আর্যসমাজের ১০ নিয়মের ব্যাখ্যা


আর্যসমাজ মূলত স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী প্রবর্তিত দশটি নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত। নীতিগুলো হচ্ছে:

  1. সব সত্যবিদ্যা এবং যা পদার্থবিদ্যা দ্বারা জানা যায় সেসবের আদিমূল পরমেশ্বর।
  2. ঈশ্বর সচ্চিদানন্দস্বরূপ, নিরাকার, সর্বশক্তিমান, ন্যায়কারী, দয়ালু, অজন্মা, অনন্ত, নির্বিকার, অনাদি, অনুপম, সর্বাধার, সর্বেশ্বর সর্বব্যাপক, সর্বান্তর্যামী, অজর, অমর, অভয়, নিত্য, পবিত্র ও সৃষ্টিকর্তা, একমাত্র তারই উপাসনা করা উচিত।
  3. বেদ সব সত্যবিদ্যার পুস্তক, বেদের পঠন-পাঠন, শ্রবণ ও শ্রাবণ সকল আর্যের পরম ধর্ম।
  4. সত্য গ্রহণে ও অসত্য পরিত্যাগে সদা উদ্যত থাকবে।
  5. সব কাজ ধর্মানুসারে অর্থাৎ সত্য ও অসত্য বিচারপূর্বক করা উচিত।
  6. সংসারের উপকার করা এই সমাজের মুখ্য উদ্দেশ্য অর্থাৎ শারীরিক, আত্মিক ও সামাজিক উন্নতি করা।
  7. সকলের সঙ্গে প্রীতিপূর্বক ধর্মানুসারে যথাযোগ্য ব্যবহার করা উচিত।
  8. অবিদ্যার নাশ ও বিদ্যার বৃদ্ধি করা উচিত।
  9. প্রত্যেককে নিজের উন্নতিতেই সন্তুষ্ট থাকা উচিত নয়, কিন্তু সবার উন্নতিতে নিজের উন্নতি ভাবা উচিত।
  10. সব মানুষকে সামাজিক সর্বহিতকারী নিয়ম পালনে পরতন্ত্র এবং প্রত্যেক হিতকারী নিয়মে সবাইকে স্বতন্ত্র থাকা উচিত।

 

  • প্রথম নিয়মঃ— নিমিত্ত অথবা চৈতন্য কারণকে আদি মূল (First cause) বলে। কুম্ভকার মৃত্তিকা দ্বারা ঘট প্রস্তুত করে, এ ক্ষেত্রে 'কুম্ভকার নিমিত্ত (আদি) কারণ এবং ‘মাটি' উপাদান কারণ (Material cause) । পরমেশ্বরকে দুইটি বস্তুর 'নিমিত্ত কারণ' বলা হইয়াছেঃ—

সত্যবিদ্যা (১) যাহা যাহা পদার্থবিদ্যা দ্বারা জানা যায়, তিনকালেই যে জ্ঞান একরূপ থাকে। তাহাকে সত্যবিদ্যা বলে। সে কোন্ জ্ঞান যাহা তিন কালেই একরূপ থাকে? উহা—ঈশ্বর, জীব এবং (কারণরূপ) প্রকৃতির জ্ঞান। এই অর্থে পরমেশ্বরকে যে আদি (মূল) কারণ বলা হইয়াছে তাহার অভিপ্রায় এই যে, তিনি ঐ (ঈশ্বর+জীব+কারণরূপ প্রকৃতির) জ্ঞানের আদি কারণ। তাৎপৰ্য্য ইহা নহে যে, যেহেতু উহারা নিত্য (অনাদি পদার্থ) অতএব তিনি ঐ বস্তুর ও (ঈশ্বর+জীব+কারণরূপ প্রকৃতিরও) আদি কারণ। এই সত্যবিদ্যারই নাম বেদ, যাহা তৃতীয় নিয়মে উক্ত হইয়াছে। এই জন্য নিয়মোক্ত প্রথম কথাই এই যে, পরমেশ্বর সত্যবিদ্যা অর্থাৎ বেদের আদি মূল। এইজন্য ঈশ্বরকে আদি গুরুও বলা হয় [ স এষ পূৰ্বেষামপি উরুঃ কালেনানবচ্ছেদাৎ (যোগ দর্শন ১।২৬) ] ।


