অজেয় শাস্ত্রার্থ মহারথী, বিখ্যাত‌ ধর্মোপদেশক, সর্ব‌ শাস্ত্র‌ নিষ্ণাত বিদ্বান, ইসলাম মতবাদের‌ প্রকাণ্ড জ্ঞাতা‌ পণ্ডিত রামচন্দ্র দেহলবী‌

       পণ্ডিত রামচন্দ্র দেহলবী‌  

ধর্ম প্রেমী সজ্জনবৃন্দের নিকট পণ্ডিত রামচন্দ্র জী অত্যন্ত প্রিয় ব্যক্তি ছিলেন। তাঁর তেজস্বী ও অত্যন্ত বিদ্বতাপূর্ণ ভাষণ শ্রবণ করে সবাই মুগ্ধ হতেন। পণ্ডিতজীর বিরোধী লোকজন তাঁর যুক্তিপূর্ণ এবং প্রমাণবহুল খণ্ডন শুনে নিশ্চুপ হয়ে যেতেন। এবং তার প্রশংসা করে ফিরতেন। 

পণ্ডিত রামচন্দ্র দেহলবীজী বেদশাস্ত্র ও বৈদিক সাহিত্যের অপূর্ব মন্থনকর্তা বিদ্বান এবং জৈন, বৌদ্ধ, পৌরাণিক, ইসলাম ও খ্রিস্টমতের ধীমান শাস্ত্রবিৎ ছিলেন। তাছাড়া তিনি সংস্কৃত, হিন্দি, ইংরেজি, সাথে সাথে আরবী ও ফারসি ভাষা ও ব্যাকরণ আদির পূর্ণ বিদ্বান ছিলেন।  পণ্ডিতজী নিজের বিদ্বতা, শাস্ত্রার্থ শৈলী,  তেজস্বী বক্তব্য ও স্বাধ্যায়শীলতার গুণে আর্য জগতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে আছেন। 


মূল নিবাস 


দেহলবী জীর পিতামহ দিল্লীর মূল নিবাসী ছিলেন। ভারতবর্ষের প্রথম সতন্ত্রতা সংগ্রামের কিছুদিন পূর্বে  তিনি পরিবার সহিত মালবা গিয়ে বসবাস শুরু করেন। 


পরিবার পরিচয় 


পণ্ডিতজীর পিতার নাম ছিলো মুন্সী ছোটেলাল। তিনি বড়ো তেজস্বী মেজাজের ব্যক্তি ছিলেন। ইংরেজ অফিসারদের উর্দু ও ফারসি ভাষা শেখানো তাঁর কাজ ছিলো। তিনি ধার্মিক বিচারে, সম্পূর্ণ আর্যসমাজী কিংবা সম্পূর্ণ পৌরাণিক কোনোটাই ছিলেন না। আর্যসমাজ মন্দির এবং পৌরাণিক মন্দির উভয় স্থানেই যাতায়াত করতেন এবং বলতেন যে না জানি কখন কি মিলে যায়। 

পণ্ডিতজীর মাতার নাম ছিলো শ্রীমতী রামদেই। তিনি মালবার কোনো এক ভীল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ভীলদের গ্রামে থাকায় তিনি একজন নির্ভীক নারী ছিলেন। 

পণ্ডিতজী তাঁর মাতা পিতার দ্বিতীয় সন্তান ছিলেন। পণ্ডিতজীর বড় ভাইয়ের নাম শ্রী শিবকরণ জী। পণ্ডিতজীর জন্মের আগে তাঁর মাতা পিতার তিন সন্তান ভূমিষ্ঠ হয় এবং মারা যায়। এতে তাঁর মাতা-পিতা খুবই দুঃখী ছিলেন। পুনরায় সন্তান যাতে মারা না যায় এজন্য তাঁরা অনেক জপ-তপ করেন এবং নানা রকম লোকাচার পালন করেন। 

