মহামহোপাধ্যায় পণ্ডিত আর্যমুনি
মহামহোপাধ্যায় পণ্ডিত আর্যমুনি জী সমগ্র বৈদিক শাস্ত্রের উচ্চকোটির বিদ্বান্ তথা প্রভাবশালী শাস্ত্রার্থ মহারথী ছিলেন । তাঁর জন্ম পটিয়ালা জেলার রুমাণা গ্রামে ১৮৬২ সনে ।
পিতৃপ্রদত্ত নাম ছিলো মনিরাম, পরন্তু আর্যসমাজে প্রবেশের পর তিনি তাঁর নাম রাখেন আর্যমুনি । তিনি বেদ, দর্শন, মনুস্মৃতি, রামায়ণ তথা মহাভারত আদি গ্রন্থের উপর অত্যন্ত মহত্ত্বপূর্ণ ভাষ্য এবং টীকা লিখেছেন । আর্যমুনি জী আর্যসমাজের প্রচারক, উপদেশক এবং প্রকাণ্ড শাস্ত্রার্থ মহারথী ছিলেন। তিনি তাঁর জীবনে অনেক শাস্ত্রার্থ করেছেন ।
যে কোনো বিষয়ে শাস্ত্রার্থে অবৈদিকদের পরাজিত করে চূর্ণ-বিচূর্ণ করতে সক্ষম ছিলেন । তিনি মল্লযুদ্ধেও পারদর্শী ছিলেন ।
পণ্ডিত জী কাশীতে অবস্থান করে বিস্তারিত ভাবে সমগ্র সংস্কৃত সাহিত্য অধ্যয়ন করেন । লাহোরে অবস্থিত ডী.এ.বী. কলেজে সংস্কৃত তথা দর্শন শাস্ত্রের অধ্যাপক পদে নিযুক্ত ছিলেন । যে সময়ে পণ্ডিত জী লাহোরস্থিত ডী.এ.বী. কলেজের প্রফেসর পদে ছিলেন, সেই সময়কালে একদিন এক যুবক পণ্ডিত জীকে বলেন, " মল্লযুদ্ধে কেবল শারীরিক বলের প্রয়োজন, অপরদিকে শাস্ত্রার্থে কেবল বুদ্ধিবলের প্রয়োজন হয়। "
পণ্ডিত জী উত্তর দিলেন, মল্লযুদ্ধে শরীরিক বল অপেক্ষা বুদ্ধিবলের অধিক আবশ্যকতা রয়েছে । যুবক ক্ষিপ্ত হয়ে পণ্ডিত জীকে চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলে, " আপনি আমার সহিত মল্লযুদ্ধ করুন, আপনার তো বুদ্ধিবল রয়েছে " ।
পণ্ডিত জী সেই যুবকের সহিত মল্লযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হন । যুবক তাঁকে মল্লযুদ্ধের জন্য নিষেধ করেন, পরন্তু তিনি যুবকের কথায় কর্ণপাত করেন না তিনি । অনেক দর্শকের সমাগম হয় । সমস্ত দর্শক মূহুর্তের মধ্যে আশ্চর্য হয়ে যায় । তারা দেখে ক্ষণিক মূহুর্তের মধ্যে পণ্ডিত জী সেই যুবককে মাটিতে আছাড় মেরে তার বুকের উপর বসে পড়েন । সেই সময়ে যুবকটি পণ্ডিত জীকে তাঁর পা ধরে মাটিতে ফেলানোর চেষ্টা করে । পরন্তু পণ্ডিতজী অত্যন্ত কঠিন কৌশল প্রয়োগ করে ঐ যুবককে মাটিতে চেপে ধরেন এবং পুনঃ তিনি যুবকের বুকের উপর বসে পড়েন। অন্তে পণ্ডিত জীর নিকট যুবক তার পরাজয় স্বীকার করে এবং দর্শকগণ একটা অন্যরকম বুদ্ধিবল ভিত্তিক মল্লযুদ্ধের সাক্ষী হয় ।