বিদ্যা (২) বিদ্যা পরিবর্ত্তনীয় জ্ঞানকে বলা হয়। ব্রহ্মাণ্ডে পরিবর্ত্তনীয় বস্তু কি?—কার্য্যরূপ প্রকৃতি। কার্য্যরূপ প্রকৃতিরই নাম সৃষ্টি। পরিবর্তনীয় বস্তু সকলের (জগতের) জ্ঞানও পরিবর্ত্তনীয়। এইজন্য সৃষ্টি বিদ্যা বা জগতের জ্ঞানকে পরিবর্তনীয় জ্ঞান বলা হয়। এই জ্ঞান (বিদ্যা) দ্বারা মনুষ্য জগতের সম্পূর্ণ জ্ঞান লাভ করে। অতএব সিদ্ধান্ত এই দাঁড়াইল যে, পরমেশ্বর জগতের নিমিত্ত কারণ (জগতের উপাদান কারণ—প্রকৃতি) সংক্ষেপতঃ প্রথম নিয়মে এই বলা হইয়াছে যে, পরমেশ্বর বেদ এবং জগতের নিমিত্ত (আদি) কারণ । 

এই ভাব ঋগ্বেদের নিম্নলিখিত ঋকে প্রকট হইয়াছে— “ঋতঞ্চ সত্যঞ্চাভিদ্ধান্ত- পসোহধ্যজাযত” (ঋগ্বেদ ১০।১৫।১।১) অর্থাৎ ঋত (বেদ) এবং সত্য (প্রকৃতি) জ্ঞানময় পরমেশ্বরের সামর্থ্য হইতে প্রকাশিত হইয়াছে।


  • দ্বিতীয় নিয়মঃ—এই নিয়মে দুইটি কথা আছে। প্রথম কথা এই যে, পরমেশ্বর সচ্চিদানন্দস্বরূপ, সর্বশক্তিমান, ন্যায়কারী দয়ালু ইত্যাদি সত্ত্বাত্মক গুণসকল দ্বারা সগুণ, এবং নিরাকার, অজন্মা অনন্ত, নির্ব্বিকার, অনাদি প্রভৃতি অভাবাত্মক গুণ দ্বারা নির্গুণও। নিয়মের মধ্যে দ্বিতীয় এই কথা বলা হইয়াছে যে, ঐরূপ (সগুণ+নির্গুণ) ব্ৰহ্মই একমাত্র উপাস্য দেব। তিনি ভিন্ন কাহারও উপাসনা করা উচিৎ নহে। এই নিয়মে বর্ণিত “সবর্বশক্তিমান” কথার ভাব এই যে, ঈশ্বর নিজের (সৃষ্টি) নিয়মের মধ্যে থাকিয়া নিজের অসীম শক্তি প্রয়োগ করিয়া থাকেন। স্বয়ং কখনও নিজের নিয়মের উল্লঙ্ঘন করেন না। অর্থাৎ এরূপ হইতে পারে না যে, ঈশ্বর কোন অন্যায় করেন। বা করিতে পারেন অথবা আপন সদৃশ আর এক পরমেশ্বরকে উৎপন্ন করিতে অথবা নিজেকে বধ করিতে (১) পারেন ইত্যাদি (২)।


