মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতীর বঙ্গে দিনগুলো যেমন ছিলো

 


মহর্ষি স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী যখন কলিকাতায় আগমন করেন তখন (১৬ই ডিসেম্বর, ১৮৭২) হইতে কয়েক মাস পর্যন্ত হেমচন্দ্র তাহার সঙ্গে সঙ্গে ছিলেন। হেমচন্ত্র দয়ানন্দের নিকট উপনিষদ পাঠ ও যোগবিদ্যা শিক্ষা করিতেন। 'দয়ানন্দ-প্রসঙ্গ' এই নামে হেমচন্দ্র কয়েক মাসের দিনপঞ্জী লিখিয়াছিলেন। দয়ানন্দ বঙ্গ দেশে চারি মাস কাল ছিলেন। এই হস্তলিখিত সংক্ষিপ্ত দিন-পঞ্জীতে উক্ত চারি মাসের সূক্ষ্ম ধারাবাহিক বিবরণ পাওয়া যায়। গ্রন্থখানি। সাধারণের অজ্ঞাত ছিল। আদি ব্রাহ্মসমাজের পুরাতন জীর্ণ খাতাপত্রের মধ্যে ছিল। আদি ব্রাহ্মসমাজের পুরাতন জীর্ণ খাতাপত্রের মধ্য হইতে এই হস্তলিখিত দিনপঞ্জী হঠাৎ স্বর্গীয় আচার্য ক্ষিতীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দৃষ্টিতে আসে। তিনি আমাকে এই দিনপঞ্জী খানি দেখাইয়াছিলেন। আমি তখন আপার চিৎপুর রোডস্থ আদি ব্রাহ্মসমাজ মন্দিরে সাপ্তাহিক উপাসনায় উপনিষদ ও বেদমন্ত্র ব্যাখ্যা করিতাম। সে আজ ২২/২৩ বৎসর পূর্বের কথা। আমি হেমচন্দ্র লিখিত দিনপঞ্জী খানি সম্পূর্ণ নকল করিয়া ছিলাম। দিন-পঞ্জীতে উল্লিখিত বহু ব্যক্তির সংক্ষিপ্ত পরিচয় পাদটীকায় সন্নিবেশ করিলাম। পাদটীকা আমার নিজস্ব।
 
- মন্দির, তাঃ ১।১। ৫৪ কলিকাতা আর্য সমাজ 
পণ্ডিত দীনবন্ধু বেদশাস্ত্রী

✅সম্পূর্ণ দিনপঞ্জি ✅

 
১৬ ডিসেম্বর, ১৮৭২। কাশী শাস্ত্র-বিচারের বিজেতা স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী ভাগলপুর হইতে কলিকাতায় পৌছিলেন। ব্যারিষ্টার চন্দ্রশেখর সেন, পণ্ডিত সত্যব্রত সামশ্রমী, ব্যারিষ্টার উমেশচন্দ্র বন্দোপাধ্যায় প্রভৃতি কয়েক জনে সন্ন্যাসীকে পাথুরিয়াঘাটার রাজবাড়ীতে লইয়া আসিলেন। বরাহনগর “নাইনান”বাগান বাড়ীতে তাহার আহার ও বাসস্থান নির্দিষ্ট হইল।

[ পাদটীকা- ব্যারিষ্টার চন্দ্রশেখর সেন ব্রাহ্মসমাজের নেতা, “ভূ-প্রদক্ষিণ” প্রণেতা। কাশী শাস্ত্রবিচারে তিনি উপস্থিত ছিলেন। পণ্ডিত সত্যব্রত সামশ্রমী বেঙ্গল এশিয়াটিক সোসাইটির বেদজ্ঞ পণ্ডিত, বহু বৈদিক সাহিত্যের প্রকাশক।তিনিও কাশী শাস্ত্ৰবিচারে উপস্থিত ছিলেন। ব্যারিষ্টার উমেশচন্দ্র বন্দোপাধ্যায় কংগ্রেসের প্রথম সভাপতি (বোম্বাই, ১৮৮৫) ছিলেন।]

 

