পণ্ডিত অযোধ্যা প্রসাদ

 


শিকাগো, আমেরিকার বিশ্ব ধর্ম সম্মেলনে বৈদিক ধর্মের ডঙ্কা বাজানো আর্য পণ্ডিত অযোধ্যা প্রসাদ
 


বৈদিক সাধনা আশ্রম তপোবন, দেরাদুনের গ্রীষ্মোৎসবে যমুনানগরের বাসিন্দা বিখ্যাত আর্য পণ্ডিত শ্রী ইন্দ্রজিৎ দেব উপস্থিত ছিলেন। আমরা তাঁর সঙ্গে কিছু বিষয়ে আলোচনা করেছিলাম। বিবেকানন্দের প্রসঙ্গ উঠলে তিনি আমাদের পণ্ডিত অযোধ্যা প্রসাদ বৈদিক মিশনারি সম্পর্কে একটি প্রবন্ধ লিখার প্রেরণা দেন। সেই আলোচনার ফলস্বরূপ এই প্রবন্ধের জন্ম। আমাদের আলোচনায় উঠে আসে যে বিবেকানন্দের শিকাগো পৌঁছানো, সেখানে বিশ্ব ধর্ম সংসদে বক্তৃতা দেওয়া এবং তাঁর অনুগামীদের দ্বারা তাঁর ব্যাপক প্রচারের ফলেই তিনি আজ দেশে-বিদেশে জনপ্রিয়। বর্তমানে যুগ হলো প্রচারের যুগ। যার প্রচার ভালো হবে, সেই মানুষকে সবাই জানবে, আর যার প্রচার হবে না, সে গুরুত্বপূর্ণ হলেও অস্তিত্বহীন হয়ে পড়বে। স্বামী বিবেকানন্দ ব্যাপক প্রচার পাওয়ার কারণে বিখ্যাত হয়েছেন। কিন্তু মহর্ষি দয়ানন্দের ভক্ত পণ্ডিত অযোধ্যা প্রসাদ, যিনিও বিশ্ব ধর্ম সভা ও আমেরিকায় বৈদিক ধর্মের ব্যাপক প্রচার করেছিলেন কিন্তু তাঁর অনুগামীরা তাঁর এই কর্মের প্রচার করতে ব্যর্থ হওয়ায় তিনি ইতিহাসের পৃষ্ঠায় অবহেলিত হয়েছেন। আমাদের এই প্রবন্ধ সেই বৈদিক ধর্ম প্রচারক পণ্ডিত অযোধ্যা প্রসাদজী কে স্মরণ করার একটি ক্ষুদ্র প্রয়াস।

পণ্ডিত অযোধ্যা প্রসাদ কে ছিলেন ? এবং তাঁর কর্ম ও ব্যক্তিত্ব কেমন ছিল? এই প্রশ্নগুলির কিছু উত্তর এই প্রবন্ধে দেওয়ার চেষ্টা করা হবে। পণ্ডিত অযোধ্যা প্রসাদ একজন অসাধারণ বক্তা, দার্শনিক পণ্ডিত, চিন্তক এবং মনীষী ছিলেন। তিনি শিকাগোর বিশ্ব ধর্ম সম্মেলন সহ কয়েকটি দেশে বৈদিক ধর্ম প্রচার করেছিলেন। তাঁর জন্ম ১৬ মার্চ ১৮৮৮ সালে বিহার রাজ্যের গয়া জেলার নওয়াদা তহসিলের 'আমাওয়া' গ্রামে হয়েছিল। তাঁর পিতার নাম ছিলো বংশীধরলাল এবং মাতা ছিলেন শ্রীমতী গণেশকুমারী। তাঁর দুটি ভাই ও একটি বোন ছিল। তাঁর পিতা রাঁচির ডেপুটি কমিশনারের কার্যালয়ে একজন বেঞ্চ টাইপিস্ট ছিলেন। তিনি ইংরেজি, উর্দু, আরবি ও ফার্সির একজন ভালো পণ্ডিত ছিলেন। বলা হয়, বংশীধর লাল জীর ইংরেজি ওয়েবস্টার অভিধান সম্পূর্ণ মুখস্থ ছিল। 