(১) সর্বশক্তিমান” কথার প্রকৃত ভাব বুঝিতে না পারায় মুসলমানদিগের মধ্যে দুই সম্প্রদায় হইয়াছিল। উহারা সর্বদা পরস্পর বিরোধ করিত। এক সম্প্রদায়ের নাম “অশারী”। ইহারা বিশ্বাস করিতেন যে, ঈশ্বর সকল কাজ করিতে পারেন, তিনি নির্দোষীকে দণ্ড দিতেও পারেন এবং দোষীকে মুক্তি দিতেও পারেন। দ্বিতীয় সম্প্রদায়ের নাম “মৌতজিলা”। ইহারা বিশ্বাস করিতেন যে, ঈশ্বর নিয়ম এবং মর্য্যাদার অনুকুলে সকল কাজ করিয়া থাকেন। তিনি নির্দোষীকে দণ্ড দেন না এবং অপরাধীকে ক্ষমা করেন না। যখন “অশঅরী” সম্প্রদায়ের রাজ্য ছিল তখন তাঁহারা অন্যায় করিয়া হাজার হাজার “মৌতজিলা” মুসলমানকে বধ করিয়াছিলেন। (আরবী ইতিহাস “মলিল ও নহিল")

(২) “সৰ্বজ্ঞ” কথার সম্বন্ধেও জনসাধারণের মধ্যে এই প্রকারের ভুল দেখা যায়। সৰ্বজ্ঞ এবং “ত্রিকালজ্ঞ” শব্দের একই অর্থ, এই জন্য কেহ কেহ বলেন যে, যেহেতু ঈশ্বর ভূত ভবিষ্যৎ এবং বর্তমান এই তিন কালের কথাই জানেন অতএব মানুষ ভবিষ্যতে কি করিবে তাহাও জানেন। যদি তাহাই হয়, তবে মানুষ ঈশ্বরের জ্ঞানানুকূলে কার্য করিতে বাধ্য। এমতাবস্থায় জীবের কর্ম করিবার স্বাধীনতা রহিল না। এবং “স্বতন্ত্রঃ কৰ্তা” এই অনুসারে সে স্বতন্ত্র না হওয়ায় কর্তাও রহিল না, অতএব সকল কার্য্যেরই কর্তা ঈশ্বর। এই বিষয়ে আমাদের বক্তব্য এই যে, ঈশ্বর ত্রিকালজ্ঞ ইহা সত্য এবং তিনি ইহাও ভালরূপে জানেন যে, কি নিয়মে প্রলয় হইবে এবং তাহার পর কি প্রকারে জগৎ উৎপন্ন হইবে। তিনি এ কথাও জানেন যে, মনুষ্যকৃত পাপ কর্মের কি কি ফল হইবে ইত্যাদি। পরন্তু আমাদের পাপ কৰ্ম সম্বন্ধে ঈশ্বরের জ্ঞান কিরূপ ইহা ভাল করিয়া বুঝা উচিত। মনুষ্য যখন কোন কর্ম্ম করে তখন সর্ব্বপ্রথমে তাহার মনে চিন্তা উপস্থিত হয়। যে পর্য্যন্ত মনে তাহার ঐ চিন্তা উপস্থিত না হয় সে পর্য্যন্ত ঐ কর্মের অভাব বর্তমান থাকে। চিন্তা উপস্থিত হওয়া অবধি ঐ কর্মের ভাব (সত্ত্বা) আরম্ভ হয়। জ্ঞাতার পক্ষে ভাবকে ভাব এবং অভাবকে অভাব বলিয়া জানাই প্রকৃত জ্ঞান। কেহ যদি ভাবকে অভাব এবং অভাবকে ভাব বলিয়া মনে করে, তবে উহা বিপরীত (মিথ্যা) জ্ঞান হইল। এইজন্য, মনুষ্য যে কর্মের চিন্তা মনেও আনে নাই তাহার অভাব সংজ্ঞা হইয়া থাকে এবং ঈশ্বরেরও ঐ পদার্থের অভাব জ্ঞান হইয়া থাকে। যে সময় হইতে মানুষ কোন কর্ম্মের বিষয় মনে করে, তখন হইতে ঐ কৰ্ম 'ভাব' পদার্থ হইল এবং তখন হইতেই ঈশ্বর তাহাকে ভাব পদার্থরূপেই জানিতে পারেন। এই প্রকারে ঈশ্বর ত্রিকালজ্ঞ হইলেও মনুষ্যের স্বতন্ত্র কর্তা হইবার পক্ষে বাধা নাই।


