মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতীকে ৪৩ বার হত্যা এবং অপমানের চেষ্টা সমূহ


মহর্ষির প্রামাণ্য জীবনীগ্রন্থ সমূহের আলোকে প্রস্তুতকৃত প্রবন্ধ। 

আর্যসমাজের অনেক প্রচারক, ভজনোপদেশক, বক্তা ও ভক্তদের প্রায়শই বলতে শোনা যায় যে, ' মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতীকে ' ষোল বার (কারো মতে সতেরো বার) বিষ দিয়ে হত্যার চেষ্টা করা হয়। 

মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতীর প্রামাণিক জীবনীগ্রন্থ সমূহের  মধ্যে সর্বাগ্রগণ্য গ্রন্থসমূহ হচ্ছে -

১. ' महर्षि दयानन्द का जीवन चरित्र '  তথা মহর্ষি দয়ানন্দ কা জীবন চরিত্র। লেখক- পণ্ডিত লেখরাম জী। 

[প্রকাশক- আর্য সাহিত্য প্রচার ট্রাস্ট, ৪৫৫, খারী বাবলী, দিল্লী]

 

২.' দয়ানন্দ চরিত '।  লেখক- বাবু শ্রী দেবেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় এবং হিন্দি অনুবাদক- পণ্ডিত শ্রী ঘাসীরাম এম. এ. এল. এল. বি. এডভোকেট মেরঠ। 

[প্রকাশক- গোবিন্দরাম হাসানন্দ, ৪৪০৮, নয়া সড়ক দিল্লী-৬]

 

৩. ' नव जागरण की पुरोधा दयानन्द सरस्वती ' তথা নব জাগরণের পুরোধা দয়ানন্দ সরস্বতী। লেখক- ডা. ভবানীলাল ভারতীয়। 

[প্রকাশক- বৈদিক পুস্তকালয়, পরোপকারীনি সভা, দয়ানন্দ আশ্রম, আজমের]


  • 📖 উপরোক্ত প্রামাণিক গ্রন্থসমূহের সহায়তায় এই প্রবন্ধটি প্রস্তুত করা হলো। 📖

একথা সবার জ্ঞাত যে মহর্ষি শ্রীমদ্দয়ানন্দ সরস্বতীজী মহারাজ সত্যের এক প্রবল উপাসক এবং পোষক ছিলেন। সারা জীবন তিনি বড় বড় প্রলোভনকে উপেক্ষা করে সতত সত্যাচরণ ও সত্যের পালনই করে গেছেন। মহর্ষি চাইতেন যে, তাঁর বিষয়েও যেন কখনো কোনো অসত্য প্রতিপাদন না করা হয়। যদিও নিজের প্রশংসার অভিলাষ তাঁর ছিল না। মহর্ষির পত্রব্যবহারে তা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়। মহর্ষির পত্রব্যবহারের সংগ্রহমূলক গ্রন্থ '  स्वामीजी के पत्र एवं विज्ञापन ' সম্পাদক- পণ্ডিত ভগবদ্দত্ত বি. এ.। প্রকাশক- রামলাল কাপুর ট্রাস্ট, বহালগড় (সোনীপথ, হরিয়ানা)। এই গ্রন্থটি চার ভাগে প্রকাশিত হয়েছিলো। এর দ্বিতীয় ভাগের, পৃষ্টাসংখ্যা-৬৯৫, পূর্ণসংখ্যা ৬৬৮ এ উদ্ধৃত পত্রটি ফর্রুখাবাদবাসী 'পণ্ডিত গোপালরাও হরি' এই নামে মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী দ্বারা লিখিত হয়েছিলো। পত্রটির বঙ্গানুবাদ এখানে উপস্থাপন করা হলো-


পণ্ডিত গোপালরাও হরিজী। আনন্দে থাকুন।

আজ এক সাধুর পত্র আমার কাছে এলো। এটা আমি আপনার কাছে প্রেরণ করছি। সাধুর লিখা সত্য, কিন্তু আপনি চিতোর সম্পর্কিত ইতিহাস না জেনেই কোথায় থেকে কি শুনে তা লিখে দিয়েছেন।, তখন সেখানে আমার সাথে উদয়পুরাধীশের কেবল তিনবার ই সাক্ষাৎ হয়েছিলো। কিন্তু আপনি প্রতিদিন দুই বার হতো লিখেছেন। আপনি জানেন যে, এসব ভুল শুদ্ধিকরণের মতো অবসর আমার হাতে নেই। যদিও আপনি সত্যপ্রিয় এবং শুদ্ধ ভাব-ভাষিত ব্যক্তি এবং এমন হিত চিত্তে উপকারী কর্মই করছেন ; কিন্তু যদি আমার ইতিহাস আপনার ঠিকঠাক জানা না থাকে তাহলে সেটা লিখার সাহস করবেন না। কেননা সামান্য অসত্য হওয়াতেও কোনো নির্দোষ কৃত্য দূষিত হতে পারে। এটা নিশ্চিত জেনে রাখুন। এবং এই পত্রের উত্তর শীঘ্রই পাঠান। 

বৈশাখ শুক্ল, ২ সম্বৎ ১৯৩৯, স্থান-শাহপুরা। 

(দয়ানন্দ সরস্বতী) 


এই পত্র পাঠ করে সর্বদা সত্যের প্রতিপাদন করা প্রত্যেক আর্যসমাজীর পরম কর্তব্য হয়ে যায় । আমরা মহর্ষির মিথ্যা প্রশংসাবাক্য কীর্তন করে তাঁর কীর্তিকে উজ্জ্বল করবো না। কেননা মিথ্যার সাহায্য নিয়ে, মহর্ষির সম্পর্কে যদি কোনো প্রশংসাসূচক বাক্য বলা হয় তাহলে সেটা তাঁর সিদ্ধান্ত এবং আদর্শের বিরোধী হয়ে যায়। এজন্য আমাদের সবাইকে বিশেষভাবে সতর্ক থাকা উচিত। 

 

এই সব বিষয় বিবেচনায় রেখে আমি উপরোক্ত তিন গ্রন্থ অধ্যয়ন করি। এবং যেখানেই মহর্ষিকে হত্যার চেষ্টার উল্লেখ পেয়েছি, যেমন- খাবারে বিষ দিয়ে, ইট-পাথর ছুড়ে মেরে, এবং লাঠির প্রহার ইত্যাদির দ্বারা হত্যাচেষ্টার সব ঘটনাসমূহ খুবই সাবধানতার সাথে একত্রিত করেছি। এবং সেসমস্থই এই প্রবন্ধে উপস্থাপন করেছি। 

 

উল্লেখ্য, মহর্ষি দয়ানন্দজী গুরু বিরজানন্দজীর কাছে বিদ্যা অর্জনের পর গুরুদক্ষিণা হিসেবে, কুরীতি, পাখণ্ডতা, ও অন্ধবিশ্বাস থেকে ভারতবর্ষকে মুক্ত করার প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করেন। তদানুসারে মহর্ষি পাখণ্ডিদের মতবাদ খণ্ডন করা শুরু করেন, স্থানে স্থানে নিজের প্রভাবশালী বক্তৃতা দেন, পৌরাণিক, এবং ম্লেচ্ছ-যবনাদি মতের পণ্ডিতদের সাথে বিভিন্ন বিষয়ে শাস্ত্রার্থ করে  একে একে সমস্ত অবৈদিক মতবাদীদের ধূলিসাৎ করে দেন। সাথে সাথে অনার্ষ গ্রন্থসমূহের প্রবল খণ্ডনও শুরু করেন। এভাবে এক মহর্ষি দয়ানন্দ পুরো পাখণ্ডিকুলে ত্রাহিত্রাহি কোলাহল বাধিয়ে দেন। নিজেদের ভ্রান্তমত মহর্ষির দ্বারা এভাবে খণ্ডিত হওয়ার ফলে পুরো পাখণ্ডিকুল মহর্ষির উপর ক্ষেপে যায়। এবং তাঁকে হত্যার চেষ্টা তখন থেকেই শুরু হয়।  মহর্ষি ১৮৬৩ সালে নিজ গুরুদেব বিরজানন্দজীর গৃহ ত্যাগ করেন। 


