বিধবাবিবাহ মীমাংসা


আর্যসমাজ নিয়োগ ও বিধবাবিবাহ উভয়কে শাস্ত্রীয় হিসেবে সিদ্ধান্ত প্রদান করে । নিয়োগ সম্পর্কে আমরা ইতোপূর্বে আচার্যগণ কর্তৃক বিস্তৃত সিদ্ধান্ত প্রদান করেছি । আগ্রহীগণ পড়ে নিতে পারেন - নিয়োগ মীমাংসা

প্রশ্নঃ মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী বিধবাবিবাহে নানা দোষ প্রদর্শন করেছেন । তাহলে আর্যসমাজ বিধবাবিবাহ সমর্থন কেন করে ?  


উত্তরঃ

 
১। মহর্ষি একই সময়ে একাধিক বিবাহ নিষেধ করেছেন । 


২। অক্ষতযোনির পুনর্বিবাহ স্বীকার করেছেন । 

 

 
মহর্ষি এখানে  ক্ষতযোনি- বীর্য দ্বিজের পুনর্বিবাহ উচিত নয় বলেছেন । যারা একে আংশিক উদ্ধৃতি দেন তারা এটাও এড়িয়ে যান মহর্ষি ' অক্ষত যোনি নারী ও অক্ষত বীর্য পুরুষ ' এই দ্বিজ = ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় , বৈশ্যের পুনর্বিবাহ হওয়া উচিত বলেছেন ।

উল্লেখ্য মহর্ষি এখানে স্পষ্টভাবে অক্ষতযোনি স্ত্রী ও অক্ষত বীর্য পুরুষ উভয়ের কথাই উল্লেখ করেছেন । মহর্ষি প্রতিপাদিত সামাজিক এই সাম্য বিধবাবিবাহ বিরোধীদের দ্বারা কখনোই উদ্ধৃত হয় না ।

এছাড়া বিধবাবিবাহের বিরোধীরা স্বামীজীর উপদেশগুলোকে উদ্ধৃত করে আরেকটা কথাও ভুলে যায় । আমরা ওনার যে লেখা উদ্ধৃত করেছি, তার ঠিক আগে স্বামী জী একটি প্রশ্ন করেছেন। উদ্ধৃত করেছেন -
(প্রশ্ন) পুনর্বিবাহে দোষ কি ?

এর উত্তরে চারটি দোষ দেখিয়েছেন । পরন্তু এসব ক্ষত-যোনি বিধবা-বিবাহ এবং বহুবিবাহের  সম্বন্ধে দ্বিজের বিষয়ে রয়েছে । অক্ষত-যোনির বিষয়ে নয় । অক্ষত যোনির বিষয়ে তো তার সম্মতি মূখ্য যা উপরে দেওয়া হয়েছে। এর বাইরে দ্বিজদের মধ্যে  ক্ষত-যোনি বিধবা-বিবাহের স্থানে নিয়োগের বিধি লিখেছেন যা কিনা সম্পূর্ণ শাস্ত্রানুমোদিত । তিনি লিখেছেন -



এখানে উনি তিনটি উপায়, ক্ষত-যোনির বিধবা তথা ঐ ক্ষত- বীর্য পুরুষের জন্য করেছেন, যার স্ত্রী মারা গিয়েছে- 

(১) সে  ব্রহ্মচারী এবং ব্রহ্মচারিণী হয়ে থাকতে পারবে । যদি সন্তান নেওয়ার ইচ্ছা না থাকে তবে নিয়োগাদি আবশ্যকতা নেই ।
(২) যে ব্রহ্মচর্য পালন তো করতে পারবে, পরন্তু কুলের - পরম্পরার জন্য  সন্তানের ইচ্ছা রাখে, এমন অবস্থায় তাকে বাচ্চা দত্তক নেওয়ার আজ্ঞা দেওয়া হয়েছে ।
(৩)যে ব্রহ্মচর্যও পালন করতে পারবেনা তার জন্য নিয়োগের আজ্ঞা দেওয়া হয়েছে ।