  • তৃতীয় নিয়মঃ —পরমেশ্বর সত্য বিদ্যার আদিমূল এই কথা প্রথম নিয়মে বর্ণিত হইয়াছে। তৃতীয় নিয়মে বলা হইয়াছে যে, বেদ সত্য বিদ্যার পুস্তক। এই সকল কথার তাৎপর্য্য এই যে, (যাহা প্রথম নিয়মের ব্যাখ্যায় বলা হইয়াছে) বেদের আদিমূল (প্রকাশকর্তা) পরমেশ্বর। এইজন্য বেদ শ্রবণ এবং অধ্যয়ন করা আর্য্যদের সাধারণ ধর্ম্মই নহে, কিন্তু পরম ধর্ম্ম বলা হইয়াছে।


  • চতুর্থ নিয়ম :—ইহা আর্যসমাজের শোভা। যে সকল সম্প্রদায় সাধারণ এবং সম্পূর্ণ নিরর্থক বিষয় লইয়া নিজেরা মরিতে এবং অপরকে মারিতে প্রস্তুত। ইসলামের ইতিহাস ইহার দৃষ্টান্তে পরিপূর্ণ। এক মুসলমান সম্প্রদায়ের লোক অপর সম্প্রদায় কর্তৃক সামান্য মতভেদের কারণ নিহত হইয়াছে, অথবা ইহুদী ঈসাই প্রভৃতি অমুসলমানকে মুসলমানেরা বধ করিয়াছে, এরূপ বহু ঘটনা উহাতে পাওয়া যায়।

এই নিয়ম সেই সকল সম্প্রদায় হইতে আর্যসমাজকে পৃথক্ করিতেছে। কারণ, আর্য্যসমাজের প্রবর্ত্তক সত্যকে এমনই শ্রেষ্ঠ বস্তু মনে করিতেন এবং এই জন্য যে, বেদ এবং উপনিষদেও ঈশ্বরকে “সত্য” বলিয়া উল্লেখ করা হইয়াছে। ঈশ্বর “সত্যম্” একথার অর্থ কি? বৃহদারণ্যক উপনিষদে ইহার উত্তর পাওয়া যায়। “সত্যম্” শব্দ তিনটী শব্দের যোগে উৎপন্ন—স+তি+যম্। “স”=জীব, “তি”=ব্রহ্মাণ্ড এবং “যম্”=শাসক। এই প্রকার পরমেশ্বরের নাম “সত্য”। ইহা এইজন্য রাখা হইয়াছে যে, তিনি জীব এবং জগৎ উভয়কে শাসনে রাখেন (বৃহ, অ-৫, ব্রা-৫; ক ১)। এখন প্রশ্ন হইতেছে, এই (সত্যম্) ব্রহ্মকে কি প্রকারে পাওয়া যাইতে পারে? উপনিষদের উত্তর এই যে,–“তৎসত্যে প্রতিষ্ঠিতম্” সেই ব্রহ্ম সত্যে প্রতিষ্ঠিত আছেন। অতএব সত্যপ্রাপ্ত হইলেই এবং সত্য আচরণ করিলেই ব্রহ্মকে প্রাপ্ত হওয়া যায় (বৃহদারণ্যকোপনিষদ্)। ফলে ইহাই জানা গেল যে, সত্য হইতে বিমুখ হওয়া—ঈশ্বরের প্রতি বিমুখ হওয়ার তুল্য। এই জন্য বৈদিক সাহিত্যে সত্যের এত মহিমা কীর্ত্তন করা হইয়াছে।