মহর্ষির প্রামাণ্য জীবনীগ্রন্থ সমূহের বর্ণনা অনুসারে মহর্ষির প্রাণহরণ ও অপমানের চেষ্টার ঘটনাসমূহ নিম্নরূপ-


(ঘটনা- ১) ১৮৬৮ সালের এপ্রিল মাসে, মহর্ষি দয়ানন্দজী গড়িয়াঘাট পৌঁছান। সেখানে একদিন এক  ঠাকুর নিজের লোকজনের সাথে তলোয়ার এবং লাঠি নিয়ে মহর্ষিকে আঘাত করতে আসে। কারণ এই অঞ্চল চক্রাঙ্কিতদের আস্তানা ছিলো। মহর্ষি তাদের মতের বিরোধিতা করতেন। তখন বলদেব ভক্তও সেখানে বসে ছিলেন তিনি তাদের থামাতে চাইলেন। কিন্তু তারা মানলো না এবং মহর্ষির সামনাসামনি এসে বসলো । মহর্ষি তাদের বুঝালেন এবারও তারা মানলো না। তাই তিনি এখান থেকে উঠে অন্যত্র গিয়ে বসেন। ঠাকুর নিজের লোকজনকে বলদেবকে ধরার জন্য সংকেত দেয়। তখন বলদেব তাদের মধ্যে একজনের হাত এবং অন্যজনের পায়ে ধরে তাদের সেখানেই ফেলে দেন। এর মধ্যে অন্য লোকজনও সেখানে এসে উপস্থিত হয় এবং এই দুষ্টদের পিটুনি দিয়ে তাড়িয়ে দেয়।

(ঘটনা-২) জৈষ্ঠ্য সং ১৯২৫ এ মহর্ষি কর্ণবাসে পদার্পণ করেন। কর্ণবাসের কাছে বরৌলি নামক এক গ্রাম ছিলো সেখানকার এক উদ্ধতস্বভাব ক্ষত্রিয় রাও 'কর্ণসিংহ' বাস করতো। সে বৃন্দাবনের চক্রাঙ্কিত সম্প্রদায়ের ধর্মগুরু রঙ্গাচার্যের শিষ্য তথা অন্ধভক্ত ছিলো। একদিন যখন মহর্ষি ভক্তদের বেদোপদেশ দিচ্ছিলেন এবং তাদের সংশয়ের সমাধান করছিলেন। তখন রাও কর্ণসিংহ  নিজের তলোয়ারধারী চ্যালা-চামুণ্ডাদের সাথে নিয়ে উপদেশস্থলে এসে উপস্থিত হয়। মহর্ষি তাকে দেখে আগ্রহপূর্বক বসতে বলেন। কিন্তু রাও কর্ণসিংহ দুর্বিনীত ভাবে বলে উঠে," আমি তো সেখানেই বসবো যেখানে আপনি বসেছেন।" মহর্ষি যেই শীতল পাটিতে বসে ছিলেন তার অর্ধেক কর্ণসিংহের জন্য খালি করে কর্ণসিংহকে বসতে দেন। কর্ণসিংহের সাথে মহর্ষির কিছুক্ষণ বার্তালাপ হয়। এক পর্যায়ে চক্রাঙ্কিত মতের বিরোধিতা করার ফল ভালো হবে না বলে কর্ণসিংহ মহর্ষিকে হুমকি দেয়। মহর্ষি মৃদু হেসে কর্ণসিংহকে বলেন, তুমি তোমার গুরু রঙ্গাচার্যকে নিয়ে আসো। আমি তার সাথে শাস্ত্রার্থ করার জন্য প্রস্তুত আছি। এই বলে মহর্ষি, চক্রাঙ্কিত মতের দোষ উপস্থাপন করতে লাগলেন। এতে উগ্রস্বভাব কর্ণসিংহ মহর্ষির উপর খুব ক্ষেপে যায় এবং মহর্ষিকে হত্যার জন্য তলোয়ার বের করে নেয়। মহর্ষি তড়িৎগতিতে তার হাত থেকে তলোয়ার কেড়ে নেন এবং তা দিয়ে মাটিতে আঘাত করেন। ফলে তলোয়ার ভেঙ্গে দু টুকরো হয়ে যায়। সাথে কর্ণসিংহের এক পালোয়ান চ্যালাও মহর্ষিকে মারতে আসে, নির্ভীক বীর মহর্ষি দয়ানন্দ সেই পালোয়ানকে এক ঝটকায় দূরে ফেলে দেন। তখন তিনি কর্ণসিংহকে বলেন, ধূর্ত! যুদ্ধই যদি করার হয় তাহলে কোনো বীর রাজপুতের সাথে যুদ্ধ করো। আর শাস্ত্রার্থ করতে হলে তোমার গুরু রঙ্গাচার্যকে এখানে নিয়ে আসো। ঠাকুর কিশনসিংহ আদি মহর্ষির রাজপুত ভক্তগণ এসব দেখে লাঠি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে যান। ঠাকুর কিশনসিংহ কর্ণসিংহকে বলেন "এখন যদি তুই মহারাজকে (মহর্ষিকে) আর একটা কথাও বলিস তাহলে ফৌজদারী হয়ে যাবে। যদি তুই প্রবচন শুনতে না চাস, তাহলে চলে যা।" কাপুরুষ কর্ণসিংহ ভীত - লজ্জিত হয়ে চ্যালাদের  নিয়ে সেখান থেকে চলে যায়। 

কিছু লোক এই ঘটনা থানায় জানিয়ে কর্ণসিংহকে ধরিয়ে দিতে চাইলে মহর্ষি বলেন, সে যদি নিজ ক্ষত্রিয় ধর্ম ত্যাগ করে দেয় তাই বলে আমি নিজের সন্ন্যাস ধর্ম থেকে পতিত হবো কেন? ক্ষমা এবং সন্তোষ আমার পরম ধর্ম। 


(ঘটনা-৩) এই কর্ণসিংহ শারদ পূর্ণিমায় পুনরায়  গঙ্গাস্নানের জন্য কর্ণবাস আসে। মহর্ষি কর্ণবাসে তখন বেদবিরুদ্ধ মত তথা পাখণ্ডতাপূর্ণ কুপ্রথা সমূহ খণ্ডন করছিলেন। রাও কর্ণসিংহ আগের বারের অপমানের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য এবার কিছু বৈরাগীদের লোভ দেখিয়ে মহর্ষিকে মারার জন্য উস্কে দেয়। কিন্তু এতে সে সফল হয় নি। তারপর  নিজের তিন পালোয়ান চ্যালাকে এই কাজের জন্য লাগিয়ে দেয়। একদিন রাত দুপুরে তার এই তিন চ্যালা তলোয়ার নিয়ে মহর্ষিকে হত্যার জন্য যায়। মহর্ষি এবং কৈথলসিংহ (যিনি মহর্ষির সেবায় নিযুক্ত ছিলেন) ঘুমিয়ে ছিলেন। হঠাৎ পায়ের শব্দ শুনে মহর্ষি ঘুম থেকে জেগে উঠেন। তাতে কর্ণসিংহের চ্যালারা ভয়ে দ্রুত সেখান থেকে পালিয়ে আসে। উদ্দেশ্য পূরণ না করে চলে আসায় কর্ণসিংহ তাদের উপর রেগে যায় এবং ধমক দিয়ে তাদের আবার পাঠায়।  এবারও মহর্ষি জেগে যান এবং সিংহনাদ করেন, তাঁর হুংকার শুনে তিন ঘাতক এসে তাঁর পায়ে পড়ে।  