পণ্ডিত আর্যমুনি জী মহর্ষি দয়ানন্দ জীর অনন্য ভক্ত ছিলেন । তিনি বলতেন,
"যেমনভাবে পদ্মপাদাচার্য, সুরেশ্বরাচার্য, বিদ্যারণ্য স্বামী, বাচস্পতি মিত্রাদি শঙ্করাচার্যের মতের পুষ্টি করেছেন, তদ্রূপ মহর্ষি দয়ানন্দ জীর সিদ্ধান্তের মণ্ডন করা আবশ্যক । প্রায়ঃ সময় তিনি তাঁর স্বরচিত ছন্দে গাইতেন -- ‘সো গুরু হৈং হমরে উর মেং জিনকা শুভ নাম দয়ানন্দ দণ্ডী।’
১৯৩৩ সনে আজমেরে অনুষ্ঠিত "দয়ানন্দ নির্বাণ অর্ধশতাব্দী"-তে চতুর্বেদ পরায়ণ মহাযজ্ঞের প্রধান ব্রহ্মা ছিলেন পণ্ডিত আর্যমুনি জী এবং শ্রী ড. ভবানীলাল জী ছিলেন বেদপাঠী ।
এই মহাযজ্ঞানুষ্ঠানে ভবানীলাল জী ৬-৭ দিন পণ্ডিত আর্যমুনি জীর সাথে ছিলেন । এক দিন পণ্ডিত জী ভবানীলাল জীকে বলেন, "
১৯৩৬ বিক্রমাব্দে যখন ঋষি দয়ানন্দ কাশী এসেছিলেন, তখন আমি কশীতে নব্যন্যায় অধ্যয়নে মনোনিবেশ ছিলাম । স্বামী জীর ব্যাখ্যান শ্রবণ করে আমি বুঝতে পারি স্বামী জী নব্যন্যায় সম্বন্ধে জ্ঞাত নন ।
অতঃ একদিন আমি তাঁর সহিত নব্যন্যায়ের শৈলীতে শাস্ত্রচর্চা আরম্ভ করি, মূহুর্তের মধ্যেই স্বামী জী আমার মানগর্দন করার জন্য নব্যন্যায়ের ভাষাতেই আমার প্রশ্নের উত্তর দেন এবং অন্তে বলেন, বৎস ! এই নব্যন্যায়ে কিছুই নাই । কেবল বাগাডম্বর মাত্র । সমস্ত নব্য-ন্যায় প্রমাণ-মীমাংসাতেই সমাপ্ত হয়ে যায় । ন্যায়শাস্ত্রকার যেই প্রমেয় এর যথার্থ জ্ঞানের জন্য প্রমাণের উল্লেখ করেছেন, সেই প্রমেয় ভাগকে নব্য-ন্যায় কোনরূপ মহত্ত্বই দেয় নাই । নব্যন্যায়ের ভাষাশৈলীকে কাক-ভাষা বলে ।"
পণ্ডিত আর্যমুনি জী প্রায়ঃ সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ শাস্ত্রের উপর মহত্ত্বপূর্ণ টীকা, ভাষ্য এবং ব্যাখ্যা প্রণয়ন করেছেন । পণ্ডিত জী বেদান্তে শঙ্করাচার্য প্রতিপাদিত অবৈদিক অর্থের প্রবল খণ্ডনপূর্বক ঈশ থেকে তৈত্তিরীয় উপনিষদ পর্যন্ত ভাষ্য করেন । গীতা, রামায়ণ, মহাভারত আদি আর্ষ গ্রন্থের উপর আর্যভাষ্য প্রণয়ন করেছেন । ইংরেজ সরকার পণ্ডিত আর্য মুনি জীর পাণ্ডিত্য তথা অপার বৈদুষ্যে মুগ্ধ হয়ে " মহামহোপাধ্যায় " উপাধিতে বিভূষিত করে ।
