এক আর্যসমাজী মহারাজার কাহিনি - রাজর্ষি ছত্রপতি শাহু মহারাজ

 

মহারাজার নাম শুনলে আমাদের মনে ভেসে ওঠে হাজার বছর আগের দৃশ্য৷ কিন্তু আপনারা হয়ত অনেকে জানেন না, ভারত বৃটিশের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের পূর্ব পর্যন্ত ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে আঞ্চলিক রাজা মহারাজা ছিলো৷ সেই সব মহারাজার একজনের নাম হচ্ছে "রাজর্ষি ছত্রপতি শাহু মহারাজ"। ইনি মারাঠার ভোঁসলে রাজবংশের রাজা এবং কোলহাপুরা ভারতীয় সাম্রাজ্যের মহারাজা ছিলেন। ইনি ১৮৭৪ সালের ২৬শে জুন কোলহাপুরে জন্মগ্রহণ করেন। মহারাজ মহারাষ্ট্রের কোলহাপুরের সিংহাসনে ১৮৯৪ সালে আরোহন করেন ৷ 
 
১৯০২ সালে তাঁর জীবনে একটি স্মরণীয় ঘটনা ঘটে। তিনি এই সময়ে প্রশাসনিক কাজে ইংল্যান্ড যাওয়ার সময় যোধপুরের মহারাজ প্রতাপসিংহের সাথে তাঁর সাক্ষাৎকার হয়। যোধপুরের মহারাজ স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতীর একাগ্র অনুসারী থাকায় কথা প্রসঙ্গে শাহু মহারাজ তাঁর মুখ থেকে আর্যসমাজ সম্পর্কে জানতে পারেন। তিনি উদার মানসিকতার এবং সংস্কারে আগ্রহী হওয়ায় আর্যসমাজ সম্পর্কে জানার আগ্রহী বৃদ্ধি পায়৷ ফলে তিনি ভারত ফিরে এসে তিনি বড়োদরার মহারাজ শ্রী শ্যাজীরাব গায়কবাড়ের সাথে দেখা করেন এবং সেখানেই তিনি আর্যসমাজের প্রচারক মাস্টার আত্মরাম অমৃতসরীর সাথে পরিচিত হন৷ এরফলে তিনি আর্যসমাজের পৃষ্ঠপোষক হয়ে ওঠেন ৷ 
 

 
 
আর্যসমাজের সান্নিধ্যে তিনি তাঁর রাজ্যে ব্যাপক সংস্কারের কাজ শুরু করেন। ফলে তাঁর রাজ্যে আর্যসমাজের ডঙ্কা বেঁজে ওঠে৷ তিনি সর্বপ্রথমে একটি বৈদিক শিক্ষিত জনগোষ্ঠী গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। ফলে প্রথমে তিনি "শিবাজী বৈদিক বিদ্যালয়" প্রতিষ্ঠা করেন৷ এরপর তিনি "শাহু দয়ানন্দ কলেজ" এবং "স্বামী শ্রদ্ধানন্দ আর্য মন্দির" প্রতিষ্ঠা করেন৷ এগুলো ছিলো মূলত তাঁর সংস্কারের প্রথম ধাপ৷ এরপর তিনি হিন্দুসমাজে প্রচলিত বর্ণবাদের গোড়ায় আঘাতের মাধ্যমে একটি কুসংস্কারমুক্ত জাতি গড়ে তোলার জন্য কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তিনি প্রথমে তাঁর প্রাসাদের অব্রাহ্মণদের উপনয়ন করাতে চাইলে তাঁর রাজপুরোহিত সেটি দিতে অস্বীকৃতি জানান। ফলে তিনি একটি সাহসী পদক্ষেপ নেন এবং সেই রাজপুরোহিতকে পদচ্যুত করে তার জায়গায় একজন ক্ষত্রিয়কে নিয়োগ করেন। এভাবে তিনি বর্ণবাদের গোড়ায় আঘাত শুরু করেন যা দিনে দিনে বিস্তৃত হতে শুরু করে। এরপর তিনি তাঁর রাজ্যের শূদ্রদের উপনয়নের ব্যবস্থা করে দেন এবং তাদের উপনয়ন নিতে উৎসাহী করেন। এছাড়া সামাজিক বৈষম্যের কারণে পিছিয়ে থাকা শূদ্রের শিক্ষার জন্য তিনি ছাত্রবৃত্তি প্রদান শুরু করেন। তাঁরই ছাত্রবৃত্তি লাভ করে আম্বেদকর বিদেশে পড়াশুনার জন্য গমন করেন।
 
তিনি সমাজে সকলের সমাধিকারে বিশ্বাসী ছিলেন। তাঁর সময়ে তিনি সরকারি (তাঁর রাজ্যের) চাকরিতে ব্রাহ্মণদের অগ্রাধিকারের প্রথা বন্ধ করে দেন। ফলে সকলে চাকরিতে সমান অধিকার লাভ করে৷ শুধু তাই নয়, তিনি বিধনা নারীদের পুনর্বিবাহ এবং বাল্যবিবাহ রোধের জন্য ১৯১৭ সালে প্রয়াস করেছিলেন। এছাড়াও তিনি তাঁর রাজ্যে গোহত্যা বন্ধের জন্য একটি আইনও প্রণয়ন করেছিলেন। 
 
 

১৯২০ সালের ৮ই মার্চ অখিল ভারতীয় আর্যসভার প্রধান অতিথি ছিলেন শাহু মহারাজ৷ তিনি সেই সভায় মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী ও আর্যসমাজের সমাজ দ্বারা সমাজ সংস্কার বিষয়ক একটি দীর্ঘ বক্তৃতা দেন। সেটি "রাজর্ষি শাহু মহারাজ আণি আর্যসমাজ" নামক মারাঠি গ্রন্থে লিপিবদ্ধ আছে৷ 
 
এই মহান মহারাজ ১৯২২ সালে মাত্র ৪৭ বছর বয়সে মারা যান। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র রাজারাম সেই অঞ্চলের শাসক হন। শাহু মহারাজ আর্যসমাজে এতটাই পৃষ্ঠপোষক ছিলেন যে তাঁর সময়ে ও তাঁর পুত্রের সময়ে ১৯১৮ সাল থেকে ১৯৩৫ সাল পর্যন্ত শুধুমাত্র কোলহাপুর থেকেই ২৬০০০ কপি "সত্যার্থ প্রকাশ" ছাপানো হয়েছিলো। 
 
যদিও তিনি অল্পায়ু ছিলেন এবং ব্রিটিশ শাসনের অধীনে সামান্য প্রভাব নিয়েই মহারাজের আসন অধিকৃত করেছিলেন, তবুও তিনি তাঁর এই স্বল্প জীবনে সেই অঞ্চলে যেসব সংস্কারমূলক কাজ করেছিলেন, তা হয়ত অন্য কোনো স্বাধীন মহারাজার দ্বারাও সম্ভব হতো না৷ তাই আজও মহারাষ্ট্রের মানুষের কাছে "রাজর্ষি শাহু মহারাজ" অমর হয়ে আছেন৷

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.