মহর্ষির হুংকার শুনে কৈথলসিংহও জেগে উঠেন। 

        পরদিন কৈথলসিংহ এ সকল ঘটনা ভক্ত ঠাকুর কিশনসিংহ তথা অন্যান্য ক্ষত্রিয় রাজপুতদের খুলে বলেন। সব শুনে ভক্তবৃন্দ মহর্ষির নিবাস স্থলে এসে জমা হন। মহর্ষি তাঁদের বুঝিয়ে বলেন দেখো! কোনো ক্রুর ব্যক্তি ঈশ্বর-ভক্তের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। তোমরা উত্তেজিত হয়ো না। ঐ ভীরু কাপুরুষ যা বুঝেছে তাই করেছে। আমার ধর্ম ক্ষমা করা। দুষ্ট  নিজের দুষ্টতা ছাড়ে নি তাই বলে আমরা নিজেদের সাধুতা ছাড়বো কেন? যাইহোক এ নিয়ে তোমরা চিন্তা করো না। 

         ভক্তগণ সন্তুষ্ট হন নি। তাঁরা মহর্ষির নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত ছিলেন। তাই সোজা কর্ণসিংহের ডেরায় গিয়ে তাকে ডেকে বলেন,

 

“ এই যে কাপুরুষ, রাজপুত! যদি তুই নিজের ভালো চাস তাহলে এই মূহুর্তে কর্ণবাস থেকে পালিয়ে যা। নাহলে তোর সব অস্ত্রশস্ত্র ছিনিয়ে নিয়ে তোকে এমন পিটুনি দিবো যে, সারাজীবন মনে রাখবি। তোর সব মানসম্মানও সমাপ্ত হয়ে যাবে । ”

কর্ণবাস নিবাসী কর্ণসিংহের শ্বশুর মোহনসিংহ তাকে বুঝালেন, এখন কর্ণবাস থেকে পালিয়ে যাওয়াই তোমার পক্ষে মঙ্গলজনক। কর্ণসিংহ অন্তভীরু তো ছিলোই। সে নিজের শ্বশুরের কথা মেনে নেয় এবং সেখান থেকে পালিয়ে নিজের গ্রামে চলে যায়। 


(ঘটনা- ৪) কর্ণবাস থেকে মহর্ষি যখন শাহবাজপুর গিয়েছিলেন। তখন সেখানকার দুজন বৈরাগী এক ঠাকুরের কাছে তলোয়ার চাইতে এসে বললো যে এই গপ্পাষ্টকের (মহর্ষির) শিরচ্ছেদ করবো ”। ঠাকুর এটা শুনে তাদের ধমক দিলেন। সেখানে গ্রামের জমিদার, ‘গঙ্গাসিংহ জীও’ উপস্থিত ছিলেন। তিনিও ঐ দুই বৈরাগীকে ধমক দিয়ে তাড়িয়ে দেন। 


(ঘটনা- ৫) ফর্রুখাবাদে জ্বালাপ্রসাদ নামক এক  মদ্য-মাংসাহারী ভ্রষ্ট তথাকথিত ব্রাহ্মণ লোক বাস করতো। একদিন এক বামাচারী তাকে পালকিতে তুলে মহর্ষির কাছে নিয়ে আসে। সে মহর্ষির সামনে এসে চেয়ারে বসে  এবং মহর্ষিকে কঠোর ভাষায় গালিগালাজ করতে শুরু করে। এই ঘটনায় সেখানে উপস্থিত ভক্তগণ দুঃখী হন এবং তাকে ভালোভাবে উত্তম মধ্যম দিয়ে বিদায় করেন। মহর্ষির এই ঘটনা ভালো লাগেনি। তার কিছুক্ষণ পরই জ্বালাপ্রসাদের আত্মীয় ২০-২৫ জন লোক নিয়ে মহর্ষিকে মারতে আসে। কিন্তু মহর্ষিকে দর্শন করে তার মন পরিবর্তন হয় এবং সে কোনো ক্ষতি না করে চলে যায়।  ফর্রুখাবাদের ‘লালা জগন্নাথ’ জী মহর্ষিকে কোনো সুরক্ষিত স্থানে থাকার জন্য অনুরোধ করেন। উত্তরে মহর্ষি তাঁকে বলেছিলেন যে,

 

 “এখানে তো আপনি আমার রক্ষা করে নিবেন, কিন্তু অন্যত্র কে করবে? আমি আজ পর্যন্ত একাকীই ভ্রমণ করেছি, ভবিষ্যতেও একাকীই ভ্রমণ করবো। বহুবার আমার প্রাণহরণের চেষ্টা করা হয়েছে, কিন্তু সর্বরক্ষক পরমাত্মা আমাকে সর্বত্রই রক্ষা করেছেন, এবং ভবিষ্যতেও রক্ষা করবেন। আপনি এজন্য দুশ্চিন্তা করবেন না ” । 


(ঘটনা- ৬) এই ফর্রুখাবাদেরই এক  গুজরাটী ব্রাহ্মণ সেখানের প্রসিদ্ধ সন্ত্রাসী ছিল। কিছু বিদ্বেষী লোক তাকে টাকার লোভ দেখিয়ে মহর্ষিকে মারার জন্য পাঠায়। সে মোটা লাঠি হাতে নিয়ে তাঁকে(মহর্ষিকে) মারার উদ্দেশ্য যায়। কিন্তু মহর্ষির সাথে বার্তালাপের পর সে এতোটাই প্রভাবিত হয় যে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ত্যাগ করে আজীবন এক সদাচারী ব্রাহ্মণ হয়ে জীবন যাপন করতে থাকে।


(ঘটনা- ৭) একদিন মহর্ষি কাশীর গঙ্গাঘাটে বসে অর্ধ মুদিত চোখে খুব মধুর কণ্ঠে সামগান গাইছিলেন। তখন সেখানে লাঠি হাতে কিছু লোক এসে উপস্থিত হলো, এসে মহর্ষির উপর ঢিল পাটকেল ইত্যাদি ছুড়তে লাগলো। তাদের মধ্যে একজন লোক মহর্ষির কাছে এসে তাঁকে লাঠি দিয়ে প্রহারও করলো। কিন্তু প্রহারে বিচলিত না হয়ে তিনি ঐ লোকের হাত থেকে লাঠি কেড়ে নিয়ে গঙ্গার জলে ছুড়ে ফেলে দেন। তারপর একটা গাছের ডাল ভেঙ্গে আক্রমণকারীদের বলেন, এসো বন্ধুরা, এখন প্রহার করো। আমাকে দুর্বল সাধু মনে কোরো না।  এসো। তারপর আক্রমণকারী দুষ্টদের অনেককেই তিনি প্রহার করেন এবং তারা পালিয়ে যায়। 

(ঘটনা-৮) কার্তিক মাসের শুক্ল ১২ সং ১৯২৬ তদানুসারে ১৬ নভেম্বর ১৮৬৯ এ কাশীর প্রসিদ্ধ শাস্ত্রার্থ সভা অনুষ্ঠিত হয়। মহর্ষিকে কোনোভাবেই হারাতে না পেরে বিপক্ষীয় পণ্ডিতগণ কাশীরাজের সায় পেয়ে হৈ-হুল্লোড় বা বিশৃঙ্খলা বাধিয়ে দেয়। এবং কোলাহলের মধ্যেই কাশী নরেশ “দয়ানন্দঃ পরাজিতঃ” বলে সভা ত্যাগ করেন। তারপর আর কি? পুরো সভাই অনিয়ন্ত্রিত হয়ে যায়। আর উপস্থিত ধর্মান্ধ পৌরাণিকপক্ষীয় শ্রোতাগণ মহর্ষির উপর ইট, পাথর, মাটির ঢেলা, গোবর ইত্যাদির বর্ষণ করে দেয়।

সমগ্র আর্যজগৎ কাশীর তৎকালীন কোতোয়াল পণ্ডিত রঘুনাথপ্রসাদজীর কাছে অত্যন্ত কৃতজ্ঞ থাকবে যিনি নিজের কর্তব্য থেকে না সরে মহর্ষি দয়ানন্দ জীর রক্ষা করেছিলেন। যদিও তিনি প্রতিমা-পূজা তথা সাকারবাদের পক্ষে ছিলেন। তবে ছিলেন কর্তব্যপরায়ণ, ন্যায়প্রিয়।