  • পঞ্চম নিয়মঃ — এই নিয়ম শিক্ষা দিতেছে যে, কৰ্ত্তা প্রত্যেক কাৰ্য্য স্বয়ং বিচার করিয়া করিবেন। কার্য্য করিবার পূর্ব্বে তিনি বিচার করিয়া স্থির নিশ্চয় করিয়া লইবেন যে, করণীয় কার্য্য ধৰ্ম্ম কার্য্য এবং উহাতে অসত্যের কোন অংশ নাই। বৈদিক সাহিত্যে “সত্য” এবং “ধর্ম্ম” এক পৰ্য্যায় বাচক বিবেচিত হয়। এইজন্য উপনিষদে কথিত হইয়াছে :-

“যো বৈ স ধৰ্ম্মঃ সত্যং বৈ তত্তস্মাৎ সত্যং বদন্তমাহু ধৰ্ম্মং বদতীতি ধৰ্ম্মং বা বদন্তং সত্যং বদতীতি।”

“যাহা ধৰ্ম্ম তাহাই সত্য, এজন্য সত্যবাদীকে বলা হয় সে ধৰ্ম্ম কহিতেছে। এইরূপ যে ধৰ্ম্ম কহিতেছে তাহাকেও বলা হয় যে, সে সত্য বলিতেছে” (বৃহদারণ্যকোপনিষদ্ অধ্যায় ১ ব্রাহ্মণ ৪ কণ্ডিকা ১৪)। অতএব এই নিয়মের উদ্দেশ্য এই যে, চক্ষু বন্ধ করিয়া কাহারও অনুসরণ করার প্রথা পৃথিবী হইতে উঠিয়া যাক্। এই প্রথা সত্যের হ্রাস এবং অসত্যের বৃদ্ধি করিয়াছে।

  • ষষ্ঠ নিয়মঃ—এই নিয়মে দুইটী বিষয় বলা হইয়াছে। প্রথমতঃ, আর্য্যসমাজ যে [বৈদিক] ধর্ম্মের প্রচার করিতেছে উহা কোনও দেশ বা জাতি বিশেষের জন্য নহে। কিন্তু সমগ্র সংসারের জন্য। প্রমাণস্বরূপ ঋগ্বেদের এই প্রসিদ্ধ মন্ত্রে বলা হইয়াছে “ইন্দ্ৰং বর্ধন্তো অপুরঃ কৃশ্বস্তো বিশ্বমার্য্যম্। অপঘ্নস্তো অরাণঃ” (ঋগ্বেদ ৯, ৬৩, ৫)। অর্থাৎ দুর্গুণের বিনাশ এবং ঐশ্বর্য্যের বৃদ্ধির জন্য সমস্ত বিশ্বকে আর্য্য করিয়া লও। দ্বিতীয়তঃ, ব্যক্তি এবং সমাজের তিন প্রকারের উন্নতি করিতে হইবে, যথা— শারীরিক আত্মিক, এবং সামাজিক উন্নতি।
  • সপ্তম নিয়মঃ—এই নিয়ম সামাজিক ব্যবহারের মর্য্যাদা নিয়মিত করিতেছে। যথাঃ—যে ব্যক্তি যাহার যোগ্য তাহার সহিত সেরূপ ব্যবহার করিবে। পরন্তু প্রত্যেক ব্যবহার প্রীতি ও প্রেমের সহিত করিবে।
  • অষ্টম নিয়মঃ—অবিদ্যা (অজ্ঞান) রূপী দুর্ব্বলতাকে দূর করিয়া বিদ্যা (জ্ঞান) রূপী বল দ্বারা সংসারের সকল লোককে বলবান করিবার শিক্ষা এই নিয়ম দ্বারা দেওয়া হইতেছে।
  • নবম নিয়মঃ—এই নিয়ম শিক্ষা দিতেছে যে, সংসারে সমস্ত কলহের কারণ স্বার্থটিকে সমূলে উৎপাটিত করিয়া ফেলিতে হইবে।