১৭-২০ ডিসেম্বর, ১৮৭২। দয়ানন্দ সন্ন্যাসীর দর্শনের জন্য “নাইনানে” অসম্ভব লোকসমাগম। তাহার সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পাইলাম না।

২১ ডিসেম্বর ১৮৭২। সন্ন্যাসীর সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পাইয়া তৃপ্ত হইলাম। কেশবচন্দ্র সেনকেও দেখিলাম।

২২ ডিসেম্বর ১৮৭২। দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর, হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও ত্রিদিব ভট্টাচার্যের সঙ্গে সন্ন্যাসীর দর্শন করিলাম। যজ্ঞোপবীত, বর্ণভেদ, যজ্ঞ, আত্মা ও ষড়দর্শন সম্বন্ধে বহু প্রশ্নের উত্তর পাইলাম। আত্মা তৃপ্ত হইল।

[পাদটীকা—দ্বিজেন্দ্রনাথ দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের জ্যেষ্ঠ পুত্র এবং হেমেন্দ্রনাথ তাহার তৃতীয় পুত্র।]

২৩-২৮ ডিসেম্বর ১৮৭২। ব্রাহ্মসমাজের কার্যে ব্যস্ত থাকায় সন্ন্যাসীকে দর্শন করিতে পারিলাম না।

২৯শে ডিসেম্বর ১৮৭২। সন্ন্যাসীর নিকট নূতন ভাবে উপনিষদের ব্যখ্যা শুনিলাম। কেশবসেনের সঙ্গে তাহার ঘনিষ্ঠতা জন্মিয়াছে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের কথা তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন।

৩০-৩১ ডিসেম্বর ১৮৭২। নাইনানে যাইতে পারিলাম না। শুনিলাম অক্ষয় কুমার দত্ত ও রাজনারায়ণ বসু এই দুই দিনে বেদ ও হোম সম্বন্ধে তাহার সঙ্গে আলোচনা করিয়াছেন।

[ পাদটীকা—অক্ষয়কুমার দত্ত (১৮২০-১৮৬৮ খৃঃ) ব্রাহ্ম সমাজের তত্ত্ববোধিনী পত্রের সম্পাদক ও বিভিন্ন গ্রন্থলেখক। “ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়”তাহার বিখ্যাত গ্রন্থ। কবি সত্যেন্দ্র নাথ দত্তের ইনি পিতামহ। রাজনারায়ণ বসু (১৮২৬ ১৮৯৯ খৃঃ) ঋষি অরবিন্দের মাতামহ বিভিন্ন ইংরেজী গ্রন্থের লেখক, উপনিষদের ইংরেজী অনুবাদক; ধর্ম সমাজ, ভাষা ও রাজনীতি বিষয়ে বহু বাংলাগ্রন্থের রচয়িতা,ব্রাহ্মসমাজের নেতা।]

১লা জানুয়ারী ১৮৭৩। কেশবচন্দ্র সেন দয়ানন্দ সরস্বতীকে সঙ্গে করিয়া কলিকাতায় বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ করিলেন।

[পাদটীকা- কেশবচন্দ্র সেন (১৮৩৮-১৮৮৮ খৃঃ)নববিধান ব্রাহ্মসমাজের প্রতিষ্ঠাতা। তাহার চেষ্টায় ১৮৭২ খৃষ্টাব্দের ৩ আইন অসবর্ণ বিবাহ আইন পাশ হয়। ভারতে ও ইউরোপে তিনি অসাধারণ বাগ্মীরূপে পরিচিত ছিলেন।]

২রা জানুয়ারী ১৮৭৩। সন্ন্যাসীর নিকট উপনিষদ পাঠ করিতে আরম্ভ করিলাম। কৃষ্ণদাস পাল নাইনে সন্ন্যাসীর সঙ্গে দেখা করিয়া কথাবার্তা করিলেন। বেদবিদ্যালয় স্থাপনের প্রস্তাবেকৃষ্ণদাস পাল হর্ষ জ্ঞাপন করিলেন।