যখন মহর্ষির দিকে ইটপাটকেল, ঢেলা,গোবর ইত্যাদি ছোড়া হচ্ছিল তখন তিনি পণ্ডিত জবাহরদাস উদাসীকে বলেন, 

 

আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। ঈশ্বর আমার সাথে আছেন, কেউ আমার কিছু করতে পারবে না।


(ঘটনা- ৯) মহর্ষি দয়ানন্দজী বেদবিরোধী সকল মতেরই প্রবল সমীক্ষক ও খণ্ডনকর্তা ছিলেন। সেই অনুসারে ইসলামেরও খণ্ডন করতেন। এজন্য মুসলমানগণ তাঁর উপর অত্যন্ত ক্ষিপ্ত ছিল।

একদিন মহর্ষি একাকী গঙ্গাতীরে বসে ছিলেন। তখন সেখানে কিছু মুসলমান লোক চলে আসে। তাদের মধ্যে একজন মহর্ষিকে চিনে ফেলে এবং বলে উঠে, এই যে ইনিই সেই বাবা (সন্ন্যাসী) যিনি দ্বীন ইসলামের বিরুদ্ধে কথা বলেন। তারপর দুইজন মুসলমান সামনে এসে মহর্ষিকে ধরে গঙ্গায় ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করতে থাকে।  

মহর্ষি তাদের পরিকল্পনা বুঝতে পারলেন এবং নিজের বাহুদ্বয় এমনভাবে সংকোচিত করলেন যে ঐ দুইজন ব্যক্তি তাঁর বাহুর নিচে আটকে যায়। তাদের দুজনকে এভাবে ধরে তিনি গঙ্গার জলে ঝাপ দেন। মহর্ষি চাইলে এই দুজনকেই পানিতে ডুবিয়ে মারতে পারতেন, কিন্তু দয়া করে তাদেরকে ছেড়ে দেন। এবং পানির ভিতর দিয়ে সাতার কেটে কেটে সেখান থেকে অনেক দূরে চলে যান। দুই মুসলমান যুবক পানি থেকে নদীর তীরে উঠে, হাতে ইট নিয়ে তাঁর উঠে আসার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। কিন্তু অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পরও যখন মহর্ষিকে দেখতে পায় না তখন ভাবে, সন্ন্যাসী বাবা হয়তো পানিতে ডুবে মারা গেছে। এই ভেবে তারা সেখান থেকে চলে যায়। অন্ধকার নেমে আসায় মহর্ষিও ঘরে চলে আসেন।


(ঘটনা- ১০) কাশীতে একদিন এক ব্যক্তি খাবার নিয়ে মহর্ষির কাছে আসে। এবং ভক্তিভাব প্রদর্শন করে মহর্ষির কাছে ভোজন গ্রহণের জন্য প্রার্থনা করে। মহর্ষি বলেন যে, আমি তো ইতোমধ্যে ভোজন করে নিয়েছি। আপনি করুন। ঐ লোক বললো, আচ্ছা, অন্তত পান তো গ্রহণ করুন। মহর্ষি তার অনুরোধে হাতে পান নিয়ে যখন খুলে দেখলেন তখন সেই লোক ঝট করে পালিয়ে যায়। পরে জানা যায় যে, সেই পানের মধ্যে বিষ দেওয়া ছিলো। 

 ১৮৭৮ সালের এপ্রিল মাসে মূলতানে অবস্থানরত অবস্থায় এই ঘটনার কথা মহর্ষিজী একজন বাঙালি সজ্জন বাবু শরৎচন্দ্র চৌধুরীকে বলেছিলেন।

মহর্ষি বড়ো সুঠাম ও বলিষ্ট দেহের অধিকারী ছিলেন। বলা হয়, তিনি ১০-১৫ জন সন্ত্রাসীর বিপরীতে একাই পর্যাপ্ত ছিলেন। একদিন এক গুণ্ডা মহর্ষির পিছু নিয়েছিল। ওর হাবভাব মোটেও সুবিধার মনে হচ্ছিল না। মহর্ষি তা বুঝতে পেরে পিছনে ফিরে হুংকার দেন তখন সে ভয়ে পালিয়ে যায়।


(ঘটনা-১১) মির্জাপুর নামক অঞ্চলে বুড়ো মহাদেবের এর একটি বিখ্যাত মন্দির ছিলো। ঐ মন্দিরের পূজারী ছোটু গিরি বেশ হৃষ্ট-পুষ্ট লোক ছিল। প্রতিমা পূজার সিদ্ধান্তে বিরোধিতার কারনে সে মহর্ষিকে হিংসা করতো। একদিন এই দুষ্ট মহর্ষির কাছে এসে তাঁকে বললো, “ আরে বাছা, তুই তো কিছুই পড়িস নি। কিছু তো পড়।” সে রীতিমতো খারাপ আচরণ করতে শুরু করলো। তারপর বললো “ বাছা, আমি তোর গুরু হই, আজ তুই সব জানতে পারবি”। এরপর মহর্ষি দাড়িয়ে বললেন, 

 

 মূর্খ! আমাকে ভয় দেখাচ্ছো ? যদি আমি তোমার এসবে ভয় পেতাম তাহলে, সারাদেশে ঘুরে ঘুরে খণ্ডন (শাস্ত্রার্থাদি) করতাম কিভাবে ? 

 

পরে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মহাশয় নিজ উদ্যোগে কিংবা কোনো সজ্জনের অনুরোধে একজন লোককে মহর্ষির বাসস্থানের কাছে পাহারায় নিযুক্ত করে দেন।


(ঘটনা -১২) ছোটু গিরি এভাবে অপমানিত হয়ে ফিরে আসে। তার মনে হিংসার আগুন জ্বলতে থাকে। সে পুনরায় দুই বখাটেকে মহর্ষির কাছে পাঠায়। মহর্ষি তখন কোনো এক সজ্জনের সাথে কথা বলছিলেন। দুই বখাটে তার কথায় বারবার ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করতে লাগলো। মহর্ষি তাদেরকে ধরে ফেললে তারা ভয়-ভীত হয়ে বেহুশ হয়ে যায়। তারপর চোখেমুখে জলের ছিটা দিয়ে তাদের জ্ঞান ফেরানো হয়।



(ঘটনা- ১৩) মীর্জাপুরে এক ওঝা ছিল। সে বড়াই করে ঘোষণা করে যে, যদি কেউ আমার মাধ্যমে মারণ পুরশ্চরণ করায়। তাহলে একুশতম দিনে দয়ানন্দের মৃত্যু হবে। পৌরাণিকদের মধ্যে কোনোকালেই মূর্খের কোনো কমতি ছিল না। সেখানের এক ধনী শেঠ এসে বললো, তোমার যত টাকা লাগে নাও আর পুরশ্চরণ করো। ব্যাস! পুনশ্চরণের মাধ্যমে মহর্ষি দয়ানন্দকে মেরে ফেলার আয়োজন শুরু হলো। কিন্তু বিধি বাম। তিন-চার দিন পর দৈবযোগে ঐ শেঠের গলায়ই এক বিষম ফোঁড়া দেখা দিলো। এটা এমন ভয়ংকর রূপ ধারণ করলো যে শেঠজীর খাওয়া-দাওয়া, এমনকি কথা বলা পর্যন্ত দুষ্কর হয়ে পড়লো । দিন-দিন শেঠের যন্ত্রণা বাড়তে লাগলো। সাথে ওঝার পকেটও ভারী হলো। একদিন ওঝা এসে শেঠকে বললো, “ বলির সামগ্রী নিয়ে আসো। আমি এখানে বলি দেব আর ওখানে দয়ানন্দের গলা কেটে যাবে।” শেঠ তখন বলে উঠলো, দয়ানন্দের গলা কাটুক বা না কাটুক আমার গলা তো অবশ্যই কেটে যাবে। 😭 তুমি পুরশ্চরণ বন্ধ করো। 😩