প্রত্যেক মনুষ্য যদি নিজের উন্নতি সাধনের সময় অপরের উন্নতি সাধনের কথা চিন্তা করে, তবে সংসার শান্তিধাম হইয়া উঠিবে।


  • দশম নিয়মঃ—এই নিয়ম জাতি ও সমাজ এই দুইয়ের মধ্যে সীমারেখা অঙ্কিত করিয়া এতদুভয়ের প্রতি মানুষের কর্তব্য কি তাহার বিধান দিয়াছে। ব্যক্তিগতহিত সম্বন্ধীয় সকল কার্য্য করিবার প্রত্যেক ব্যক্তির পূর্ণ স্বতন্ত্রতা আছে। পরন্তু যে কার্য্য সর্ব্বহিতকারী ও যাহার সহিত সমাজের হিত বিজড়িত আছে সেই কার্য্যে প্রত্যেক ব্যক্তি নিজেকে সমাজের নিয়মাধীন মনে করিবে। এই বিধান দ্বারা ব্যক্তি ও সমাজ উভয়ের উন্নতি হইতে পারে।

 

মনুষ্য এই সংসারে তিনটি কর্তব্য পালন করিবার জন্য আসে -

১। আপনার প্রতি কর্তব্য। 

২। অপরের প্রতি কর্তব্য। 

৩। পরমেশ্বরের সমষ্টিরূপে আর্যসমাজের প্রতি কৰ্ত্তব্য।

আর্য সমাজের দশ নিয়মের ভিতর দিয়া নিয়মের উপর একদৃষ্টি এই তিনটি কর্তব্যের বিধান দেওয়া হইয়াছে।


[১] প্রথম ও দ্বিতীয় নিয়মে পরমেশ্বরের প্রতি কি কর্তব্য তাহার বিধান আছে। অর্থাৎ পরমেশ্বর জগতের রচয়িতা এবং বেদের প্রকাশক এই বিশ্বাস হৃদয়ে রাখিয়া তাঁহার এবং একমাত্র তাঁহারই উপাসনা করা মানুষের কর্তব্য।

[২] আর্যসমাজের ৩, ৪, ৫, নিয়মে মনুষ্য নিজের প্রতি কি কর্তব্য পালন করিবে, তাহার বিধান দিয়াছে। ঐ কর্তব্যগুলি এই :-

১। নিজে বেদ পড়িবে, অপরকেও পড়াইবে, নিজে শুনিবে অপরকেও শুনাইবে।

২। অসত্য ত্যাগ করিয়া সত্য গ্রহণ করিবে।

৩। প্রত্যেক কাৰ্য্য সত্যাসত্য বিবেচনা করিয়া সম্পাদন করিবে।


[৩] মনুষ্য অপর মনুষ্যের প্রতি কি কর্তব্য পালন করিবে শেষ পাঁচটি নিয়মে তাহার বিধান আছে। এবং সে কর্তব্যগুলি এই —

১। মনুষ্য মাত্রেরই শারীরিক আত্মিক এবং সামাজিক উন্নতির জন্য যত্নবান থাকা উচিত।

২। বিদ্যার বিস্তার করিতে হইবে।

৩। নিজের উন্নতির সহিত অপরের উন্নতির কথাও চিন্তা করিবে।

৪। সকলকে সামাজিক নিয়মের অধীন থাকিতে হইবে।

 

আমরা দেখিলাম যে, আর্যসমাজের নিয়মগুলি যদিও সংখ্যায় দশটি তথাপি উহাদের মধ্যে এত বিষয় সন্নিবিষ্ট আছে যে, উহা ব্যক্তি ও সমাজের ক্রমোন্নতির পক্ষে পর্যাপ্ত।

  •  মূল রচনাঃ মহাত্মা নারায়ণ স্বামী ।

© বাংলাদেশ অগ্নিবীর

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.