আর্যভট্ট


আর্যভট্ট (প্রথম)

৪৭৭ খ্রীষ্টাব্দে বর্তমান পার্টনার কাছে কুসুমপুর নামক স্থানে আর্যভট্ট জন্মগ্রহণ করেন। আর্যভট্ট সিদ্ধান্তের দ্বিতীয় অধ্যায়ের প্রথম শ্লোকে লেখক তাঁর জন্মবর্ষ ও গ্রন্থ রচনার কালের উল্লেখ করেছেন—

যষ্টাব্দানাং ষষ্টির্যদা ব্যতীতাম্রয়শ্চ যুগপাদাঃ।

ত্র্যধিকা বিংশতিরব্ধাস্তদেহ মম জন্মনোহতীতাঃ ।।

কলির ৩৬০০ বর্ষে আর্যভট্টের বয়স ছিল ২৩ বছর। 

এ থেকে বোঝা যায় যে ৪৭৬ খ্রীষ্টাব্দে আর্যভট্টের জন্ম। অনেকে কেরালাকে তাঁর জন্মস্থান মনে করেন। তা হলেও কুসুমপুরেই তিনি বাস করতেন। ঐতিহাসিক আবেরশীর রচনা থেকে জানা যায়—আর্যভট্টের জন্ম যেখানেই হোক তিনি কুসুমপুরের অধিবাসী ছিলেন। দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত বিক্রমাদিত্যের মৃত্যুর (৪১৫ খ্রীঃ) প্রায় ৫০ বছর পরে তাঁর আবির্ভাব। আর্যভট্টীয় ও মহাসিদ্ধান্ত নামে দুটি গ্রন্থ তিনি রচনা করেছিলেন এবং এর মাধ্যমেই ভারতে বিজ্ঞানভিত্তিক জ্যোতিষ শাস্ত্রের সূচনা হয়। বরাহমিহিরের আগেই তার নাম পৃথিবীতে ব্যাপ্ত হয়। এক কালে গ্রীকরা তাঁর নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করত অর্জুবেরিয়স বলে। আরবদের কাছে তিনি অর্জভর নামে খ্যাত ছিলেন।

আর্যভট্টীয় বা আর্যভট্টতন্ত্র গ্রন্থটি লেখকের তরুণ বয়সের রচনা এবং আর্যমহাসিদ্ধান্ত গ্রন্থ পরিণত বয়সের রচনা। দ্বিতীয় গ্রন্থটি প্রথম রচনার মার্জিত সংস্করণ হলেও এখানে আরো নতুন বিষয়ের আলোচনা আছে।

বৈদিক যুগ থেকেই জ্যোতিষশাস্ত্র এবং তার গণনা পদ্ধতি থাকলেও রাশিচক্র, নক্ষত্রচক্র, চন্দ্র বা সূর্যগ্রহণ ইত্যাদি গণনার কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি পাওয়া যায় না। জ্যোতিষের উপর উচ্চতর গাণিতিক পদ্ধতি প্রয়োগ করে বৈজ্ঞানিক জ্যোতিষের সূত্রপাত ঘটান আর্যভট্ট। কেবল ভারতবর্ষেই নয়, সমগ্র পৃথিবীতেই তিনি প্রথম ব্যক্তি যিনি জ্যোতির্বিদ্যার ক্ষেত্রে উচ্চগণিতের প্রয়োগ করেছিলেন।

আর্যভট্টীয় গ্রন্থটি চারটি ভাগে বিভক্ত কালক্রিয়া, গোলপাদ, গীতিকাপাদ ও গণিতপাদ। প্রথম তিনটি অংশে উন্নত জ্যোতির্বিদ্যা এবং শেষ অংশে বিশুদ্ধ গণিতের আলোচনা পাওয়া যায়। গীতিকা অংশটি দশটি শ্লোকে রচিত বলে একে বলা হয় দশগীতিক। এখানে বিভিন্ন স্বর ও ব্যঞ্জনের সাহায্যে সংখ্যার পরিভাষাগুলি বলা হয়েছে। পাটিগণিতের সংখ্যা প্রকাশের ক্ষেত্রে এক অভিনব পদ্ধতির উদ্ভাবন করেছিলেন আর্যভট্ট। ১ থেকে ২৫ পর্যন্ত সংখ্যাগুলিকে ক থেকে ম পর্যন্ত ২৫টি ব্যঞ্জনবর্ণের দ্বারা সূচিত করেছেন। য, র, ল, ব, শ, ষ, স ও হ কে ধরেছিলেন যথাক্রমে ৩০, ৪০, ৫০, ৬০, ৭০, ৮০, ৯০ ও ১০০ । প্রত্যেকটি ব্যঞ্জনবর্ণের উচ্চারণের জন্য অ এই স্বরবর্ণের দরকার হয় বলে তার মান—১। ই-এর মান ১০০, উ-এর মান ১০০০০, ঋ-এর মান ১০০০০০০০ এবং ৯, এ, ঐ, ও ঔ-এর মান ১০০ গুণ করে বাড়িয়ে বিশাল সংখ্যার নির্দেশের পদ্ধতি গ্রহণ করেন। গণিতপাদে পাটিগণিতের আলোচনা আছে। কালক্রিয়াপাদ হল কাল গণনার আলোচনা। গোলপাদ জ্যোতির্বিজ্ঞানের আলোচনা। কালক্রিয়াপাদে বর্ষবিভাগ দেখাতে গিয়ে বলা হয়েছে—১২ মাসে ১ বছর, ৩০ দিনে ১ মাস, ১ দিনে ৬০ নাড়ী এবং এক নাড়ীতে ৬০ বিনাড়ী। ১৬ শতাব্দী পর্যন্ত পাশ্চাত্যের পণ্ডিতদের ধারণা ছিল পৃথিবী স্থির। অথচ পঞ্চম শতাব্দীতে আর্যভট্ট বলেছিলেন——চলাপৃথ্বী'। পাশ্চাত্য জ্যোতির্বিদ গ্যালিলিও, কোপার্নিকাস প্রভৃতির বহু পূর্বে আর্যভট্ট তাঁর গোলপাদে পৃথিবীর আহ্নিক গতির কথা স্পষ্টভাবে বলেছেন। আকাশে সূর্য ও নক্ষত্রদের আমরা পূর্ব থেকে পশ্চিমে পরিক্রমণ করতে দেখতে পাই—