শৈশবে পণ্ডিত অযোধ্যা প্রসাদ কিছু তান্ত্রিকের সংস্পর্শে আসেন, যার ফলে তন্ত্রের প্রতি তাঁর আগ্রহ বেড়ে যায় এবং এই উন্মাদনা এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে তিনি শ্মশানে তন্ত্র সাধনা করতে শুরু করেন। তাঁর এই আগ্রহ ও কাজে তাঁর পিতামাতা ও পরিবারের লোকেরা হতাশ হন। তাঁকে এই ভুল পথ থেকে সরানোর জন্য তাঁরা চেষ্টা করেন, এবং সেই প্রচেষ্টা সফল হয়। ছেলেবেলায় তাঁর পিতা তাঁর শিক্ষার জন্য একজন মৌলভিকে নিযুক্ত করেন, যিনি তাঁকে উর্দু, আরবি ও ফার্সি শেখাতেন। তীক্ষ্ণ বুদ্ধির কারণে তিনি এই ভাষাগুলিতে দক্ষতা অর্জন করেন এবং এগুলিতে বক্তৃতা দেওয়া শুরু করেন।

তবে এই ভাষাগুলির প্রভাবের কারণে অযোধ্যা প্রসাদ কিছুটা নিজের ধর্ম থেকে বিচ্যুত হয়ে ইসলামের দিকে আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। মহর্ষি দয়ানন্দও বলেছিলেন যে একজন ব্যক্তি যে ভাষা পড়েন, সেই ভাষার প্রভাব তার ওপর পড়ে। বৈদিক ধর্মের নিকটবর্তী হওয়ার জন্য সংস্কৃত ও হিন্দির অধ্যয়ন আবশ্যক, নইলে এটি একটি কঠিন কাজ। অযোধ্যা প্রসাদ জী উর্দু, ফারসি ও আরবি ভাষার জ্ঞান অর্জন করার পর 'গনিমত' ছদ্মনামে এসব ভাষায় কবিতা রচনা করতে শুরু করেন। প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী ১৬ বছর বয়সে তার বিবাহ সম্পন্ন হয় নিকটবর্তী গ্রামের বাসিন্দা শ্রী গিরিবরধারী লালের কন্যা কিশোরী দেবীর সাথে, যিনি বিয়ের সময় মাত্র সাড়ে ৯ বছরের ছিলেন।

পণ্ডিত অযোধ্যা প্রসাদজী তার বন্ধু পণ্ডিত রমাকান্ত শাস্ত্রীকে তার আর্যসমাজী হওয়ার কাহিনী শুনিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন যে তার পরিবার ইসলাম ও খ্রিস্ট মতের ভাবনায় প্রভাবিত ছিল। এর ফলে তার বাবা তাকে একজন আলিম ফাজিল মৌলভির মাদ্রাসায় উর্দু ও ফারসি পড়ার জন্য ভর্তি করান। 

একদিন তার মামা তাকে জিজ্ঞেস করেন, "অযোধ্যা, আজকাল তুমি কী পড়ছো?" অযোধ্যা প্রসাদ মৌলভি সাহেবের প্রশংসা করে ইসলামী মতের ভালো দিকগুলো বলেন এবং একই সঙ্গে তার মামাকে হিন্দুধর্মের খারাপ দিকগুলোও জানান, যা হয়তো তাকে মৌলভি সাহেব বলেছিলেন অথবা তিনি নিজেই অভিজ্ঞতা করেছিলেন। তবে পণ্ডিতজীর মামা একজন কট্টর আর্যসমাজী ছিলেন। তিনি তাঁকে মহর্ষি দয়ানন্দের লেখা 'সত্যার্থ প্রকাশ' দেন এবং বলেন, "যদি তুমি এই বইটি পড়তে, তাহলে সনাতন ধর্মে কোনো খারাপ দিক দেখতে না এবং অন্য ভালো দিকগুলো তোমার কাছে প্রকাশিত হতো না।" মামার অনুপ্রেরণায় অযোধ্যা প্রসাদ 'সত্যার্থ প্রকাশ' পড়তে শুরু করেন।