অর্থাৎ নিয়োগকে মহর্ষি কখনোই মূখ্য বিধান দেননি । এখানে ৩য় স্তরে আছে । পাশাপাশি বিধবাবিবাহ বিচক্ষণ দ্বিজদের শ্রেয় কর্ম বিবেচনায়  উচিত নয় বলেও শূদ্রের জন্য বিহিত করেছেন । এর অন্যতম কারণ মহর্ষি বেদ প্রতিপাদিত এক পতি-পত্নী বিধান ও তারা বিবাহে যে শাশ্বত প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করেছে প্রেমানুকূল্ভাবে এক পতি-পত্নীর তাকেই মূখ্যত প্রাধান্য দিয়েছেন । এমতাবস্থায় মহর্ষি শ্রেয় সিদ্ধান্তকেই যে সমর্থন ও ঔচিত্য রূপে বর্ণনা করবেন সেটিই স্বাভাবিক । কিন্তু কালানুক্রমে বর্তমান সময় সম্পর্কে তিনি জ্ঞাত হয়ে বিধবাবিবাহও যে অনুমোদন দিয়েছেন তা আমরা পরেই দেখতে পাবো । তাছাড়া নিয়োগ সম্পূর্ণ ঐচ্ছিক ও আপৎকালীন বিধি । পরিবার - সমাজ - রাষ্ট্রের জ্ঞাতসারে ও অনুমতিপূর্বকই নিয়োগ হয়ে থাকে । বর্তমানে স্পার্ম ডোনেশন বা  অক্ষমপুরুষের জন্য উক্ত মাধ্যমের দ্বারা IVF করার একটি রূপ । মহর্ষি নিয়োগের আভ্যন্তরীণ বিধি বিস্তারিত উল্লেখ করেননি কেননা একে তো এটি আপৎকালীন পাশাপাশি স্মৃতিতে প্রদত্ত ব্যবহারিক বিধি যুগানুসারে পরিবর্তন হওয়া স্বাভাবিক ।

এজন্য স্বামী দয়ানন্দের নির্দেশ অনুসারে পুনর্বিবাহের চারটি দোষের উপর গুরুত্ব দেওয়ার অধিকার নেই তাদের যারা-

(১) পুরুষের জন্য পুনর্বিবাহ স্বীকার করে কিন্তু স্ত্রীদের ক্ষেত্রে করে না  । কেননা স্বামীজী স্ত্রী এবং পুরুষ দুজনেরই বিবাহের বিষয়ে সমানই অধিকার দিয়েছেন ।
(২) যে পুরুষ নিয়োগকে  মানেনা অথবা এর প্রচারকে দূষিত মনে করে । অথচ এটি মহর্ষি ৩য় বিকল্প হিসেবে দিয়েছেন ও বাধ্যতামূলক করেননি ।
(৩) যে স্মৃতি - পুরাণ অনুযায়ী বাল্যবিবাহের প্রথাকে উৎসাহিত করে । পড়ুন - প্রচলিত পুরাণ স্মৃতিতে বাল্যবিবাহ
(৪) বিধবার বিবাহ কিংবা কোন প্রকার নিয়োগ দুটোকেই অস্বীকার করে । 



প্রশ্নঃ মহর্ষি  দয়ানন্দ সরস্বতী তাহলে বিধবাবিবাহ খণ্ডন করেননি কেন ? 

 
উত্তরঃ মহর্ষি বিধবার বিবাহ স্বীকার করেছেন তা আমরা উপরে দেখিয়েছি । এখানে সিদ্ধান্ত ও মানসিকতার কোন পরিবর্তন নেই, পদ্ধতির পরিবর্তন হয়েছে কেবল আধুনিক সমাজে ।

 
পুনা প্রবচনের ১২তম দিনে মহর্ষি বিধবাবিবাহ খণ্ডনে অনিচ্ছুক বলেছেন - 

 

বিধবা বিবাহের যারা বিরোধীর তাদের পক্ষ সমর্থন করে বিধবাবিবাহের খণ্ডনের আমার ইচ্ছা নেই । তবে এটা অবশ্যই বলবো যে ঈশ্বরের নিকট নারী-পুরুষ উভয়েই সমান । কেননা তিনি ন্যায়কারী ও পক্ষপাতবিহীন । যখন পুরুষকে পুনর্বিবাহের আজ্ঞা দেওয়া হচ্ছে তবে নারীকে দ্বিতীয় বিবাহে কেন আটকানো হবে ?