৮ এপ্রিল ১৮৮১ সন, তদানুসারে চৈত্র শুক্ল নবমী সম্বৎ ১৯৩৮ বিক্রমাব্দে পণ্ডিতজীর জন্ম হয়। পণ্ডিতজীর জন্মের দিন মহা রামনবনী তিথি ছিলো । এই শুভদিনে শিশুর জন্ম হওয়ায় তাঁর মাতা-পিতা খুশি হয়ে ভগবান শ্রীরামচন্দ্রের নাম অনুসারে নবজাতক শিশুর নামকরণ করেন। খুব আদর যত্নের সাথে শিশু রামচন্দ্রের পালন শুরু হয়। পণ্ডিতজীর মা তাকে খুবই ভালোবাসতেন। রাগী মেজাজী পিতা অনেকসময় ক্রোধের বশবর্তী হয়ে বালক রামচন্দ্রকে প্রহার করতে উদ্যত হলে মাতা এসে বলপূর্বক তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বলতেন, "যাই হয়ে যাক না কেন, আমার ছেলের গায়ে কাউকে হাত তুলতে দেব না। " 

রামচন্দ্রজীর পরে তাঁর ছোট দুই ভাইয়ের জন্ম হয়, তাঁদের নাম শ্রী শিবলাল জী ও শ্রী জিয়ালাল জী। 

রামচন্দ্রের বয়স যখন মাত্র সাত বছর তখনই তাঁর মাতা দেহত্যাগ করেন। এতে বালক রামচন্দ্র অনেক দুঃখ পান। আর এতো অল্প বয়সে মাতৃহীন হয়ে তিনি ঘরের কাজ সামলাতে শুরু করেন। প্রায় দশ মাস ধরে তিনি নিজের ছোট দুই ভাইকে খাবার বানিয়ে খাওয়ান। এরপর পণ্ডিতজীর পিতা মুন্সী ছোটেলাল দ্বিতীয় বিবাহ করে নেন। তাঁর সৎ মায়ের নাম ছিলো লাডী । পণ্ডিতজী বলতেন, লাডী অত্যন্ত সুন্দর এবং সুশীল নারী ছিলেন কিন্তু আমি তাঁকে কখনো মা বলে ডাকতে পারিনি, লাডী বলেই ডাকতাম। 

সৎ মায়ের গর্ভে রামচন্দ্র জীর আরও দুই ভাই উৎপন্ন হয়। শ্রী মগনলাল ও শ্রী ছগনলাল। এর মধ্যে বাল্যাবস্থাতেই মগনলালের মৃত্যু হয়ে যায়। 


শিক্ষাজীবন


ঘরের কাজের সাথে সাথে বালক রামচন্দ্র পড়াশোনাতেও মনোনিবেশ করেন। নীমচের একটা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তিনি পড়তে যেতেন।  রামচন্দ্র জী বাল্যকাল থেকেই অত্যন্ত কুশাগ্রবুদ্ধিসম্পন্ন বালক ছিলেন। তাঁর স্কুলে একই ক্লাসে আবিদ আলী নামক একজন বালক পড়াশোনা করতো। ক্লাসে কখনো রামচন্দ্র প্রথম স্থান অধিকার করতেন কখনো আবিদ আলী প্রথম হতেন। 

এখানে রামচন্দ্র ইংরেজির সাথে সাথে ফারসির প্রথম পাঠ অধ্যয়ন করেন। এরপর আজমেরের ডী.এ.বি স্কুল থেকে প্রথম গ্রেডে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। 

নিজের কঠিন পরিস্থিতির কথা বলতে গিয়ে পণ্ডিতজী একবার আমাদের বলেছিলেন, " আমি আজমেরে আমার এক বন্ধুর বাড়িতে এক কক্ষে থাকতাম। প্রশ্ন পত্র দিয়ে যখন ফিরতাম তখন নিজের হাতে রুটি তৈরী করতাম।  এবং সেই রুটি দই দিয়ে খেতাম।  কয়েকদিন ধরে এভাবে শুধু দই রুটি খাওয়ায় আমার জ্বর হয়ে যায়। আর আমাকে এভাবে জ্বর নিয়ে দুর্বল অবস্থাতেই পরীক্ষা দিতে হয়েছিলো। "


রামচন্দ্র মিডিল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেন। কিন্তু এর পর রামচন্দ্রের পিতা তাঁকে পড়াশোনায় আপত্তি করে দেন এবং পড়াশোনা বাদ দিয়ে তাঁর সাথে দোকানে কাজ করার জন্য বলেন। রামচন্দ্রজীর পড়াশোনার প্রতি বিশেষ আগ্রহ ছিলো। তিনি আরো পড়াশোনা করতে চাইছিলেন। কিন্তু তাঁর পিতার আপত্তির কারণে পড়া হবে না। এজন্য রামচন্দ্র বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়ার জন্য মনস্থির করে নেন। 