[ পাদটীকা—কৃষ্ণদাস পাল (১৮৩৮-১৮৮৪ খৃঃ) হিন্দু পেট্রিয়ট নামক ইংরেজী পত্রের সম্পাদক, কলিকাতা মিউনিসিপ্যালিটির সভ্য ও বড়লাটের মন্ত্রী সভার সভ্য।]

৩ জানুয়ারী ১৮৭৩। সন্ন্যাসীর কেশবচন্দ্রের সঙ্গে বাদুড়বাগানে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের গৃহে আগমণ।বিধবা-বিবাহ, নিয়োগ,বাল্য বিবাহ, কৌলীণ্য প্রথা, বৃদ্ধ-বিবাহ, শিশু-বিবাহ সম্বন্ধে উভয়ের মধ্যে আলাপ। বিদ্যাসাগর অসুস্থ ছিলেন। সন্ন্যাসীর বেদ-বিদ্যালয় স্থাপনের প্রস্তাবে আনন্দ।

৪ জানুয়ারী ১৮৭৩।রাজা রাজেন্দ্রনাথ মল্লিকের গৃহে কেশবচন্দ্র কর্তৃক বেদ-বিদ্যালয় সম্বন্ধে পরামর্শ সভার আয়োজন। মহারাজা যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর, উত্তর পাড়ার জমিদার জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়, চারুচন্দ্র মল্লিক, প্যারীমোহন মুখোপাধ্যায়, কৃষ্ণদাস পাল, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, কেশবচন্দ্র সেন, ভূদেব মুখোপাধ্যায় প্রভৃতি সভায় উপস্থিত ছিলেন। ঠিক হইল সংস্কৃত কলেজে বেদপাঠের ব্যবস্থা সম্ভবনা হইলে পৃথক বিদ্যালয় স্থাপন করা হইবে।

[পাদটীকা—যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর (১৮৩১-১৯০৮ খৃঃ) পাথুরিয়াঘাটার জমিদার, স্যার-সি-এস-আই-মহারাজা উপাধিতে ভূষিত, বড়লাটের ব্যবস্থাপক সভার সদস্য। বৃটিশ ইণ্ডিয়ান সভার সভাপতি, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলো ও সিণ্ডিকেটের সহকারী সভাপতি। মহারাজা প্রদ্যোতকুমার তাহারই পুত্র। জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় (১৮০৮-১৮৮৮ খৃ) উত্তরপাড়ার জমিদার। রাজা প্যারীমোহন মুখোপাধ্যায় ইহারই পুত্র। বড়লাটের ব্যবস্থাপক সভার সদস্য ভূদেব মুখোপাধ্যায় (১৮২৫-১৮৯৪ খৃঃ) সি-আই-ই, এডুকেশন গেজেটের পরিচালক, বহু গ্রন্থলেখক, স্কুল ইন্সপেক্টর, শিক্ষা দর্পণ পত্রিকার সংস্থাপক, ছোটলাটের ব্যবস্থাপক সভার সদস্য] |

৫-৭ জানুয়ারী ১৮৭৩। সন্ন্যাসী আমাকে যম নিয়মের উপদেশ দিলেন ও লঘু প্রাণায়ামের প্রণালী শিক্ষা দিলেন। কেশবচন্দ্র ও রাজা রাজেন্দ্রলাল মিত্র সন্ন্যাসীর সঙ্গে দেখা করিলেন। আর্য জাতির প্রাচীন ইতিহাস সম্বন্ধে রাজেন্দ্রলালের সঙ্গে আলোচনা।

[পাদটীকা-রাজা রাজেন্দ্রলাল মিত্র ই-সি-আই-ই (১৮২৪১৮৯১ খৃঃ) বিভিন্ন ভাষায় অভিজ্ঞ, ঐতিহাসিক, “বিবিধার্থ সংগ্রহ”নামক মাসিক পত্রের সম্পাদক, এসিয়াটিক সোসাইটির সভাপতি, প্রত্নতত্ত্ববিদ, হিন্দুপেট্রিয়টের সম্পাদক, ইণ্ডো,এরিয়ান্স আদিবহু ঐতিহাসিক গ্রন্থের রচয়িতা)] ।