প্রথমে তিনি 'সত্যার্থ প্রকাশ'-এর চতুর্দশ সমুল্লাস পড়েছিলেন, যেখানে ইসলামী মতবাদের আলোচনা করা হয়েছে। এরপর ত্রয়োদশ সমুল্লাস পড়ে তিনি খ্রিস্টান ধর্মের সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করেন। তিনি তার শিক্ষক মৌলভী সাহেবকে ইসলামের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে প্রশ্ন করতে শুরু করেন। পণ্ডিতজীর প্রশ্ন শুনে মৌলভি সাহেব হতবাক হন। কালক্রমে পণ্ডিত অযোধ্যা প্রসাদ আর্য সমাজ এবং এর প্রতিষ্ঠাতা মহর্ষি দয়ানন্দ সম্পর্কে জানতে পারেন এবং আর্য সমাজের সদস্য হন। মহর্ষি দয়ানন্দের ভক্ত আর্যসমাজের শাস্ত্রার্থ মহারথী পণ্ডিত লেখরাম জীর লেখা ‘হিজ্জুতুল ইসলাম’ পড়ে তিনি কুরআন পড়তে আগ্রহী হন এবং বিভিন্ন মতবাদের (religion) এর গ্রন্থ সমূহ অধ্যয়নে মনোনিবেশ করেন।


পণ্ডিতজী ১৯০৮ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষা উত্তীর্ণ করেন। পরবর্তী শিক্ষার জন্য তিনি হাজারিবাগের সেন্ট কলম্বাস কলেজে ভর্তি হন। সেখানে তিনি বিপ্লবীদের সংস্পর্শে আসেন এবং দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে জড়িত হয়ে যান। তার পিতা তাকে হাজারিবাগ থেকে সরিয়ে ভাগলপুরে পাঠান, যেখানে তিনি ১৯১১ সালে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তার বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের কারণে তার পিতা ক্ষুব্ধ হন এবং তার পড়াশোনা এবং জীবিকার্থে আর্থিক সহায়তা বন্ধ করে দেন। এমন সময়ে রাঁচির বিশিষ্ট আর্যসমাজ নেতা শ্রী বালকৃষ্ণ সহায় তার পিতা ও পণ্ডিতজীর মধ্যে সমঝোতা করার চেষ্টা করেন। শ্রী বালকৃষ্ণ সহায়ের অনুপ্রেরণায় পণ্ডিত অযোধ্যা প্রসাদ পাটনার মহামহোপাধ্যায় পণ্ডিত রামাবতার শর্মার কাছে সংস্কৃত ভাষা এবং বৈদিক ধর্ম গ্রন্থসমূহের গভীর অধ্যয়ন করেন। সংস্কৃত জ্ঞান ও শাস্ত্রবিদ্যায় দক্ষতা অর্জনের জন্য তিনি তার বিদ্যা-গুরু মহামহোপাধ্যায়জী কে সর্বদা কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করতেন।


পাটনায় সংস্কৃত এবং বৈদিক ধর্মগ্রন্থ সমূহের গভীর অধ্যয়নের পর, পণ্ডিত অযোধ্যা প্রসাদ ১৯১১ সালে কলকাতায় আসেন এবং হিন্দু হোস্টেলে থাকতে শুরু করেন। সেখানে পাঞ্জাবের বিখ্যাত নেতা ডা. গোকুল চাঁদ নারাং এবং বাবু রাজেন্দ্র প্রসাদসহ আরও অনেক ছাত্র অবস্থান করতেন। পরে বাবু রাজেন্দ্র প্রসাদ ভারতীয় রাজনীতির শীর্ষে পৌঁছান। অযোধ্যা প্রসাদ প্রথমে প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন এবং পরে সিটি কলেজে ভর্তি হন। এখানে তিনি ইতিহাস, দর্শন এবং ধর্মতত্ত্বের তুলনামূলক অধ্যয়ন করেন। তিনি প্রায়ই জ্ঞানপিপাসা মেটানোর জন্য বিভিন্ন মতবাদের গ্রন্থাগারে গিয়ে তাদের পুস্তকাদি মনোযোগ সহকারে পড়তেন এবং পছন্দের বই কিনে নিতেন।