 তাঁর বড় ভাই শ্রী শিবকরণ জী নীমচ এর নিকটে কোথাও রেলকর্মী হিসেবে কাজ করতেন। তিনি পালিয়ে বড়ো ভাইয়ের কাছে যাওয়ার পরিকল্পনা করেন। এবং সেখানে যাওয়ার পথের সব রেলওয়ে স্টেশনের নাম ও অন্য তথ্যাদি  জেনে রাখেন যেন কখনো ভুলবশত নিজের গন্তব্য স্টেশন ছেড়ে অন্যত্র না চলে যান।  অতঃপর একদিন রাতে দোকান থেকে কিছু টাকাপয়সা সাথে নিয়ে রামচন্দ্র পালিয়ে যান। এবং গাড়িতে উঠে পড়েন। রাতের সময় ছিলো, হঠাৎ রামচন্দ্রের ঘুম চলে আসে। বালকই তো ছিলেন। যখন চোখ খুলেন তখন গন্তব্য ছেড়ে এসেছেন মনে করে ট্রেন থেকে নেমে যান এবং যেহেতু স্টেশনের নাম জানা ছিল তাই তা দেখে গন্তব্য সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে পুনরায় ট্রেনে উঠে বসেন। এদিকে রামচন্দ্র বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছেন এমন সন্দেহ করে পুলিশ তাঁকে ধরে ফেলে। তারা তাঁকে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে নিয়ে যায়। কিন্তু রামচন্দ্রজী বালক হওয়া সত্ত্বেও  তাতে ভীত না হয়ে পুলিশ ও ম্যাজিস্ট্রেটকে বড়ো নির্ভীকতাপূর্বক ঘর থেকে পালিয়ে আসেননি বরং নিজের বড়ো ভাইয়ের কাছে যাচ্ছেন এমনটা বুঝিয়ে দেন। ট্রেনের টিকিটও দেখিয়ে দেন। তাঁর স্বচ্ছ ও সরল কথাবার্তা দেখে ম্যাজিস্ট্রেট মহোদয় তাঁর উপর সন্দেহ রাখতে পারেননি। এবং তাঁকে যাওয়ার জন্য অনুমতি দিয়ে দেন। 


রামচন্দ্র নিজের বড়ো ভাই শিবকরণ জীর কাছে পৌছান এবং সব খুলে বলেন। এতে তাঁর ভাই তাঁকে নিজের কাছে রাখেন এবং পড়াশোনার ব্যাবস্থা করে দেন। ইন্দৌর কলেজ থেকে রামচন্দ্র জী এন্ট্রান্স পরীক্ষায় অত্যন্ত কৃতিত্বের সাথে প্রথম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হন। এবং তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা এখানেই সমাপ্ত হয়ে যায়। 



বিবাহ এবং কর্মজীবনের শুরু 


রামচন্দ্রের সৎ মা তাঁর পিতার তুলনায় কম বয়সী ছিলেন। বিধায় সন্তানোৎপাদন তথা প্রসবের সময় তাঁর খুবই কষ্টের সম্মুখীন হতে হতো। তৃতীয় সন্তানের জন্মের সময় প্রসব কষ্টের কারণে তাঁর দেহাবসান হয়। গৃহিণীর অভাবে গৃহের অবস্থা একেবারে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। ঘরে পুনরায় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার একমাত্র উপায় ছিলো রামচন্দ্রের বিবাহ সম্পন্ন করা এবং সেটাই করা হলো। অল্প বয়সেই তাঁর বিবাহ দিয়ে দেওয়া হয়। তাঁর ধর্মপত্নীর নাম ছিলো, শ্রীমতী কমলা দেবী। তিনি দিল্লীর কন্যা ছিলেন। 


বিবাহের পর ছিন্ন-ভিন্ন পরিবারের সব দায়িত্ব রামচন্দ্রজীর কাধে এসে পড়ে। তাই তিনি নীমচের সেই প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চাকরি নেন, যেখানে তিনি নিজে পড়াশোনা করেছিলেন।  স্কুলের নতুন শিক্ষকদের ক্ষেত্রে, সবাই নানাভাবে তাঁদের যোগ্যতা, বিদ্বতার পরীক্ষা নিতে থাকে। রামচন্দ্র জীকেও সবাই তেমন পরীক্ষা করে। নিত্যনতুন কঠিন সমস্যা এনে সমাধানের জন্য তাঁকে অনুরোধ করে। কুশাগ্রবুদ্ধি রামচন্দ্রজী অত্যন্ত সরলতার সাথে হাস্যোজ্জ্বল বদনে তা সবই সমাধান করে দিতে থাকেন। এমন গুণের কারণে ছাত্রাদির মধ্যে তিনি অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে উঠেন। 