৮ জানুয়ারী ১৮৭৩ সন্ন্যাসীর নিকট যোগ বিদ্যা সম্বন্ধে উপদেশ লাভ। রাজনারায়ণ বসু, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও রামতনু লাহিড়ীতাহার সঙ্গে নাইনানে দেখা সাক্ষাৎ ও আলাপ-আলোচনা করিলেন। ঈশ্বরচন্দ্রের সঙ্গে সমাজ সংস্কার সম্বন্ধে আলোচনা। সন্ন্যাসী তাহাকে বঙ্গদেশে বেদ প্রচারের অনুরোধ জানাইলেন। “এই শরীরে আর হইবেনা, পরজন্মে দেখা যাইবে”—ঈশ্বরচন্দ্র এই উত্তর করিলেন। রামতনু লাহিড়ী প্রাচ্য শিক্ষা ও পাশ্চাত্য শিক্ষা সম্বন্ধে আলোচনা করিলেন।

[পাদটীকা রামতনু লাহিড়ী (১৮১৩-১৮৯৮ খৃঃ) ডেভিড হেয়ারের শিষ্য ও ডিরোজিওর ভক্ত, শিক্ষাব্রতী, সমাজ সংস্কারক ও বিদ্যাসাগরের বন্ধু। ]

৯ জানুয়ারী ১৮৭৩। কেশবচন্দ্র সেনের লিলি কটেজে সন্ন্যাসী দয়ানন্দের সংস্কৃত ভাষায় বক্তৃতা। বহু বিশিষ্ট ব্যক্তি বক্তৃতা শুনিয়া মুগ্ধ হইলেন। রাজানারায়ণ বসু সন্ন্যাসীকে 'হিন্দু ধর্মের শ্রেষ্ঠতা' নামক গ্রন্থ উপহার দিলেন ও তাহা হইতে কোন কোন অংশ হিন্দী করিয়া শুনাইলেন। লিলি কলেজে আসিবার পূর্বে তিনি এশিয়াটিক মিউজিয়াম পরিদর্শন করিলেন ও বেদ-উপনিষদ্‌ কয়েক খণ্ড ক্রয় করিলেন।

১০ জানুয়ারী ১৮৭৩। সন্ন্যাসীর আদেশে মৌন ব্রত অবলম্বন করিলাম এবং তাহার সান্নিধ্যে অবস্থান করিলাম। আই-সি-এস রমেশচন্দ্র দত্ত ও উকীল রমেশচন্দ্র মিত্র তাহার সঙ্গে দেখা করিয়া বেদের অনুবাদ ও ভারতের প্রাচীন ইতিহাস সম্বন্ধে আলাপ আলোচনা করিলেন। রমেশচন্দ্র দত্ত সন্ন্যাসীর বেদ সম্বন্ধে অগাধ পাণ্ডিত্য দেখিয়া বিস্মিত হইলেন।

[পাদটীকা রমেশচন্দ্র দত্ত (১৮৪৮-১৯০৯ খৃঃ) ১৮৬৯ খৃষ্টাব্দে আই-সি-এস্ হন। বিভিন্ন জেলার ম্যাজিষ্ট্রেট ও পরে উড়িষ্যা বিভাগের কমিশনার, পরে বড়োদা রাজ্যের অর্থসচিবের পদে অধিষ্ঠিত। ঐতিহাসিক উপন্যাস, রামায়ণের ইংরেজী অনুবাদ, ঋগ্বেদের বঙ্গানুবাদ, ভারতের প্রাচীন সভ্যতার ইতিহাস, বঙ্গভাষার ইতিহাস ইত্যাদি তাহার অক্ষয় কীর্তি। রমেশচন্দ্র মিত্র (১৮৪০১৮৯৯ খৃঃ) কলিকাতা হাইকোর্টে ওকালতি করার পর ১৮৭৪ খৃষ্টাব্দে হাইকোর্টের বিচারপতি পদে আরুঢ় হন]