অনুলোমগতিনৌস্থঃ পশ্যতা চলম্ বিলোমগং যত্। 

অচলানি ভান্তি তদ্বৎ সমপশ্চিমগামী লঙ্কায়াম্।।

অর্থাৎ নৌকায় চড়ে যখন কোনো আরোহী সামনের দিকে অনুলোম গতিতে যেতে থাকে, তখন নদীতীরের পাহাড়, গাছ ইত্যাদি অচল বস্তুকে পিছনের দিকে বিলোমগতিতে ছুটতে দেখা যায়। তেমনিভাবেই পৃথিবীর ঘূর্ণনের ফলে নিরক্ষীয় লঙ্কায় স্থির নক্ষত্রগুলিকে সমবেগে পশ্চিমে ধাবমান দেখা যায় ।

আর্যভট্টের এই সর্বাধুনিক তত্ত্ব তৎকালীন সমস্ত পণ্ডিতই নির্দ্বিধায় গ্রহণ করেন নি। বরাহমিহির প্রভৃতি এই মতের প্রতিবাদ করে গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। আর্যভট্টের তত্ত্বের মতোই তাঁদের তত্ত্বও পৃথিবীতে বিশেষ খ্যাতিলাভ করেছিল। পৃথিবীর আকৃতি যে গোল তাও স্পষ্টভাবে আর্যভট্ট ঘোষণা করেছিলেন—

যদ্বৎ কদম্বপুষ্পগ্রন্থিঃ প্রচিতঃ সমস্ততঃ কুসুমৈঃ ।

তদ্বদ্ধি সর্বসত্ত্বৈজলঞ্জৈ স্থলজৈশ্চ ভূগোলঃ।।

অর্থাৎ পৃথিবী কদমফুলের মত গোল এবং তার চারদিক স্থলজ ও জলজ জন্তুর দ্বারা পরিব্যাপ্ত।


দশগীতিকের প্রথম শ্লোকেই বলেছেন—৩৬৫ দিন ৬ ঘণ্টা ১২ মিনিটে সূর্য বর্ষচক্রকে আবর্তন করে। এখানেই বলা হয়েছে প্রতিটি গ্রহের আবর্তন পথ সূর্যপথের সঙ্গে সংযুক্ত। অন্যান্য গ্রহের তুলনায় সূর্যপথ থেকে চন্দ্রের বিচ্যুতি সর্বাধিক সাড়ে চার ডিগ্রী বা ২৭০ মিনিট। পৃথিবী স্থির নয়; সচল। এই সিদ্ধান্ত সকলে যে মেনে নেবে না সেকথা আর্যভট্ট জানতেন, তাই দশগীতিকের শেষে অর্থবাদমুখে বলেছেন—এই নক্ষত্রপুঞ্জের মধ্যে যিনি ভূগ্রহচরিত অবগত হবেন তিনি গ্রহণকে ভেদ করে পরব্রহ্মে গমন করবেন।


আর্যভট্টের রচনাতেই প্রথম ত্রিকোণমিতির পরিচয় পাওয়াযায়। ‘সাইন’কে তিনি জ্যার্ধ ধরেছিলেন এবং জ্যার্ধের একটি সারণীও প্রস্তুত করেছিলেন। তিনি গ্রহগতির ব্যাখ্যা করেছিলেন পরিবৃত্ত ও উৎকেন্দ্রীয় বৃত্তির সাহায্যে। গণিতে এনার বড় কীর্তি 'পাই' এর মান নির্ণয়। তিনিই প্রথম গণিতজ্ঞ যিনি পরিধি ও ব্যাসের অনুপাতের সাংখ্যমান ৪ দশমিক স্থান পর্যন্ত নির্ভুলভাবে বলেছিলেন। ঘনমূল, বর্গমূল, দ্বিঘাতসমীকরণ প্রভৃতির হিসাবও তাঁর অবদান। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ভারতবর্ষ যে প্রথম উপগ্রহটি মহাকাশে স্থাপন করেছিল সেটির নামকরণ করেছিল আর্যভট্ট। আর্যভট্ট সিদ্ধান্তগুরু নামেও পরিচিত। এনার গ্রন্থের টীকাকারদের মধ্যে নাটদেব, প্রথম ভাস্কর, লল্লাচার্য্যের নাম উল্লেখযোগ্য।

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.