ধীরে ধীরে তাঁর পারিবারিক সমস্যা ও দারিদ্র্যতাও দূর হতে থাকে। এবং রামচন্দ্র জী নিজের বৈবাহিক জীবন শুরু করেন। সর্বপ্রথম তাঁর এক কন্যা সন্তানের জন্ম হয়। যিনি এখনও জীবিত আছেন। (গ্রন্থকারের বর্ণনা অনুসারে)


রাজস্থানের মহিলারা গৃহকলহের জন্য প্রসিদ্ধ। কপট চাল, কুটিল কথাবার্তা, ঝামেলা বাধানো এসব তাদের প্রধান অস্ত্র ছিল আর এসব তাদের বিপক্ষের প্রতি তারা খুবই নির্মমভাবে ব্যাবহার করতেন। পণ্ডিতজীর সহধর্মিণীর সাথে কিছু প্রতিবেশী মহিলা ঝগড়া বাধায়। এবং দিনে দিনে সেখানকার পরিস্থিতি অশান্তিময় হয়ে উঠতে থাকে, পণ্ডিতজী যখন এসব জানতে পারেন তখন নিজের পরিবার সমেত দিল্লিতে চলে যান। দিল্লিতে গিয়ে সেখানে 'রৈলী ব্রাদার' নামক একটি ইংলিশ ফর্মে মাসিক ১৫ রুপি বেতনে নতুন চাকরি নেন। পণ্ডিত রামচন্দ্রজী অত্যন্ত কর্মনিষ্ঠ এবং কর্তব্যপরায়ণ ছিলেন। তাঁর হিন্দি এবং ইংরেজি হাতের লেখা অত্যন্ত সুন্দর এবং গোছানো ছিলো। এই কোম্পানির মালিক রামচন্দ্রজীর হাতের লেখা এবং কাজে খুব প্রসন্ন ছিলেন। তিনি ছুটির দিনেও রামচন্দ্রজীকে অফিসে ডেকে নিতেন। একবার কোনো এক কারণবশত তিনি সাহেবের ডাকে কার্যালয়ে যেতে পারেন নি । পরেরদিন সাহেব তাকে না আসার কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি নির্ভীক চিত্তে উত্তর দেন , " রবিবার তো আমার ছুটির দিন ছিল । আর আমার কাজও ছিলো, এজন্য আসি নি। Even God rested on the seventh day. সেখানে আমি তো মানুষ। গডও সপ্তম দিনে বিশ্রাম করেন , সুতরাং আমারও সপ্তাহে একদিন ছুটি পাওয়ার অধিকার আছে । " সাহেব এমন উত্তরে মনে মনে অসন্তুষ্ট হয়ে যান এবং বলেন , “Well ! Mr. Ram Chandra , I want to do something but leave it now . ” রামচন্দ্রজী অত্যন্ত আত্মমর্যাদা সম্পন্ন ব্যক্তি ছিলেন তিনি শীঘ্রই কোম্পানিতে নিজের পদত্যাগপত্র জমা দেন । এবং চাকরি থেকে বেরিয়ে আসেন। তারপর নিজের শ্বশুরের স্বর্ণালংকার তৈরির দোকানে কাজে লেগে পড়েন । 


তার সততা ছিলো চমকপ্রদ। গহনা বানানোর জন্য যেই সোনা লোকজন দোকানে দিয়ে যেতো সেসবকে তিনি আলাদা আলাদা পুটলিতে বেধে রাখতেন । যখন কেউ নিজের দেওয়া সোনা গহনা না বানিয়েই নিয়ে যেতে চাইতো তখন তিনি সেই বেধে রাখা পুটলি তাকে দিয়ে দিতেন । সোনার পরিমাণ যেভাবে ছিল ঠিক তেমনই আছে এটা দেখে অনেকেই আশ্চর্য হতেন । অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই রামচন্দ্রজী স্বর্ণকারের কাজ আয়ত্ত করে নেন এবং কিছুদিনের মধ্যেই একজন দক্ষ কারিগর হয়ে উঠেন । 