(ঘটনা-১৪) যখন মহর্ষি অনূপশহরে ছিলেন তখন এক ব্রাহ্মণ তাঁর প্রতিমা পূজার খণ্ডনে রুষ্ট হয়ে পানের মধ্যে বিষ মিশিয়ে দেয়। মহর্ষি বিষ বুঝতে পেরে ন্যোলি ক্রিয়ার মাধ্যমে একে নিজের শরীর থেকে বের করে দেন। এবং সুস্থ হয়ে যান। সেখানকার একজন মুসলমান তহসিলদার যিনি সৈয়দ মুহম্মদ মহর্ষির ভক্ত ছিলেন; এই ঘটনা শুনে তিনি ঐ ব্রাহ্মণের উপর অভিযোগ করে তাকে কারাগারে বন্দী করেন। তারপর প্রসন্ন মনে মহর্ষি দয়ানন্দের কাছে আসেন, তিনি ভেবেছিলেন তার কাজে হয়তো মহর্ষি খুশি হবেন। কিন্তু তিনি অপ্রসন্নতার ভাব প্রকাশ করে বলেন, 

 

" সৈয়্যদ মুহম্মদ আমি এই সংসারের কাউকে বন্দী করাতে নয় বরং বন্দীদশা থেকে মুক্ত করতে এসেছি। দুষ্ট যদি দুষ্টতা না ছাড়ে তাহলে আমরা কেন নিজের সদভাবনা ছেড়ে দিবো? "

 

এমন আদর্শ বিচারকে প্রত্যক্ষ করে, সৈয়্যদ মুহম্মদ আশ্চর্যচকিত হয়ে যান এবং মহর্ষির আজ্ঞানুসারে সেই ব্রাহ্মণকে আপীলে মুক্ত করে দেন।


(ঘটনা- ১৫) এই ঘটনা মহর্ষি নিজের পূর্ব পরিচিত ভক্ত বাবু রজনীকান্ত কে বলেছিলেন, 

" একদিন যখন আমি ধ্যানাবস্থায় ছিলাম তখন বিপক্ষীয় লোক তলোয়ার নিয়ে আমাকে হত্যা করতে আসে। কিন্তু যখন আমি হুংকার দিই, তখন সে পালিয়ে যায়। "


(ঘটনা - ১৬) যখন মহর্ষিজি ২০ অক্টোবর ১৮৭৩ এ কানপুরে পদার্পণ করেন। তখন সেখানকার শহর কোতোয়াল সুলতান আহমদ মহর্ষির প্রবচনে বাধা হয়ে উঠলো। সে চাইতো না যে এখানে মহর্ষি প্রবচন দিন। তার আস্কারা পেয়ে মৌলভী আবোল-তাবোল বকাবকি করতে লাগল। পৌরাণিকপক্ষীয় পণ্ডিতরাও ইট-পাথর ছুড়ে মহর্ষি দয়ানন্দকে হত্যার চেষ্টা করতে থাকে। এখানে কোতোয়ালের পুরো হাত ছিল। কিন্তু হঠাৎ সেখানে ইংরেজ পুলিশ ক্যাপ্টেন এসে উপস্থিত হন এবং ঘোষণা করেন যে, " স্বামীজীর প্রবচন আগের মতোই চলবে। আমি স্বয়ং উপস্থিত থাকবো। " সম্ভবত কোতোয়ালের কুকৃত্য সম্পর্কে পুলিশ ক্যাপ্টেন জেনে গিয়েছিলেন।


(ঘটনা -১৭) আলীগড়ে একদিন এক ভণ্ড নেশাগ্রস্ত তথাকথিত সাধু মহর্ষির কাছে এসে তাঁকে গালাগালি করতে শুরু করে। মহর্ষি জিজ্ঞেস করলেন, " তুমি গলায় কি পরেছো?" সে বললো, " রুদ্রাক্ষ "। মহর্ষি তাকে আবার প্রশ্ন করলেন, " তুমি কি রুদ্রের চোখ বের করে নিয়েছো? " ঐ নিরক্ষর ভট্টাচার্য কি জানতো? যে রুদ্রাক্ষের অর্থ আসলে কি? মহর্ষির প্রশ্নে তো সে আরও প্রচণ্ডভাবে রেগে যায় এবং গালি দিতেই থাকে। কিছুক্ষণ এভাবে বকাঝকা করে চলে যায়।

 

(ঘটনা - ১৮) বৃন্দাবনের এক মুন্সী হরগোবিন্দ কট্টর পৌরাণিক হিন্দু ছিলো। সে উদ্ধত এবং ঝগড়াটে প্রবৃত্তির লোক ছিলো। একবার সে মহর্ষির উপর অনেক ধুলোবালি ছুড়ে মারে। মহর্ষির কাছে এসব অত্যাচার নতুন কিছু ছিলো না। মহর্ষির সহনশীলতা দেখুন, তিনি তাকে কিছুই বলেন নি।


(ঘটনা- ১৯) বৃন্দাবনেরই এক বৈরাগী মহর্ষিকে হত্যার জন্য কিছু গুণ্ডাদের ১০০০ টাকার লোভ দেখিয়ে পাঠায়। কিন্তু সে সফল হয় নি।


(ঘটনা -২০) মথুরায় পণ্ডিত দেবীপ্রসাদ ডেপুটি কালেক্টর মহর্ষিকে বললেন, আপনি থেকে যান আজ এখানে শাস্ত্রার্থ হবে। মহর্ষি থেকে যান। তারপর শাস্ত্রার্থ তো হলোই না বরং চার-পাঁচশো চৌবে লাঠি নিয়ে তাঁকে মারতে আসলো। হৈচৈ শুনে ঠাকুর ভূয়ালসিংহ হিসালদার ভয় পেয়ে যান এবং সেখানকার (শাস্ত্রার্থের জন্য নির্ধারিত স্থানের) ফটক দরজা বন্ধ করে দিলেন যেখানে মহর্ষি অবস্থান করছিলেন। কিন্তু মহর্ষি তাতে ভীত ছিলেন না। ঘটনাক্রমে মহর্ষির কিছু ক্ষত্রিয় ভক্তগণও সেখানে এসে উপস্থিত হন। এতে কোনো চৌবেরই ভিতরে প্রবেশ করার মতো সাহস হয় নি। আর ডেপুটি কালেক্টর পণ্ডিত দেবীপ্রসাদ আসার পর তো তারা পালিয়েই গেল।


(ঘটনা -২১) মহর্ষির মুম্বাই প্রবাসকালে (ডিসেম্বর ১৮৭৪) বল্লভ সম্প্রদায়ের লোক তাঁর পরম শত্রু হয়ে গেল। একদিন জীবনী গোঁসাই মহর্ষির রাধুনি বলদেবকে ডেকে বললো " তুমি যদি দয়ানন্দকে হত্যা করে দাও তাহলে তোমাকে এক হাজার রুপি পুরস্কার দেবো।" সে তাড়াতাড়ি পাঁচ রুপি ও পাঁচ সের মিঠাই এবং ১০০০/- রুপির প্রতিশ্রুতিও লিখে দেয়। তখন বলদেব জীবনী গোঁসাইয়ের কাছেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। কেউ একজন তাঁকে দেখে মহর্ষিকে জানিয়ে দেয় যে, " আপনার রাধুনি জীবনী গোঁসাইয়ের কাছে দাঁড়িয়ে আছে "। বলদেব ফিরে আসার পর মহর্ষি তাঁর কাছ থেকে সব বৃত্তান্ত জানতে চাইলে তিনি তাঁকে সব কথা সত্য-সত্য বলে দেন। মহর্ষি বলেন, আমাকে অনেক বার বিষ দেওয়া হয়েছে, আমি তখনও মারা যাইনি আর এখনও মারা যাবো না। বলদেব ক্ষমা চাইলেন। মহর্ষি তাকে মিঠাই ফেলে দিতে চিঠি ছিড়ে ফেলতে বলেন এবং তাকে ভবিষ্যতে সেখানে না যাওয়ার আদেশ করেন।


