মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতীর সত্যনিষ্ঠা

 


মূর্ত্তিপূজার খণ্ডন লইয়া যখন কাশীতে ঘোর আন্দোলন চলিতেছিল, তাঁহাকে বিমর্দ্দিত করিবার নিমিত্ত যখন কাশীর চতুর্দ্দিকে আয়োজন করা হইতেছিল, তাঁহার বৈদিক ধর্ম্মের পতাকা যখন কাশীস্থ দেব-মন্দিরের চূঁড়াসমুহের উপহাস করিয়া উড়িতেছিল, তখন তথাকার কয়েকটি পণ্ডিত একদিন নিভৃতে আসিয়া বলিলেন,—“স্বামিজী! মূর্ত্তিপূজা লইয়া এত তোলপাড় করিতেছেন কেন? আপনি এ কথাটা ছাড়িয়া দেন, তাহা হইলে আমরা আপনাকে শঙ্করের অবতার বলিয়া গ্রহণ করি।” তদুত্তরে স্বামিজী বলিলেন—
 
“আমি অবতার পদের প্রার্থী নহি,—আমি সত্যের প্রার্থী। ভারতভূমিতে সত্য প্রতিষ্ঠিত হয়, ইহাই আমার একান্ত অভিলাষ।” 
 
তখন পণ্ডিতেরা আর বাঙ্‌নিষ্পত্তি না করিয়া চলিয়া গেলেন।
 
যখন তিনি লাহোর নগরে উপস্থিত হইয়া পঞ্চনদের অধিবাসীবর্গকে বৈদিক ধর্ম্মের অনুকূলে যার পর নাই উত্তেজিত করিয়া তুলিতেছিলেন, তখন একজন সুশিক্ষিত ও সম্ভ্রান্ত হিন্দুসন্তান স্বামিজীর সহচরদিগের নিকট আসিয়া বলিলেন,—“আপনারা স্বামিজীকে মূর্ত্তিপূজার কথাটা ছাড়িয়া দিতে অনুরোধ করুন, তাহা হইলে জম্বুর মহারাজা তাঁহার প্রতি সাতিশয় তুষ্ট হইবেন।” তাহা শুনিয়া দয়ানন্দ বলিয়া উঠিলেন,—
 
“আমি জম্বুর মহারাজাকে তুষ্ট করিব? নাকি বেদপ্রতিপাদিত ব্রহ্মকে তুষ্ট করিব? তোমরা এরূপ কথা আর আমার নিকট তুলিও না।”
 
[দয়ানন্দ হিন্দুর আদর্শ সংস্কারক; পৃষ্ঠা ২৫-২৬—শ্রীদেবেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়]
 
মহর্ষি দয়ানন্দ বলিতেছেন,—
 
“...যাহাতে তাঁহার শিষ্য হইয়া সেখানে থাকি, অখিমঠের মোহন্তটি তদ্বিষয়ে আমাকে বিশেষরূপ অনুরোধ করিতে লাগিলেন। এমন কি, তাহা হইলে তাঁহার অবিদ্যমানে আমি যে তথাকার মোহন্ত-পদে অধিষ্ঠিত হইয়া লক্ষ লক্ষ টাকার অধিপতি হইতে পারিব, এরূপ প্রলোভনও তিনি আমার সম্মুখে উপস্থিত করিলেন। মঠাধ্যক্ষের মুখে এবম্বিধ প্রস্তাব শুনিয়া আমি সরলভাবেই বলিলাম যে, যদি ধনসম্পদের প্রার্থী হইতাম, তাহা হহলে পিতার সংসার কখনই পরিত্যাগ করিয়া আসিতাম না। কেন না, আমার পিতৃসম্পদ এই মঠের যাবতীয় সম্পদ অপেক্ষা কোন অংশেই কম বা কোন প্রকারেই স্বল্প লোভনীয় নহে। অধিকন্তু আমি যে লক্ষ্য-সিদ্ধির নিমিত্ত সংসারের সম্পদরাশি পরিত্যাগ করিয়া আসিয়াছি, আপনি সম্ভবতঃ সে লক্ষ্যসিদ্ধির নিমিত্ত কখনও কোন প্রযত্ন করেন নাই,—সে লক্ষ্য সাধনোপযোগী বিদ্যাও বোধ হয় আপনাতে নাই। ইহা শুনিয়া মোহন্ত জিজ্ঞাসা করিলেন, সে লক্ষ্য কি? আমি বলিলাম,—যাহা ন্যায়, সত্য ও আত্মশুদ্ধির সাধন ব্যতিরেকে লাভ করা যায় না, সেই মুক্তি—সেই যোগবিদ্যা বা সেই নিগূঢ় বিদ্যাই আমার লক্ষ্য। যত দিন সে লক্ষ্য সিদ্ধ না হইবে, যত দিন আমাকে সাধনপথে থাকিতে হইবে; তত দিন অন্যান্য সাধনার সঙ্গে মনুষ্যের প্রতি মনুষ্যের যাহা কর্ত্তব্য, তাহা সাধিত করিয়া মনুষ্যমণ্ডলীকে জ্ঞান ও ধর্ম্মের দিকে উন্নীত করিবারও চেষ্টা করিব। ইহা শুনিয়া মোহন্ত অতীব সন্তুষ্ট হইলেন, এবং তাঁহার সংসর্গে আরও কিছুদিন থাকিবার জন্য অনুরোধ করিতে লাগিলেন।”
 