১১-১৮ জানুয়ারী ১৮৭৩। সন্ন্যাসীর আদেশে আরও আট দিনের জন্য মৌন অবলম্বন করিলাম। প্রত্যহ ব্রাহ্ম মুহুর্তে তিনি যোগবিদ্যা শিক্ষা দিলেন। লক্ষ্য করিলাম এই কয়েক দিনের মধ্যে সূর্যকান্ত আচার্য চৌধুরী, রজনীকান্ত গুপ্ত, যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর, ডাঃ মহেন্দ্রলাল সরকার, প্রতাপচন্দ্র মজুমদার, দ্বারকানাথ গাঙ্গুলি, গঙ্গাধর কবিরাজ প্রভৃতি বিশিষ্ট ব্যক্তিরা তার সঙ্গে দেখা করিলেন।

[ পাদটীকা-মহারাজা সূর্যকান্ত আচার্য চৌধুরী (১৮৫০১৯০৮ খৃঃ) ময়মনসিংহ জেলার আলাপসিংহ পরগণার জমিদার। মুক্তাগাছার জমিদার রাজা জগৎকিশোর আচার্য চৌধুরীর পুত্র শশীকান্ত আচার্য চৌধুরীকে ইনি পোষ্যপুত্ররূপে গ্রহণ করিয়াছিলেন।]

[রজনী কান্ত গুপ্ত (১৯৪৯-১৯০০ খৃঃ) প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক সাহিত্যিক ও সুলেখক। পাণিনিবিচার, আর্যকীর্তি ভারতবর্ষের ইতিহাস ও সিপাহী যুদ্ধের ইতিহাস লিখিয়া তিনি অমরত্ব লাভ করিয়াছেন।]

[ডাঃ মহেন্দ্রলাল সরকার (১৮৩৩-১৯০৩ খৃঃ) এম-ডি, ডিএল, সি-আই-ই, সুপ্রসিদ্ধ চিকিৎসক, বিজ্ঞানসভার স্থাপয়িতা, কলিকাতা, বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেললা, ছোটলাটের ব্যবস্থাপক সভার সদস্য।]

[প্রতাপচন্দ্র মজুমদার (১৮৮০-১৯০৫ খৃঃ) বিখ্যাত বক্তা ও ব্রাহ্মধর্ম প্রচারক, ইণ্ডিয়ান মিরর পত্রিকার সম্পাদক, বিভিন্ন ইংরেজী গ্রন্থের লেখক। ইনি চিকাগো ধর্ম মহাসভায় ব্রাহ্মসমাজের প্রতিনিধিত্ব করিয়াছিলেন।]

[দ্বারকানাথ গাঙ্গুলি (১৮৪৬-১৮৯৮৭ খৃঃ) ব্রাহ্ম সমাজের নেতা, স্ত্রীশিক্ষার পক্ষপাতী, সুলেখক, সুকবি, হিন্দু মহিলা বিদ্যালয়ের ও ভারত সভার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও “অবলা বান্ধব” পত্রিকার স্থাপয়িতা। "না জাগিলে সব ভারত ললনা, এ ভারত আর জাগে না জাগে না” কবিতাটি তাহারই রচিত।]

[গঙ্গাধর কবিরাজ (১৭৯৮-১৮৮৫ খৃঃ) নিপুণ চিকিৎসক, ৪০ খানি সংস্কৃত গ্রন্থের রচয়িতা। মুগ্ধবােধ ব্যাকরণের ও চরক সংহিতার সুবিস্তৃত টীকা লিখিয়া তিনি অসাধারণ পাণ্ডিত্য ও প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন ]

১৯-২১ জানুয়ারী ১৮৭৩। ব্রাহ্ম সমাজের মাঘোৎসব উপলক্ষ্যে ব্যস্ত রহিলাম। ২১শে জানুয়ারী মাঘোৎসবের দিন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের আমন্ত্রণ দয়ানন্দ সন্ন্যাসীকে আমি ও দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর জোড়াশাকো রাজবাড়ীতে লইয়া আসিলাম। ব্রাহ্মসমাজের সব নেতাই সেখানে উপস্থিত ছিলেন। ব্রাহ্মসমাজও বেদ বিষয়ে সকলের সঙ্গে সন্ন্যাসীর আলাপ আলোচনা হইল। দেবেন্দ্রনাথের পুত্রগণের মুখে বেদমন্ত্র শুনিয়া তিনি মুগ্ধ হইলেন। তাহাকে রাজবাড়ীতে কয়েকদিন থাকিতে অনুরোধ করিলাম তিনি সম্মত হইলেন না।