(ঘটনা - ২২) এই প্রসঙ্গে একদিন গোকুলিয়া গোঁসাইরা তাদের অনুসারী বিশজন লোকের একটি দল মহর্ষিকে মারার উদ্দেশ্য বালকেশ্বরে পাঠিয়ে দেয়। কিন্তু তারা সফল হয় নি।


(ঘটনা - ২৩) কিছু দুষ্ট মহর্ষিকে হত্যা করার জন্য কিছু ঘাতকদের সাথে চুক্তি করে। মহর্ষি বলদেবকে সাথে নিয়ে সমুদ্রতীরে হাটতে যেতেন। ঘাতকগণ মহর্ষির পিছু নিতো। (উদ্দেশ্য সুযোগ বুঝে তাঁকে হত্যা করা) একদিন মহর্ষির ঘাতকদের সামনে পড়েন। তিনি ঘাতকদের উদ্দেশ্যে বলেন, " বলো! কি উদ্দেশ্য তোমরা আমাকে মারতে চাও? " ঘাতকরা উত্তরে কিছুই বলে নি এবং এর পর থেকে পিছু নেওয়া বন্ধ করে দেয়। মহর্ষি আগের মতোই সে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেতেন।


(ঘটনা- ২৪) বল্লভ সম্প্রদায়ের লোকজন পুনরায় একবার মহর্ষিকে হত্যার জন্য দুজন ঘাতককে দুইশো রুপির বিনিময়ে ভাড়া করে। একদিন রাতে এই দুই ঘাতক মহর্ষির কামরায় ঢুকে পড়ে। সেসময় সেঠ সেবকলাল মহর্ষির কাছে বসে ছিলেন। তিনি ঐ ঘাতকদ্বয়কে ধরে ফেলেন। জিজ্ঞাসা করা হলে তারা স্বীকার করে নেয় যে মহর্ষিকে হত্যা করার জন্য তাদেরকে দুইশো রুপি দেওয়া হয়েছে।


(ঘটনা-২৫) মহর্ষি দয়ানন্দজীর সুরত প্রবাসকালে, পণ্ডিত ইচ্ছাশঙ্কর এবং কিছু অন্য শাস্ত্রীগণ মহর্ষির সাথে শাস্ত্রার্থের জন্য আসেন। কিন্তু মহর্ষি একে একে তাদের সবাইকে নিরুত্তর করে দেন। দিনাবসানে অন্ধকার ছেয়ে এলে সভায় কিছু ইট-পাথর এসে পড়ে। এসব গেলাভাই এবং আরো কিছু দুষ্ট প্রবৃত্তির লোকের কাজ। তারা মহর্ষিকে অপমানের জন্য সংকল্পবদ্ধ হয় এবং সভায় ইট-পাথর ছুঁড়ে মারে।


(ঘটনা- ২৬) মুরাদাবাদে নভেম্বর ১৮৭৬, এ মহর্ষির মূর্তি-পূজা বিষয়ক বক্তব্য তথা প্রবচন শুনে টীকা নামক এক তথাকথিত ব্রাহ্মণ অত্যন্ত কোপিত হয়ে মহর্ষিকে গালি দিতে থাকে। এটা বলতে বলতে, এই দুষ্ট আমাদের দেব-দেবীর নিন্দা করেছে এর মুখও দর্শন করা উচিত নয়। বলে চলে যায়। মহর্ষি তার গালির দিকে মনযোগ দেন নি।


(ঘটনা- ২৭) মার্চ ১৮৭৭ এ চাঁদাপুরে মহর্ষি বখ্শীরাম বা মুন্সী ইন্দ্রমণিকে এই ঘটনার বর্ণনা দিয়েছিলেন। যখন মহর্ষি একাকী চলাফেরা করতেন তখন একদিন তিনি এমন এক স্থানে চলে আসেন যেখানে মূলত শাক্তদের বসবাস ছিলো। তারা মহর্ষির খুবই সেবা শুশ্রূষা করে। কিছু দিন পর মহর্ষি সেখান থেকে চলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলে তারা তাঁকে আগ্রহপূর্বক থামিয়ে দেয়। মহর্ষি ভেবেছিলেন, এরা ভক্তিভাব থেকেই এমন করছে হয়তো।

একদিন সব লোক সেখানের মন্দিরে যাচ্ছিলো। মহর্ষিকেও তারা সাথে নিয়ে গেলো। মহর্ষিকে তারা অনেক অনুনয়-বিনয় করে যে, আপনি আমাদের মন্দিরে আসুন, আপনার ইচ্ছা না হয় মূর্তিকে প্রণাম করবেন না। তাও আসুন। এই মন্দির নগরীর বাইরে এক উজাড় স্থানে অবস্থিত ছিলো। মহর্ষি মন্দিরে এসে পৌছালে সেখানে এক বলিষ্ট লোককে ধারালো নগ্ন তরবারি হাতে নিয়ে দাঁড়ানো দেখতে পেলেন। মন্দিরের পূজারী এসে মহর্ষিকে বললো, মহাত্মাজী, মা দূর্গার সামনে নতমস্তক হয়ে প্রণাম করো। মহর্ষি সরাসরি এতে নিজের অসম্মতি প্রকাশ করলে পূজারী বলপূর্বক তাঁর মস্তককে নত করতে উদ্যত হয়। মহর্ষি ততক্ষণে তাদের উদ্দেশ্য বুঝে গেছেন। তিনি ঝট করে সেই তলোয়ারধারীর হাত থেকে তলোয়ার ছিনিয়ে নেন এবং পূজারীকে জোরে ধাক্কা দেন। তাতে সে মন্দিরের দেয়ালে গিয়ে পড়ে। মহর্ষি বাইরে এসে দেখতে পান মন্দির অঙ্গনে অনেক লোক ছুরী, কুড়াল ইত্যাদি অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে তাঁর উপর আক্রমণ করতে আসছে। মন্দিরের দরজায় তালা দেওয়া ছিল। মহর্ষি দ্রুতগতিতে দরজায় চড়ে দেওয়াল পার হয়ে যান। সারাদিন একটি সুরক্ষিত স্থানে থাকেন এবং রাত হলে এই স্থান ত্যাগ করেন। সেদিনের ঘটনার পর শাক্তদের উপর থেকে মহর্ষির বিশ্বাস উঠে যায়।


(ঘটনা- ২৮) কাশী প্রবাস কালে মহর্ষি পর্ণকুটিরে বাস করতেন। কাছেই কিছু সাধুদের আস্তানা ছিলো। সেই সাধুরা মহর্ষিকে অকারণেই হিংসা করতো। একদিন রাত্রিকালে ঘোর অন্ধকারে মহর্ষির কুটিরের কাছে আসে এবং মহর্ষিকে কিভাবে হত্যা করা যায় সে বিষয়ে পরামর্শ করতে থাকে। মহর্ষি তাদের কথা শুনে নিয়েছিলেন। একটু পরেই তারা পর্ণকুটিরে আগুন লাগিয়ে দেয়। কুটির জ্বলতে শুরু করে। এবং মহর্ষি দ্রুত বাইরে চলে আসেন।


(ঘটনা- ২৯) একদিন কাশীতে মহর্ষি ব্যখ্যান দিচ্ছিলেন। তখন এক তথাকথিত ব্রাহ্মণ তাঁকে পান খেতে দেয়। মহর্ষি নিজের সরল স্বভাব অনুসারে পান খেয়ে নেন। খাওয়ার পর তিনি বুঝতে পারেন যে এর মধ্যে বিষ দেওয়া ছিল। তখন বমন ক্রিয়া দ্বারা একে শরীর থেকে বের করে দেন। দয়ানন্দ প্রকাশ অনুসারে উপরোক্ত দুই ঘটনা, মহর্ষি লাহোরে ডাঃ রহীম খাঁ এর ঘরে ভক্তদের শোনান।