[দয়ানন্দের স্বরচিত জীবনবৃত্ত; পৃষ্ঠা ৩৩-৩৪—শ্রীদেবেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়]
 
স্বামিজী যখন এলাহাবাদে পৌরাণিক, মুহাম্মদ ও খৃষ্টমতের অযৌক্তিকতা নিরূপিত করিলেন, তখন কাশীনাথ শাস্ত্রী কতকটা অবজ্ঞা সহকারে স্বামিজীর প্রতি দৃষ্টিপাত পূর্ব্বক বলিলেন,—“আপনি কি জন্য একটা দেশ-ব্যাপক গোলমাল তুলিয়াছেন?” তদুত্তরে স্বামিজী গম্ভীর ভাবে বলিয়া উঠিলেন,—
 
“গোলমাল আমি তুলি নাই,—আমি আসিবার পূর্ব্বেই এতদ্দেশীয় পণ্ডিতেরা ভয়ানক গোলমাল তুলিয়া গিয়াছেন, এক্ষণে আমি তাঁহাদিগের গোলমাল প্রশমিত করিয়া সত্যের বাণী ধীরে ধীরে শোনাইবার চেষ্টা করিতেছি।” 
 
দয়ানন্দের এই প্রকার উত্তরে কাশীনাথ কিঞ্চিৎ অপ্রভিত হইলেন, এবং কোন কথা না বলিয়াই সহচরবর্গ সমভিব্যাহারে সভাস্থল হইতে প্রস্থান করিলেন।
 
[দয়ানন্দ চরিত; সপ্তম পরিচ্ছেদ, পৃষ্ঠা ২০৯-২১০—শ্রীদেবেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়]
 
মহর্ষি দয়ানন্দ সত্যনিষ্ঠার প্রতিমূর্ত্তি। যাহারা এই কথাটি মানিতে পারেন না, তাহাদিগকে বলি—
 
“লৌহখণ্ডের উপনেত্রটি চক্ষু হইতে সরাইয়া পক্ষপাত পরিত্যাগ পূর্ব্বক ন্যায়দৃষ্টি সহকারে অধ্যয়ন করুন। তাহা হইলেই মহর্ষির সত্যনিষ্ঠা বিলক্ষণ বুঝিতে পারিবেন।” 
 
দেখুন—মহর্ষিকে যখন লোকগণ নানাপ্রকারে বিভিন্ন বস্তু, গৌরবান্বিত পদের লোভ দেখাইতে লাগিলেন, মহর্ষি তখন সত্য হইতে বিচ্যুত হন নাই। তিনি ইচ্ছা করিলেই নিজেকে ঈশ্বরাদিষ্ট অবতার বলিয়া প্রতিপাদন করতে পারিতেন, কিন্তু তিনি তাহা করেন নাই। বরং বলিয়াছেন—
 
“হে প্রিয় ভারতবাসী, আমি তোমাদের নিকট নূতন কোন ধর্ম্ম প্রচার করিতে আসি নাই, আমি আসি নাই কোন নবী বা অবতার সাজিতে, আমি শুধু তোমাদের সেই পবিত্র বাণী স্মরণ করাইয়া দিতে আসিয়াছি যা, প্রিয় আর্য্যভূমির সহস্র বছরের গ্লানিতে ম্রিয়মাণ হইয়া পড়িয়াছিল।” 
 
তিনি সর্ব্বদাই প্রাচীন ঋষিদিগের পদাঙ্ক অনুসরণ করিয়াই চলিতেন। তাঁহার সমস্ত কার্য্যই বৈদিক পন্থার অনুসারিণী।
 
বেদে মূর্ত্তিপূজা নাই, উপরন্তু তাহা বেদবিরুদ্ধ বলিয়া তিনি তাহার ঘোর বিরোধী ছিলেন এবং তজ্জন্যই তিনি মূর্ত্তিপূজার মূলোচ্ছেদনে বদ্ধপরিকর হইয়াছিলেন। তিনি তাঁহার শেষ নিঃশ্বাস পর্য্যন্ত সত্য ও বেদপ্রতিপাদিত পন্থার পালন করিয়াই গিয়াছেন। স্বীয় মৃত্যুকাল আসন্ন সময়ে যখন কতকগুলি সন্ন্যাসী আসিয়া দয়ানন্দকে প্রোথিত করার নিমিত্ত অপেক্ষা করিতেছিল, তখনও তিনি ক্ষীণ কণ্ঠে শিষ্যদিগকে বলিয়া উঠিলেন—
 
“তোমরা আমার শরীরকে ভস্মীভূত করিয়া দিবে, কারণ বেদে ইহাই বর্ণিত হইয়াছে, শরীরকে প্রোথিত করা বিধেয় নহে।” 
 
যিনি নিদারুণ মৃত্যু যন্ত্রণার মধ্যেও বেদমহিমা বিঘোষিত করেন, মৃত্যুর করালগ্রাসে গ্রাসিত হইয়াও যিনি শাস্ত্রবিধি মানিয়া চলেন, এবং তাহা অক্ষুণ্ণ রাখিবার নিমিত্ত শিষ্যদিগকে উপদেশ করেন, বলিতেছি—তাঁহার মত সত্য ও বেদনিষ্ঠ আচার্য্য ভারতবর্ষে কতজন জন্মগ্রহণ করিয়াছেন?

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.