পণ্ডিত জী হিন্দি এবং পাঞ্জাব উভয় ভাষার কবিও ছিলেন ।
যেমনভাবে পণ্ডিত লেখরাম জী যেকোন স্থলে, যেকোন বিষয়ে ব্যাখ্যান দেওয়ার পর, ইসলাম বিষয়ে কিছু না কিছু খণ্ডনাত্মক ব্যাখ্যান অবশ্যই দিতেন ; তদ্রূপ পণ্ডিত আর্যমুনি জী যেকোনো স্থলে, যেকোনো বিষয়ে ব্যাখ্যান দেওয়ার পর, নবীন বেদান্ত বিষয়ে খণ্ডনাত্মক ব্যাখ্যান অবশ্যই দিতেন ।
তিনি তাঁর জীবনকালে প্রচুর শাস্ত্রার্থ করেছেন । লাহোরে আর্যসমাজের একটি উৎসবের পরে টানা তিন দিন বিপক্ষ বিদ্বানদের সাথে শাস্ত্রার্থের মাধ্যমে শঙ্কা-সমাধানের কার্যক্রম চলমান ছিলো । সেই সময় পণ্ডিত আর্যমুনি জীই আর্য সমাজের পক্ষ নিয়ে শাস্ত্রার্থ করেছিলেন ।
মহাত্মা হংসরাজ জীর অধ্যক্ষতায় পণ্ডিত বিশ্ববন্ধু শাস্ত্রী জীর সাথে
" বেদে ইতিহাস " বিষয় নিয়েও প্রসিদ্ধ শাস্ত্রার্থ হয়েছিলো, এই শাস্ত্রার্থে পণ্ডিত আর্যমুনি জীও উপস্থিত ছিলেন ।
পণ্ডিত জীর ষঅধিকাংশ পুস্তক লাহোর তথা কাশী থেকে প্রকাশিত হয়েছে । তাঁর গ্রন্থসমূহের প্রকাশন পণ্ডিত দেবদত্ত শর্মা জী করেছেন ।
গ্রন্থরাজিঃ
1. ঋগ্বেদ ভাষ্য – মহর্ষি দয়ানন্দ জী ঋগ্বেদের সপ্তম মণ্ডলের যে মন্ত্র পর্যন্ত ভাষ্য করেছিলেন, পণ্ডিত তাঁর পরবর্তী মন্ত্র হতে নবম মণ্ডল পর্যন্ত মহর্ষি দয়ানন্দ জীর শৈলীতে ভাষ্য প্রণয়ন করেন । উক্ত ভাষ্য ৬টি খণ্ডে সমাপ্ত হয় ।
১ম খণ্ড [ভূমিকা] ১৯৭৪ বিক্রমাব্দ. ২য় খণ্ড [সপ্তম মণ্ডল পর্যন্ত] ১৯৭৫ বিক্রমাব্দ. ৩য় খণ্ড [অষ্টম মণ্ডল পূর্বার্দ্ধ] ১৯৭৯ বিক্রমাব্দ, ৪র্থ খণ্ড [অষ্টম মণ্ডল উত্তরার্দ্ধ] ১৯৮০ বিক্রমাব্দ, ৫ম খণ্ড [নবম মণ্ডল পূর্বার্দ্ধ] ১৯৭৯ বিক্রমাব্দ, ৬ষ্ঠ খণ্ড [নবম মণ্ডলের উত্তরার্দ্ধ] ১৯৮০ বিক্রমাব্দ ।
এই প্রকারে ঋগ্বেদে ৩টি মণ্ডলের বিস্তৃত ভাষ্য ৬ বছরে সম্পন্ন করেন ।