(ঘটনা- ৩০) ১৩ জানুয়ারি ১৮৭৮ এ মহর্ষি পাঞ্জাব রাজ্যের গুজরাল শহরে এসে পৌছান। সেখানে এক নামী বদমাইশ, যাকে লোক " অন্ধীর পুত্তুর " বলে ডাকতো। সে মহর্ষিকে অনেক অপশব্দ বলতো। সেই খুল্লম খোল্লা বলতো "আমি হয় দয়ানন্দকে মেরে ফেলবো নাহয় ওর নাক কেটে ফেলবো। " সে মহর্ষির উপর একের পর এক আরোপ লাগিয়েই যাচ্ছিলো। পুলিশও তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যাবস্থা গ্রহণ করে নি। মেহতা জ্ঞানচন্দ এবং তাঁর সাথীদের ভয় হলো যে ঐ দুষ্ট আবার মহর্ষির কোনো ক্ষতি না করে বসে। তাঁরা মহর্ষিকে সাবধান করেন। মহর্ষি তাদের বলেন তুমি আমার বল্লম দেখো আমার উপর কোনো আক্রমণ হবে না। আমি একাই দশ-বারো জন লোকের জন্য যথেষ্ট। একদিন মহর্ষির ব্যখ্যানের সময় কিছু ইট পাথর এসে তাঁর কাছে পড়ে। মহর্ষি এতে কিঞ্চিৎ মাত্র বিচলিত না হয়ে, ব্যখ্যান দিতে থাকেন। এবং ব্যখ্যান শেষ হলে নিজের নিবাস স্থানে চলে আসেন।


(ঘটনা- ৩১) একদিন এক লোক মহর্ষিকে উদ্দেশ্য করে ইট ছুড়ে মারে কিন্তু সেটা মহর্ষির গায়ে লাগেনি। তবে পুলিশ সেই আততায়ীকে ধরে ফেলে। সে ইট ছুড়ে মারার কথা অস্বীকার করে। মহর্ষি তাকে ক্ষমা করে দেন। মহর্ষি বলেন আমার সাথে এটা কোনো নতুন ঘটনা নয়। এরকম লোককে ক্ষমা করো এবং সদুপদেশ দাও।


✅ উল্লেখ্য- মহর্ষিকে ইট ছুড়ে মারা ব্যক্তিদের মধ্যে একজন ছিলেন পণ্ডিত সূর্যকুমার শর্মা রইস। তিনি হলধরের শাস্ত্রার্থে মহর্ষির উপর ইট ছুড়ে এসেছিলেন। মহর্ষি দয়ানন্দের প্রতি তার দ্বেষ এতোটাই বেশি ছিলো যে, মহর্ষির নাম শুনা মাত্রই তিনি তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠতেন। মহর্ষির বই-পুস্তক যেখানে পেতেন ছিঁড়ে ফেলতেন। মার্গশীর্ষ সং ১৯৩৯ বিক্রমে তাঁর ছোট ভাই মহর্ষির কিছু বই কিনে আনেন। পণ্ডিতজী দেখামাত্রই বই ছিঁড়তে গেলেন, কিন্তু বইয়ের সৌন্দর্য দেখে তাঁর মন অন্তত একবার বইগুলো পড়ে দেখার জন্য আগ্রহী হয়ে উঠে। তিনি পড়তে শুরু করেন। 'মেলা চাঁদাপুর' বৃত্তান্ত পড়ে তাঁর মন থেকে অজ্ঞান তথা অন্ধবিরোধের পর্দা সরে যায়। এবং তিনি মহর্ষির যুক্তি দ্বারা অত্যন্ত প্রভাবিত হন। ১৯৪০ বিক্রমাব্দে এ যখন তাঁর শহরে আর্যসমাজ স্থাপিত হয় তখন তিনি তার সভাসদ হন। এবং সারা জীবনভর মহর্ষির প্রতি শ্রদ্ধালু হয়ে থাকেন।


(ঘটনা- ৩২) ফেব্রুয়ারি ১৮৭৮ এ মহর্ষি বজীরাবাদে প্রবচন দিচ্ছিলেন। সেখানে পণ্ডিত বামদেব একটি মন্ত্র বললেন যেটি দিয়ে মূলত শালগ্রাম শিলা ও তুলসীর পূজা সিদ্ধ হয়। মহর্ষি বললেন এটা বেদের কোনো মন্ত্র নয় বরং কোনো মন্ত্রের টীকা হবে। মহর্ষি তাকে মূল মন্ত্র উপস্থাপন করতে বলেন। সেখানে সময়ের সাথে ভীড় বাড়ছিলো ফলে ঝামেলা হওয়ার আশংকাও বেড়ে যায়। সেখানে পণ্ডিত রামচন্দ্র আনরেরী ম্যাজিস্ট্রেট উপস্থিত ছিলেন। তিনি থাকা পর্যন্ত সবাই শান্ত ছিলো কিন্তু কোনো এক কাজে তাঁকে সেখান থেকে চলে যেতে হয়। তাতে সুযোগ পেয়ে এক ছেলে চেঁচামেচি শুরু করে দেয়। মহর্ষি এই ছেলেকে চুপ করাতে বললে, লালা লব্ধারাম সেই ছেলেকে দুয়েক ছড়ী মেরে দেন। পৌরাণিকগণ এতোক্ষণ তো চুপ করে বসে ছিলো কিন্তু এখন তারা তাদের মনমতো সুযোগ পেয়ে যায় এবং লালা লব্ধারামের উপর আক্রমণ করে বসে। আর্যসমাজ বজীরাবাদ তথা আর্যসমাজ জেহলমের সভাসদগণ সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তাঁরা লালা লব্ধারামকে রক্ষা করেন। মহর্ষি তাদের মাধ্যমে লব্ধারামকে তাঁর নিজ বাসভবনে পৌছে দেন। এবং সেখানকার দ্বার বন্ধ করিয়ে দেন। কিন্তু ভীড় কমেনি। বরং চিৎকার চেঁচামেচি চলতে থাকে। মহর্ষির হিন্দুস্তানী ক্লার্ক এতে ক্ষেপে যায় এবং হাতে লাঠি নিয়ে ভীড়ে চলে যায়। কিন্তু একা একজন লোক এতো লোকের সাথে কতক্ষণই বা পারবে? ওরা তাকে খুব মারধর করে। মহর্ষি যখন এই ঘটনা জানতে পারেন তখন নিজে লাঠি হাতে নিয়ে বাইরে আসেন এবং জোরে গর্জন করে এদের তাড়িয়ে দেন।


(ঘটনা- ৩৩) ১৮ জুন ১৮৭৮ ইংরেজিতে অমৃতসরে শাস্ত্রার্থের মাঝে হঠাৎ লোকজনের চেঁচামেচি শুরু হয়। লোকজন সভাস্থলে ইট পাথর ছুড়ে মারতে থাকে। মহর্ষির দিকেও একটি পাথর আসে। কিন্তু সেটা তাঁর উপরে এসে পড়েনি । সভাস্থলে উপস্থিত ব্যক্তিবর্গের মধ্যে অনেকেই আহত হন, তাদের শরীর থেকে রক্ত ঝরছিলো। পুলিশ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এসব তামাশা দেখছিল। তারা কাউকে থামানো বা গ্রেফতার কিছুই করে নি। এভাবে অত্যন্ত কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে গিয়ে এই উপদ্রব শান্ত হয়।


(ঘটনা- ৩৪) অমৃতসরে একদিন এক নেশাখোর তথাকথিত ব্রাহ্মণ মহর্ষির উপদেশ শুনে খুব ক্ষেপে যায় এবং মহর্ষিকে বল্লম দিয়ে প্রহার করতে আসে। কিন্তু তার আগেই লোকজন তাকে ধরে ফেলে। পরে মহর্ষি তাকে ছাড়িয়ে দেন।


