অথর্ববেদ এর স্বাধ্যায় করবেন ।
 

  • চতুর্থ কল্প —— ৪৮ বর্ষ পর্যন্ত ব্রহ্মচর্য ধারণকারী বিদ্যার্থী পূর্ব পঠিত যেকোন‌ও বিদ্যাক্ষেত্রে বিশেষ যোগ্যতা সম্পাদন করবেন ।

 
প্রত্যেক বিবিধ বিষয়ের পূর্ণ‌ অধ্যয়নকারী‌ বিদ্যার্থীর‌ জন্য যেকোন‌ও একটি বিদ্যাক্ষেত্রে পারোবর্যবিৎ= পারঙ্গত হ‌ওয়া অত্যাবশ্যক ।
 
এই বিষয়ে আর্ষ‌ পরম্পরা‌র‌ মহান‌ বিভূতি‌ মহর্ষি‌ যাস্কের‌ সিদ্ধান্ত‌ –
 
পারোবর্যবিৎসু তু খলু বেদিতৃষু ভূয়োবিদ্যঃ প্রশস্যো ভবতি
[নিরুক্ত. ১।১৬ ; ১৩।১২]
অর্থাৎ এক-এক বিদ্যায় পারঙ্গত বিদ্বানগণের মধ্যে সেই বিদ্বান্ শ্রেষ্ঠ, যিনি এক বিদ্যায় পারঙ্গত হয়ে‌ও অধিক বিদ্যার জ্ঞান রাখেন ।
 

নান্তরেণ কস্যাশ্চিদ্ বিদ্যায়াঃ পারঙ্গতাস্ তত্রভবন্তঃ শিষ্টাঃ
[ মহাভাষ‌্য‌. ৬।৩।১০৯]
অর্থাৎ যিনি বিনা আকাঙ্ক্ষায় কোনো একটি বিদ্যায় পারঙ্গত, তিনি‌ই শিষ্ট গুণসম্পন্ন ।
 
বর্তমানে‌ পরম আবশ্যকতা এই যে‌, আর্ষ পাঠবিধির অধ্যয়নকারী‌ বিদ্যার্থী কোনো এক বিষয়ে আর্ষ শাস্ত্র থেকে ভিন্ন অনার্ষ গ্রন্থের সম্যক্ অনুশীলন কর‌বে । অনার্ষ‌ গ্রন্থ অনুশীলনের‌ দরুন‌ প্রতিপক্ষী ব্যক্তির সহিত‌ শাস্ত্রার্থের সময় স্বপক্ষ স্থাপন এবং পরপক্ষের যথোচিত নিরাকরণে পরিপূর্ণ সমর্থ‌ হ‌তে পারবে ।
বিদুষাং বশংবদঃ

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.