২১-৩০ জানুয়ারী ১৮৭৩। সন্ন্যাসী আমাকে নিভৃতে নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করিয়া যোগাভ্যাস করিতে আদেশ দেওয়ায় বেহালায় এক নির্জন কুটীরে এই নয় দিন অবস্থান করিলাম। এই কয়েক দিন গুরুদেবের সঙ্গসুখ হইতে বঞ্চিত রহিলাম। শুনিলাম ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রাজনারায়ণ বসু, অক্ষয়কুমার দত্ত, কেশবচন্দ্র সেন প্রভৃতি তাহার সঙ্গে আলাপ আলোচনার জন্য গিয়াছিলেন।

[পাদটীকা—মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮১৭-১৯০৫ খৃঃ) প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের জ্যেষ্ঠ পুত্র এবং আদি ব্রাহ্ম সমাজের নেতা। ইহার ১৪টি পুত্র কন্যা, যথা—দ্বিজেন্দ্রনাথ, সত্যেন্দ্রনাথ, হেমেন্দ্রনাথ, বীরেন্দ্রনাথ, সৌদামিনী, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, সুকুমারী, শরকুমারী, স্বর্ণকুমারী, বর্ণকুমারী, পুর্ণেন্দ্রনাথ, সোমেন্দ্রনাথ, ররীন্দ্রনাথ (বিশ্বকবি) ও বুধেন্দ্রনাথ।]

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০-১৮৯১ খৃঃ) কলিকাতা সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ এবং হুগলী, বর্ধমান, নদীয়া ও মেদিনীপুর জেলার বিদ্যালয় সমূহের স্পেশাল ইন্সপেক্টর, বিভিন্ন গ্রন্থ রচয়িতা, বিধবা বিবাহ, আন্দোলনের প্রবর্তক। কলিকাতা সংস্কৃত কলেজে ব্রাহ্মণ ও বৈদ্যসমাজের ছাত্র ছাড়া অন্য সমাজের ছাত্রদের জন্যও দ্বারোদঘাটন ইহারই কীর্তি ।

৩১শে জানুয়ারী ১৮৭৩, গুরুদেব সন্ন্যাসী দয়ানন্দ বালুচরে কোন পরিচিত ব্যক্তির বাগানবাড়ীতে নিভৃত জীবন যাপন করিলেন। কলিকাতার অজস্র লোক সমাগম হইতে কয়েক দিনের বিরাম গ্রহণই ছিল মুখ্য উদ্দেশ্য।

২২শে ফেব্রুয়ারী ১৮৭৩। স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতীর কলিকাতায় প্রত্যাবর্তন ও বিশ্রাম।

২৩শে ফ্রেব্রুয়ারী ১৮৭৩। গোরাচাঁদ দত্তের গৃহে সন্ন্যাসীর “ঈশ্বর ও ধর্ম”সম্বন্ধে বক্তৃতা। কেশবচন্দ্র সেন সভার আয়োজন করিয়াছিলেন। বহু বিশিষ্ট ব্যক্তির উপস্থিতি। সংস্কৃত কলেজের বহু ছাত্র সঙ্গে করিয়া মহেশচন্দ্র ন্যায়রত্নের যোগদান। সন্ন্যাসীর সংস্কৃত বক্তৃতায় সকলে মুগ্ধ।ন্যায়রত্ন বক্তৃতার হিন্দীতে অনুবাদ করিয়া শুনাইলেন। অনুবাদে কদর্থকরা হইতেছে বলিয়া ছাত্রদের আপত্তি। ন্যায়রত্নের উষ্মা প্রকাশ করিয়া সভা ত্যাগ।

২৪-২৮ ফ্রেব্রুয়ারী। কেশবচন্দ্র সেনের কলুটোলাস্থ পিতৃগৃহে, আদিব্রাহ্মসমাজে, বেহালায়, খিদিরপুরেও কাশীপুরে কেশবচন্দ্রের উদ্যেগে সন্ন্যাসীর বক্তৃতা ও ধর্মালোচনা।