(ঘটনা- ৩৫) ২৯ সেপ্টেম্বর ১৮৭৮ ইংরেজিতে মহর্ষির করকমল দ্বারা মেরঠে আর্যসমাজ স্থাপিত হয়। মেরঠের এক শেঠ মহর্ষির এতোটাই বিরোধী হয়ে গিয়েছিলো যে, সে মহর্ষিকে মারার জন্য কিছু গুণ্ডা ভাড়া করে। কিন্তু সে কিছুই করতে পারে নি। তারপর মহর্ষির একদিন মৃতক-শ্রাদ্ধ খণ্ডন শুনে ব্রাহ্মণরা তাঁর উপর ক্ষেপে যায় এবং রাতে যখন মহর্ষি প্রবচন দিয়ে নিজের বাসস্থানে আসবেন তখন তাঁকে পেটানোর জন্য গুণ্ডা ভাড়া করে। মহর্ষি এসব জানা সত্ত্বেও সেই গলি দিয়েই যান, গুণ্ডারা লাঠি নিয়ে বসেই থাকলো। মহর্ষির উপর আক্রমণ করার সাহস কারো হয় নি।


(ঘটনা- ৩৬) এপ্রিল ১৮৭৯ তে মহর্ষি হরিদ্বারে প্রবচন দিচ্ছিলেন। তখন সেখানে জ্বালাপুর নিবাসী এক বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ এসে বলে, স্বামীজি! আমি আসছি। এসে তোর গলা কেটে ফেলবো এরপর নিজের গলাও কেটে ফেলবো। তুই আমাদের খুব ক্ষতি করছিস। আমাদের জীবিকা নষ্ট করছিস। পাহারাদার এসে এই বৃদ্ধ ব্রাহ্মণকে সেখান থেকে সরিয়ে দেয়।


(ঘটনা- ৩৭) ১ বৈশাখ সং ১৯৩৬ বিক্রমাব্দে এ কিছু পণ্ডিত মহর্ষিকে হরিদ্বারে শাস্ত্রার্থের জন্য নিমন্ত্রণ করে। তাদের আসল উদ্দেশ্য ছিলো, যদি মহর্ষি সেখানে যান তাহলে তাঁকে মেরে ফেলা! মহর্ষি তাদের নিমন্ত্রণের উত্তরে বলেন, আমি শাস্ত্রার্থের জন্য সবসময়ই প্রস্তুত আছি। কিন্তু এর ব্যবস্থা কোনো রাজপুরুষ করুন। জুনাগড় আখেড়ায় গেলে আমার শারিরীক ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা আছে । অর্থাৎ মহর্ষি কোনো রাজপুরুষের দায়িত্বে শাস্ত্রার্থের আয়োজন তথা পর্যাপ্ত নিরাপত্তা চাইছিলেন। কিন্তু সেই পণ্ডিতদের মতলব তো অন্য ছিলো। তারা পরবর্তীতে আরও পত্র পাঠায় কিন্তু মহর্ষি নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকেন এবং সেখানে যাননি।


(ঘটনা- ৩৮) মহর্ষির কাছে শিবরাম নামক একজন পণ্ডিত থাকতেন। তার শ্বশুর এবং কাকাদের ভয় ছিল যে, শিবরাম মহর্ষির সাথে থেকে সন্ন্যাসী না হয়ে যায়। তাই তারা শিবরামকে চিঠি লিখে পাঠায়, তুমি বাড়িতে চলে আসো। যদি দয়ানন্দ তোমাকে ছুটি না দেয় তাহলে আমরা এসে ওর গলা কেটে ফেলবো। শিবরাম এই চিঠি মহর্ষিকে দেখান। মহর্ষি তাকে বলেন, তুমি আমার চিন্তা বাদ দাও, আর যদি তোমার ইচ্ছা হয় তাহলে চলে যাও। সেসময় মহর্ষির কাছে অন্য কোনো পণ্ডিত ছিলেন না।


(ঘটনা- ৩৯) একদিন মহর্ষি মৃতক-শ্রাদ্ধ খণ্ডন সম্পর্কিত ব্যখান দিচ্ছিলেন। কিছু দুষ্ট লোক তাঁর উপর ঢিল ছুঁড়ে মারে। মহর্ষি এতে বিচলিত না হয়ে বক্তৃতা দিতে থাকেন।


(ঘটনা- ৪০) একদিন এক মুসলমান যুবক আসে। এসে কিছু প্রশ্ন করে আবোলতাবোল বকতে থাকে। মহর্ষি শান্ত থাকেন আর ঐ দুষ্ট বকঝকা করে কিছুক্ষণ পরে চলে যায়।


(ঘটনা- ৪১) মহর্ষি এই ঘটনা মৌলবি ইমদাদ হুসৈনকে বলেছিলেন, একদিন আমি শৌচ করছিলাম, তখন এক ব্যক্তি (ঘাতক) তলোয়ার নিয়ে আমার পিছনে এসে দাঁড়ায়। আমি তাঁকে বললাম, আমি শৌচ থেকে নিবৃত্ত হই। তারপর তুমি আমার শিরচ্ছেদ করো। তাতে ঐ ব্যক্তি রাজি হয়ে যায়। আমি নিবৃত্ত হয়ে গেলে, ওর সামনে মস্তক এগিয়ে দিই। এতে সেই ব্যক্তি এতোটা প্রভাবিত হয় যে, কোনো ক্ষতি না করেই চলে যায়।


(ঘটনা- ৪২) ১৯ আগস্ট থেকে ৮ সেপ্টেম্বর ১৮৮১ পর্যন্ত মহর্ষি রায়পুরে ছিলেন। সেখানের ঠাকুর হরিসিংহ যখন মহর্ষির সাথে দেখা করতে আসেন। তখন বার্তালাপের এক পর্যায়ে মহর্ষি ঠাকুরকে জিজ্ঞেস করেন, আপনার মন্ত্রী কে? ঠাকুর বললেন, শেখবখশ ইলাহী। মহর্ষি বললেন আর্যপুরুষের উচিত যেন কোনো যবনকে রাজমন্ত্রী না করেন । এটা শুনে শেখের ভাতুষ্পুত্র করিম বখ্শ এবং অন্য ৬-৭ জন মুসলমান মহর্ষির উপর ক্ষেপে যায় এবং তাঁকে পেটানোর জন্য ষড়যন্ত্র করতে থাকে। তবে পরবর্তীতে তারা সফল হয় নি। এবং পরিস্থিতিও শান্ত হয়ে যায়।


(ঘটনা- ৪৩) ২৯ সেপ্টেম্বর ১৮৮৩ এর রাত্রিতে ষড়যন্ত্র করে মহর্ষির রাধুনি দ্বারা মহর্ষিকে দুধে বিষ মিশিয়ে দেওয়া হয়। এবং এই বিষ ই মহর্ষির প্রাণঘাতী সিদ্ধ হয়। এবং ঈশ্বরের ইচ্ছানুসারে দেহত্যাগ করে তিনি পরম ধামে গমন করেন।

(জোধপুরের ঘটনা পরবর্তী লিখায় বিস্তারিত প্রকাশ করা হবে।)


উপরোক্ত ঘটনাসমূহ থেকে জানা যায় যে মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতীর উপর ৪৩-৪৪ বার আক্রমণ তথা তাঁকে হত্যা ও অপমানের চেষ্টা করা হয়েছিলো। মহর্ষির জীবনীগ্রন্থ এর বর্ণনার বাইরে কত শতবার যে মহর্ষির উপর আক্রমণ হয়েছে, কতবার যে তাঁকে পাখণ্ডিদের অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে তা একমাত্র ঈশ্বরই জানেন।

  • লেখক- লক্ষ্মীচন্দ বানপ্রস্থী
  • ভাষান্তর এবং পরিমার্জন - সুব্রত দেবনাথ।






Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.