কলকাতায় অবস্থানকালে বিহারের ছাত্ররা "বিহার ছাত্রসংঘ" নামে একটি সংগঠন গঠন করেন, যার সভাপতি ছিলেন বাবু রাজেন্দ্র প্রসাদ এবং মন্ত্রী ছিলেন অযোধ্যা প্রসাদ। ১৯১৫ সালে তিনি বিএ পাস করেন এবং এরপর এমএ এবং আইন পরীক্ষার প্রাথমিক অংশও পাস করেন। এ সময় তিনি কলকাতার আর্য সমাজের সংস্পর্শে আসেন এবং সেখানে নিয়মিত বক্তৃতা দিতে শুরু করেন। তিনি আর্য সমাজের পুরোহিত ও উপদেশকের দায়িত্বও গ্রহণ করেন। তার অসাধারণ বাগ্মীতা, সূক্ষ্ম যুক্তিবাদী চিন্তা, স্বাধ্যায় এবং শাস্ত্রজ্ঞান দিয়ে সেখানে উপস্থিত সকল আর্য সমাজীদের গভীরভাবে প্রভাবিত করেন। স্বাধ্যায়ের প্রতি গভীর আগ্রহের ফলে, পণ্ডিত অযোধ্যা প্রসাদ বৌদ্ধ, খ্রিস্টান এবং ইসলামী মতবাদের পুস্তকগুলোর বিস্তৃত ও গভীর অধ্যয়ন করেন। 

১৯২০ সালে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য শুরু হওয়া অসহযোগ আন্দোলনে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। সেই একই বছরে, কলেজ স্কোয়ারে ‘সত্যার্থ প্রকাশ’-এর ষষ্ঠ সমুল্লাসে বর্ণিত রাজধর্ম বিষয়ে বক্তৃতা দেওয়ার সময়, তাকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে এবং আদালত তাকে দেড় বছরের কারাদণ্ড দেয়। তিনি আলিপুরের কেন্দ্রীয় কারাগারে এই শাস্তি ভোগ করেন। কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর, তিনি একটি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হন।

পণ্ডিত অযোধ্যা প্রসাদজীর বিদেশে বৈদিক ধর্ম প্রচারের ইচ্ছা ছিল। ইসলামিক দেশগুলিতে গিয়ে বৈদিক ধর্ম প্রচার করারও তার গভীর ইচ্ছা ছিল। ১৯৩৩ সালে শিকাগোতে অনুষ্ঠিত বিশ্ব ধর্ম সম্মেলন উপলক্ষে তার বিদেশে ধর্মপ্রচার করার ইচ্ছা পূরণের সুযোগ আসে। আর্য সমাজ কলকাতা এবং মুম্বাইয়ের আর্য সজ্জনবৃন্দের প্রচেষ্টায় পণ্ডিত অযোধ্যা প্রসাদ জী কে আন্তর্জাতিক ধর্ম সম্মেলনে বৈদিক ধর্মের প্রতিনিধি হিসেবে পাঠানো হয়। বিখ্যাত শিল্পপতি এবং সেঠ যুগল কিশোর বিড়লা জি পণ্ডিতজীর শিকাগো যাওয়ার জন্য আর্থিক সাহায্য প্রদান করেন। জুলাই ১৯৩৩-এ তিনি আমেরিকার উদ্দেশ্যে রওনা হন। বিশ্ব ধর্ম সম্মেলনে তাঁর ভাষণের বিষয় ছিল 'বৈদিক ধর্মের গৌরব এবং বিশ্ব শান্তি'। তিনি এই বিষয় নিয়ে শিকাগোতে বিশ্ব ধর্ম সম্মেলনে, একটি প্রভাবশালী বক্তৃতা প্রদান করেন। বৈদিক ধর্ম বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ধর্ম, এবং সময়ের দৃষ্টিকোণ থেকে এটি সবচেয়ে দীর্ঘকাল ধরে চলে আসছে। বেদের শিক্ষাগুলি সার্বজনীন এবং সার্বভৌম হওয়ায় বৈদিক ধর্মের গৌরব সর্বাধিক। বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠা বৈদিক জ্ঞান এবং শিক্ষার অনুসরণ ও অনুকরণ দ্বারা সম্ভব হতে পারে। এই বিষয়গুলি পণ্ডিত অযোধ্যা প্রসাদ বিশ্ব ধর্ম সভায় নানা যুক্তি এবং তর্ক দিয়ে উপস্থাপন করেন। পণ্ডিতজীর বিশ্ব ধর্ম সভায় এত প্রভাব ছিল যে, সেখানকার সভার কার্যক্রম বেদের প্রার্থনা মন্ত্র দিয়ে শুরু হতো এবং শান্তিপাঠ দিয়ে শেষ হতো। এটি পণ্ডিত অযোধ্যা প্রসাদজীর একটি বিশাল সাফল্য ছিলো। কিন্তু এ বিষয়ে দেশ এবং আর্য সমাজে খুব কম আলোচনা হয়েছে।