১-১১ মার্চ ১৮৭৩। যোগসাধনার জন্য আমার বেহালায় নির্জন ও নিঃসঙ্গ জীবনযাপন। স্বামিজীর সঙ্গে কলিকাতার বহু বিশিষ্ট ব্যক্তির বার্তলাপ।

১৩ মার্চ ১৮৭৩। লক্ষ্মীনারায়ণ গোস্বামীর সঙ্গে স্বামীজীৰ নবদ্বীপে উপস্থিতি।

১৪-১৮ মার্চ ১৮৭৩। ১৫ই নবদ্বীপে বাজারে ও ১৬ই গঙ্গাতীরে সভা। গুজব উঠিল—জার্মান সাহেব ম্যাক্সমূলার সন্ন্যাসীর বেশে নবদ্বীপের লোককে খৃষ্টান করিতে আসিয়াছে, শত সহস্র নরনারী তাহাকে দেখার জন্য ছুটিয়া আসিয়াছে। লক্ষ্মীনারায়ণ লোকের নিকট অপদস্থ। কোন পণ্ডিত শাস্ত্রবিচারে অগ্রসর হইলেন না নবদ্বীপে গিয়া স্বামীজীর সঙ্গে মিলিত হইলাম।

১৯-২১ মার্চ ১৮৭৩। স্বামীজীকে সঙ্গে করিয়া বরাহনগরে ফিরিলাম।

২২-৩১ মার্চ ১৮৭৩। স্বামীজী নিঃসঙ্গ ভাবে গ্রন্থ প্রণয়ন কার্যে আত্মনিয়োগ করিলেন। বিকালে তাহার উপদেশ হইল।

১লা এপ্রিল ১৮৭৩, দয়ানন্দের বরাহনগরত্যাগ ও ভূদেব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে হুগলীতে উপস্থিতি। বৃন্দাবনচন্দ্র মণ্ডলের বাগানবাড়ীতে আহার ও বাসস্থানের ব্যবস্থা। রেভারেণ্ড লালবিহারী দে’র সহিত স্বামীজীর প্রশ্নোত্তর। রেভারেণ্ডের পরাজয়।

২-৫ এপ্রিল ১৮৭৩। বৃন্দাবনবাবুর গৃহে স্বামীজীর সংস্কৃতে বক্তৃতা। সাহিত্যিক অক্ষয়চন্দ্র সরকার, ভূদেব মুখোপাধ্যায় ও ভট্টপল্লীর পণ্ডিতেরা বক্তৃতা শুনিয়া মুগ্ধ।

৭-৮ এপ্রিল ১৮৭৩। ৮ই এপ্রিল ভট্টপল্লীর পণ্ডিত তারাচরণ তর্করত্নের (কাশীনরেশের সভাপণ্ডিত) সহিত স্বামীজীর মূর্তিপূজা বিষয়ে শাস্ত্ৰবিচার। তারাচরণের পরাজয়।

৯-১২ এপ্রিল ১৮৭৩। মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে হুগলীর বিভিন্ন স্থানে স্বামীজীর পরিভ্রমণ। : ১৩ এপ্রিল ১৮৭৩। স্বামীজীর বর্ধমানে উপস্থিতি। রাজা বনবিহারী কাপুর রাজবাড়ীতে আহার ও বাসস্থানের ব্যবস্থা করিলেন।

১৪-১৫ এপ্রিল ১৮৭৩। বর্ধমান রাজবাড়ীতে স্বামীজীর উপদেশ। বহুলোকের সমাগম। রাজা বাহাদুরের ধর্মোপদেশ শুনিতে নিয়মিত যোগদান কিন্তু ঔদাসীন্য।

১৬ই এপ্রিল ১৮৭৩। স্বামীজীর বর্ধমান ত্যাগ ও ভাগলপুর অভিমুখে যাত্রা।

সমাপ্ত
সন্দর্ভঃ বঙ্গে দয়ানন্দ - পণ্ডিত দীনবন্ধু বেদশাস্ত্রী

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.