 




মহর্ষি আরো বলেছেন এই নিয়োগ কেবল সন্তানের জন্য, যদি কারো সন্তাদির ইচ্ছা না থাকে তবে নিয়োগের কোন আবশ্যকতা নেই । 



আর মহর্ষি যে ব্রহ্মচর্যকেই সব শেষে উৎকৃষ্ট বলেছেন তার প্রমাণও বিদ্যমান -

যদি জিতেন্দ্রিয় হয় তবে তার জন্য বিবাহ [ এখানে বিধবা-বিধুরই প্রকরণ অনুযায়ী অপেক্ষিত ] ও নিয়োগ না করাই ভালো । কিন্তু যদি এমন না করতে পারে তবে  তার জন্য বিবাহ ও আপৎকালে নিয়োগ করা একান্ত কর্তব্য । 




অর্থাৎ মহর্ষি যে উভয়কেই স্বীকার করেছেন তার সুস্পষ্ট প্রমাণ এটিই ।

প্রশ্নঃ সবই তো ঠিক আছে । তবে মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী বাস্তবে বিধবাবিবাহ প্রচার করেছেন তার দৃষ্টান্ত কি ?  
উত্তরঃ উপরের আলোচনায় আমরা স্পষ্টভাবেই দেখিয়েছি মহর্ষি ৩ টি বিকল্প প্রদাব করেছেন, নিয়োগকে আপৎকালীন বলেছেন ও জিতেন্দ্রিত হলে না করাই ভালো বলেছেন এবং যদি কেউ করতে চায় পরিবার-সমাজ অনুমতি নিয়ে তবেই তার বিধি বর্ণনা করেছেন । স্বীয় পুনা প্রবচনে বিধবাবিবাহ খণ্ডনে অনিচ্ছা প্রকাশ করেছেন ।

সত্যার্থ প্রকাশ রচনার পরেও তিনি তার নানা রচনায় বিধবাবিবাহের পূর্ণ সমর্থন ও অনুমতি দিয়েছে তার প্রমাণ নিম্নরূপ -


প্রশ্নঃ বেদের দৃষ্টিকোণে বলুন বিধবা স্ত্রী ও  বিপত্নীক পুরুষের পুনর্বিবাহ হওয়া উচিত নাকি অনুচিত ?  স্বীয় স্ত্রী জীবিত থাকতে বা মৃত্যুর পরে ২য় বা ৩য় বিবাহ দোষজনক কি না ?  

উত্তরঃ বিধবা স্ত্রীর পুনর্বিবাহ হওয়া উচিত এবং নিজের স্ত্রী জীবিত থাকতে দ্বিতীয় বিবাহ করা যাবে না । কিন্তু স্ত্রীর মৃত্যুর পর অধিকার রয়েছে সে পুনর্বিবাহ করবে নাকি করবে না । এমন অধিকার বিধবা স্ত্রীরও
হওয়া উচিত ।

- মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতীর জীর জীবনচরিত [পণ্ডিত লেখরাম ] - পৃষ্ঠা ২৮৭-৮৮

 

 

 

আরেকটি প্রমাণ, কলকাতা ভ্রমণকালে বিধবাবিবাহ সমর্থন ও ১৮ বছরের আগে বিয়ে না দেওয়ার কথা  [ স্বামী দয়ানন্দের জীবনচরিত এবং তার শিক্ষা - মহর্ষির সাক্ষাৎ শিষ্য  হরবিলাস সারদা ]



এজন্যই মহর্ষি প্রণীত সূত্র ও শিক্ষা অনুসারে আর্যসমাজ বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে যেমন আইনানুগ, পরিবার-সমাজ- রাষ্ট্রের জ্ঞাতসারে ও শাস্ত্রীয় অনুমোদনের মাধ্যমে নিয়োগের আধুনিক সংস্করণকে যেমন অনুমোদন প্রদান করে একইভাবে সমাজের বৃহত্তর হিতের জন্য বিধবাবিবাহ সমর্থন ও প্রচার করে আসছে ও করবে ।

নিম্নোক্ত আলোচনাও দ্রষ্টব্য - 

 



Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.