একই বিশ্ব ধর্ম সম্মেলনে পণ্ডিত জি বৈদিক এবং ভারতীয় অভিবাদন ‘‘নমস্তে’’ শব্দের একটি সুন্দর এবং প্রভাবশালী ব্যাখ্যা প্রদান করেন। তিনি বলেছিলেন যে, ভারতের আর্যরা দুই হাত জোড় করে এবং সেই হাতগুলো নিজের হৃদয়ের কাছে এনে মাথা নত করে ‘‘নমস্তে’’ শব্দ উচ্চারণ করেন। এই ক্রিয়াগুলির উদ্দেশ্য হল, ‘‘নমস্তে’’ দ্বারা আমরা আমাদের হৃদয়, হাত এবং মস্তিষ্কের সকল প্রবৃত্তির সমন্বয় করি। হৃদয় আত্মিক শক্তির প্রতীক, হাত শারীরিক শক্তির প্রতীক এবং মস্তিষ্ক মানসিক ও বৌদ্ধিক শক্তির কেন্দ্র। এইভাবে, ‘‘নমস্তে’’ উচ্চারণ এবং মাথা নত করে ও দুই হাত জোড় করে হৃদয়ের কাছে রেখে আমরা বলি, “….With all the physical force in my arms, with all mental force in my head and with all the love in my heart, I pay respect to the soul within you.” এই নমস্তে শব্দের ব্যাখ্যা সম্মেলনে আগত পশ্চিমী পণ্ডিতদের উপর গভীর এবং অসাধারণ প্রভাব ফেলে।

পণ্ডিতজী এই যাত্রায় উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকায়ও বৈদিক ধর্মের প্রশংসনীয় প্রচার করেছিলেন। তিনি এখানে প্রচার করার পর গায়ানা এবং ট্রিনিদাদে গিয়ে বৈদিক ধর্মের প্রসার ঘটান। ট্রিনিদাদে একজন কট্টর পৌরাণিক ব্যক্তি পণ্ডিত অযোধ্যা প্রসাদ জীকে খাবারের জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিলো। এই ব্যক্তি তার অজ্ঞতার কারণে পণ্ডিতজীকে আর্যসমাজের একজন বিদ্বান, প্রবল বক্তা এবং উপদেশক হিসেবে সনাতন ধর্মের বিরোধী মনে করতো এবং এই বিদ্বেষের কারণে পণ্ডিতজীকে বিষ মিশ্রিত খাবার খেতে দিয়েছিলো। যদিও পণ্ডিত জি খাবারের প্রথম গ্রাস খাওয়ার পর বিষের উপস্থিতি বুঝতে পেরেছিলেন। ফলে তিনি বাকী খাবার ত্যাগ করেছিলেন। কিন্তু এই এক গ্রাস বিষমিশ্রিত খাদ্য তার স্বাস্থ্য ও জীবনকে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্থ করেছিল। পরে তিনি ট্রিনিদাদ থেকে লন্ডনে চলে আসেন। তখন বিষের প্রভাব তার শরীরে ছিল ফলে তাকে এখানে হাসপাতালে ৬ মাস ভর্তি থাকতে হয়। পণ্ডিতজীর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তাঁর শরীরে এই বিষের প্রভাব ছিলো।