2. উপনিষদার্য ভাষ্য (১৯১০ সন)– পণ্ডিত আর্যমুনি জী ঈশ থেকে বৃহদারণ্যক পর্যন্ত দশটি উপনিষদের বিস্তৃত ভাষ্য করেন । আর্যমুনি জী কৃত উক্ত ভাষ্য শঙ্করাচার্যের অবৈদিক, বেদবিরুদ্ধ অদ্বৈত প্রতিপাদক উপনিষদ ভাষ্যের প্রবল খণ্ডনমূলক ভাষ্য । প্রায়ঃ প্রত্যেক উপনিষদ্ বাক্যে শঙ্কর কৃত কদর্থের খণ্ডন পূর্বক উপনিষদের ভেদপরক ব্যাখ্যা করেছেন । ছান্দোগ্য উপনিষদ্ (১৯১০ সন), বৃহদারণ্যকোপনিষদ্ ভাষ্য (১৯২৪ সন)
3. দর্শন ভাষ্য – সাংখ্যার্য ভাষ্য (১৯১৬ সন), যোগার্য ভাষ্য, ন্যায়ার্য ভাষ্য, (১৯০৯ সন), বৈশেষিকার্য ভাষ্য (১৯০৭ সন ), বেদান্তার্য ভাষ্য (১৯৬০ বিক্রমাব্দ ) মীমাংসার্য ভাষ্য (১৯৬৪ বিক্রমাব্দ) [২টি ভাগ] ।
ষড়দর্শনের ভাষ্যের সময় আর্যমুনি জী তাঁর মৌলিকতার পরিচয় দিয়েছেন । তিনি মহর্ষি দয়ানন্দ জীর সিদ্ধান্তকে অনুসরণ পূর্বক ষড় দর্শনে বিবিধ বিষয়ে ব্যাখ্যা করেছেন । বেদান্ত ভাষ্যে তিনি বৈয়াসিক সূত্রসমূহের ভেদপরক ব্যাখ্যা করার সময় শঙ্কর কৃত ভ্রান্তিপূর্ণ অবৈদিক ভাষ্য সবিস্তারে খণ্ডন করেছেন । এই প্রকারে মীমাংসা দর্শনে নিরূপিত যজ্ঞকে তিনি অহিংসাযুক্ত কর্মকাণ্ড প্রতিপাদন করেছেন । উক্ত সম্বন্ধে তিনি কবিভাষা প্রয়োগে ব্যক্ত করেছেন —
" মীমাংসা কে বিষয় মেং পশুবধ কো নহি কাম ।
বৈদিকমত কী খ্যাতি মেং যহী হমারো কাম ॥ "
4. বাল্মীকি রামায়ণার্য টীকা (১৯১২ সন) [২টি খণ্ড]
5. মহাভারতার্য টীকা – ১ম ভাগ (১৯৭১ বিক্রমাব্দ) এবং ২য় ভাগ (১৯৭২ বিক্রমাব্দ)
6. গীতাযোগপ্রদীপার্য ভাষ্য (১৯০৪ সন)
7. মানবার্য ভাষ্য (১৯৭০ বিক্রমাব্দ) –
মনুস্মৃতির বিস্তৃত ব্যাখ্যা
8. ষড়দর্শনাদর্শ – ষড়দর্শনের সমন্বয়াত্মক সমীক্ষা ।
9. বেদান্তত্ত্বকৌমুদী (১৯১২ সন) – বেদান্ত দর্শনের মুখ্য সিদ্ধান্ত বর্ণনা
10. বেদান্ত কথা (১৮৯৯ সন)
11.আর্যমন্তব্যপ্রকাশ – ( ২টি খণ্ড ) ( ১ম ভাগ ১৯০২ সনে এবং ২য় ভাগ ১৯০৩ সনে প্রকাশিত ) ।
12. আর্য মন্তব্য দর্পণ (১ম ভাগ)
13. বৈদিক কাল কা ইতিহাস (১৯২৫ সন)
14. বেদ মর্যাদা (১৯১৭ সন)
15. নরেন্দ্র জীবন চরিত্র ( মহামহিম ভীষ্ম পিতামহ জীবনী ১৯৭৬ বিক্রমাব্দ )
16. দয়ানন্দ মহাকাব্য - অর্থাৎ দয়ানন্দ চরিত মানস কাব্য ( রামচরিতমানস গ্রন্থের শৈলীতে লিখিত ১৯৮১ বিক্রমাব্দ )
--- বিদুষাং বশংবদঃ