জয়ন্ত ভট্ট




ভরদ্বাজ গোত্রীয় গৌড় জয়ন্ত ভট্ট কাশ্মীরের অন্ধকার নির্জন কারাগারে বন্দী অবস্থায় থেকে যে জ্ঞানের প্রদীপ জ্বালিয়ে তোলেন তার আলো যারা প্রত্যক্ষ করেছেন তাঁরা প্রত্যেকেই বিস্মিত হয়েছেন। পরিণত বয়সে নবম শতাব্দীর শেষদিকে ৮৮৩ খ্রীষ্টাব্দের পর ইনি ন্যায়মঞ্জরী নামক যে গ্রন্থ রচনা করেছিলেন

সেটি প্রাচীন ন্যায়ের শেষ স্তম্ভ। ন্যায়মঞ্জরীর প্রথমেই লেখক বলেছেন যে পাণ্ডিত্যপূর্ণ গৌতমসূত্রের সম্পূর্ণ অংশ নিয়ে গ্রন্থ রচনার সামর্থ্য না থাকার জন্য গ্রন্থের একটি অংশ নিয়ে তিনি আলোচনায় প্রবৃত্ত হয়েছেন। ন্যায়শাস্ত্র হল ওষধির একটি অরণ্য, তার মধ্য থেকে তিনি সরস বস্তুকে আহরণ করেছেন। আন্বীক্ষিকীকে দুধের সঙ্গে তুলনা করে বলেছেন যে—তাঁর গ্রন্থটি সেই দুধের থেকে সাররূপে তুলে নেওয়া ননি। বিশাল পণ্ডিত হলেও জয়ন্ত ভট্টের মধ্যে অত্যন্ত বিনয় ছিল। সেই কারণে গ্রন্থতে বলেছেন— নতুন কিছু দেখাবার সাধ্য তাঁর না থাকলেও বাক্যবিন্যাস বৈচিত্র্যের স্বাদ তিনি পূরণ করেছেন—

ন্যায়ৌষধিবনেভ্যোঽয়মাহৃতঃ পরমো রসঃ।

ইদমান্বীক্ষিকীক্ষীরান্নবনীতমিবোদ্ধৃতম্।।

কুতো বা নূতনং বস্তু বয়মুৎপ্রেক্ষিতুং ক্ষমাঃ। 

বচোবিন্যাসবৈচিত্র্যমাত্র বিচার্য্যতাম্।।

জয়ন্ত ভট্টের সময় কাশ্মীরের রাজা ছিলেন শঙ্করবর্মা বা যশোবর্মা। কলহনের রাজতরঙ্গিণী গ্রন্থে এই রাজার সম্পর্কে খারাপ কথাই বেশি পাওয়া যায়। জয়ন্ত ভট্ট এই রাজার এত সুখ্যাতি করায় তাঁর রাজনৈতিক মত সম্পর্কে প্রশ্ন আসে।

অতএব রাজার কারাগারে বসে জয়ন্ত ভট ন্যায়মঞ্জরী রচনা করেছিলেন এই কাহিনীও প্রশ্নের সম্মুখীন হয়। রাঘবন প্রভৃতি পণ্ডিত অতি রাজভক্তির অভিযোগ থেকে জয়ন্ত ভট্টকে বাঁচাবার জন্য মন্তব্য করেছেন যে- জয়ন্ত ভট্ট নিশ্চয়ই রাজা শঙ্করবর্মা এবং রাণী সুগন্ধাদেবীর রাজত্বের প্রথমভাগ সম্পর্কে প্রশংসাবাক্য উচ্চারণ করেছেন, শেষভাগ সম্পর্কে নয়। জয়ন্ত ভট্ট সম্পর্কে চার্বাক দর্শনের এক গবেষক রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য্য বলেছেন— 'মনে হয় নয় শতকের দ্বিতীয় ভাগে কাশ্মীরে দুটি সমস্যা খুব বড়ো হয়ে দেখা দিয়েছিল। এক, বিভিন্ন বৈদিক ও অবৈদিক সম্প্রদায়ের মধ্যে ব্যাপক অনাচার, ভোগবিলাস ও যৌন উচ্ছৃঙ্খলতা আর তারই অনিবার্য প্রতিক্রিয়ায় যাবতীয় ধর্মমতের বিরুদ্ধেই প্রবল বিরাগ ও আপত্তি। জয়ন্ত ভট্টের মতো লোকেরা পড়েছিলেন ফাঁপরে। ধর্মবিরোধী মনোভাবকে রুখতে হলে ধর্মসম্প্রদায়গুলিকে আচারে আচরণে সৎ ও শালীন হতে হয়। কাশ্মীরে তখন ব্রাহ্মণ্যধর্মের নানা সম্প্রদায় ছাড়াও জৈন ও বৌদ্ধরাও ছিলেন। তাঁদের দলবলও নেহাত কম ছিল না। বড়োলোকেরা ছিলেন তাঁদের পৃষ্ঠপোষক। ফলে এই অবৈদিক সম্প্রদায়গুলিকে দমন করলেই কাজ হত না, বরং পরিস্থিতি আরো বিগড়ে যেত। অন্যদিকে আবার দমনমূলক ব্যবস্থা না নিলে সব সম্প্রদায়ই আরো উচ্ছৃঙ্খল হয়ে পড়বে। ফলে রাজশক্তির হস্তক্ষেপ ছাড়া পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণে আনার কোনো উপায় ছিল না। বল প্রয়োগ করে কতটা ফল পাওয়া যাবে সেই বিষয়ে জয়ন্ত ভট্টের সন্দেহ ছিল। তাই তিনি একইসঙ্গে রাজকীয় হস্তক্ষেপ ও প্রতিটি সম্প্রদায়ের আভ্যন্তরীণ চেষ্টা দিয়ে দুরাচার রোধ করার কথা বলেছিলেন। ন্যায়মঞ্জরীতে চার্বাকবাদে সব সম্প্রদায়ের আগম সম্পর্কে জয়ন্ত ভট্ট উদারতা দেখিয়েছেন।

ন্যায়মঞ্জরী ছাড়াও ধর্ম ও দর্শন বিষয়ে আগমডম্বর নামে একটা দৃশ্যকাব্য তিনি লেখেন। এটি ষন্মত নাটক নামেও খ্যাত। নাটকটি যে আদৌ অভিনয়ের যোগ্য নয় একথা নাট্যকার জানতেন। তর্ক বিতর্কের মাধ্যমে বিভিন্ন অবৈদিক ধর্ম ও দর্শনকে এখানে হেয় করে দেখানো হয়েছে। বৌদ্ধ ও জৈনদের সঙ্গে জয়ন্তর বিরোধ থাকলেও চার্বাকরাই তাঁর আসল শত্রু ছিলেন। কাদম্বরী কথাসারের রচয়িতা অভিনন্দ ছিলেন জয়ন্ত ভট্টের পুত্র।

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.