লন্ডন থেকে পণ্ডিত জী ভারতে ফিরে আসেন এবং কলকাতাকে তার কর্মক্ষেত্র হিসেবে গ্রহণ করেন। তার জীবনের বাকী সময় আর্যসমাজের ধর্ম প্রচার, স্বাধ্যায়, চিন্তন ও মগ্নতায় ব্যয়িত হয়। পণ্ডিতজীর কাছে প্রায় ২৫ হাজার মূল্যবান ও দুর্লভ গ্রন্থের সংগ্রহ ছিল। মৃত্যুর আগে তিনি তাঁর এই বিশাল সংগ্রহ মহর্ষি দয়ানন্দ স্মৃতি ন্যাস টঙ্কারাকে দান করেন। ধারণা করা হয়, সেই সময়ে এই সমস্ত গ্রন্থের মূল্য ছিলো, প্রায় দুই লক্ষ টাকা । 

পণ্ডিত অযোধ্যা প্রসাদ জীর শেষ দিনগুলি সুখকর ছিল না। দুর্বল স্বাস্থ্য এবং হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি কলকাতার ৮৫ বহুবাজারে তার বাসস্থানে দীর্ঘকাল পীড়াগ্রস্থ অবস্থায় ছিলেন। ১১ মার্চ ১৯৬৫ তারিখে ৭৭ বছর বয়সে, বহু বছর ধরে শারীরিক কষ্ট ভোগের পর তিনি মৃত্যুলোক ত্যাগ করে পরম পিতার শরণে চলে যান। তাঁর মৃত্যুর কিছু বছর আগে তাঁর পত্নীও মৃত্যুবরণ করেছিলেন।

পণ্ডিতজীর জীবনের বেশিরভাগ সময় তাঁর স্বাধ্যায়, উপদেশ ও প্রবচনে ব্যয় হয়েছে। এজন্য তাঁর লেখা সাহিত্যের সংখ্যা খুব বেশি নয়। তিনি বক্তৃতা দান থেকে অবকাশ গ্রহণ করলে উৎকৃষ্ট মানের মূল্যবান সাহিত্য রচনা করতে পারতেন। কিন্তু তিনি ততোটা অবসর পান নি। তার রচিত সাহিত্যগুলির মধ্যে "ইসলাম কিভাবে ছড়িয়ে পড়েছে?", "ওম মহাত্ম্য", "বুদ্ধ ভগবান বৈদিক তত্ত্বের বিরোধী ছিলেন না", এবং "Gems of Vedic Wisdom" গ্রন্থগুলি অন্তর্ভুক্ত।

এই প্রবন্ধের তথ্যগুলো আর্য বিদ্বান ডা. ভবানী লাল ভারতীয়জীর প্রবন্ধ এবং অন্যান্য গ্রন্থ থেকে নেয়া হয়েছে। আমরা তাঁকে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা এবং ধন্যবাদ জানাচ্ছি। মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী সমগ্র ভারতবর্ষে বেদ এবং বৈদিক ধর্ম সংস্কৃতির প্রচার করেছিলেন। তিনি চাইতেন যে বেদের প্রচার বিশ্বব্যাপী হোক। তিনি নিজে বিদেশ গিয়ে বৈদিক ধর্ম প্রচার করতেও আগ্রহী ছিলেন । কিন্তু দেশের দুঃস্থ অবস্থার কারণে তাঁর বিদেশগমন আর হয়ে উঠেনি। যদি তিনি যেতেন, তাহলে অল্প সময়ের মধ্যে ইংরেজি ভাষা শিখে সেখানে প্রচার করতে পারতেন। সেখানে মানুষের সত্য গ্রহণের ক্ষমতা ভারতের জনগণের তুলনায় ভালো। আশা করা যায় তাঁরা মহর্ষির অনুভূতি এবং বেদসমূহের গুরুত্বকে যথাযথ সম্মান দিবেন।

দেখা যায় যে, মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতীর একক প্রচারের তুলনায় আজ বিশ্বব্যাপী হাজার হাজার আর্যসমাজ এবং কোটি কোটি বেদ অনুসারী থাকার পরও তেমন শক্তিশালী প্রচার হচ্ছে না। এটি সময়ের পরিহাস নাকি আর্যদের অলসতা? ঈশ্বর আর্যদের মহর্ষি দয়ানন্দজীর অসমাপ্ত কাজ কাজ সম্পূর্ণ করার শক্তি দান করুন।

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.