সন্তানাদি


দিল্লী এসে পণ্ডিতজীর পাঁচ সন্তানের জন্ম হয়। চার কন্যা এবং এক পুত্র। এর মধ্যে তিন কন্যাসন্তাই শৈশবে মারা যায়। এভাবে তাঁর সন্তানাদির সংখ্যা কেবল তিন কন্যাই থেকে যায়। কন্যাদের জন্মে তাঁকে কখনোই অসন্তুষ্টি প্রকাশ করতে দেখা যায় নি বরং তিনি সদা প্রসন্নই হতেন। পণ্ডিতজীর পুত্রসন্তান দেখতে খুবই সুন্দর ছিলো। একেবারে যেন পণ্ডিতজীর মতো! পুত্রের মুখ দেখে পণ্ডিতজী বলেছিলেন, "এতো সুন্দর শিশু তো আমার ঘরে থাকার যোগ্য নয়।" পণ্ডিতজীর একথা সত্য সিদ্ধ হলো, জন্মের মাত্র ১৮ দিন পরেই সে শিশুটি মারা যায়। পুত্রসন্তানের মৃত্যুতে পণ্ডিতজীর পত্নী কমলা দেবী খুবই শোকাকুল হয়ে যান। তিনি অনেকদিন অসুস্থও ছিলেন। এসময় পণ্ডিত জী তাঁর খুব সেবা শুশ্রূষা করেন। কন্যাদের মৃত্যুতে তিনি(কমলাজী) বার বার অশ্রুপাত করতেন। অনেক সময় শিশুদের মতো কান্নাকাটিও করতেন। মহল্লার যেকোনো শিশুর মৃত্যুর খবর শুনলেও অনেক দুঃখ প্রকাশ করতেন।

 

পণ্ডিতজীর সহধর্মিণী শ্রীমতী কমলাদেবীর দেহান্ত


ছোট কন্যার জন্মের পর কমলাদেবী ইনফ্লুয়েঞ্জা রোগে আক্রান্ত হন। এবং এই রোগই তাঁর জন্য প্রাণঘাতী হয়ে যায়। পণ্ডিতজী প্রাণপণে তাঁর সেবা-যত্ন করেন। কিন্তু তিনি নিজ অর্ধাঙ্গিনী-কে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করতে পারেন নি।


পুনর্বিবাহের প্রস্তাবে অসম্মতি


নিজ ধর্ম পত্নীর শবে হাত রেখে তিনি প্রতিজ্ঞা করেন, " দেবী যে দৃষ্টিতে আমি তোমাকে দেখেছি এখন এমন দৃষ্টি আর কোন শরীরের উপর পড়বেনা। এই দৃষ্টি (স্ত্রীর দৃষ্টিতে দেখা) তোমার শরীরের সাথেই সমাপ্ত হয়ে গেলো। এখন জগতে আমার জন্য মাতা, ভগিনী এবং কন্যার ন্যায় সম্পর্কই থাকবে। "

ধর্মপত্নীর দেহাবসানকালে পণ্ডিতজীর বয়স কেবলমাত্র ৩৬ বছরই ছিলো। ধর্মীয় জগতে পণ্ডিতজীর পদচারণা থাকায় তাঁর সুখ্যাতি ও পাণ্ডিত্যের কথা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। পণ্ডিতজীর গুণমুগ্ধা অসংখ্য রূপবতী,গুণবতী,বিদ্যা ও ধনবান তরুণী তাঁকে সহস্তে লিখিত বিবাহের প্রস্তাবপত্র প্রেরণ করেন । কিন্তু পণ্ডিত রামচন্দ্রজী নিজের প্রতিজ্ঞায় অটল থাকেন। বিবাহের প্রস্তাবপত্রের উত্তরে তিনি সেসকল তরুণীকে কন্যাবাচক শব্দ দ্বারা সম্বোধিত করেন। এবং পুনর্বিবাহে তাঁর অসম্মতির কথা জানিয়ে দেন। 


আর্থিক অবস্থা


পণ্ডিতজীর আর্থিক অবস্থা কখনোই তেমন ভালো ছিলো না। একবার পণ্ডিতজীর বাড়িতে এক অন্য ধর্মাবলম্বী পুলিশের প্ররোচনায় চুরির ঘটনা ঘটে। সেসময় এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিলো যে তাঁর শাকপাতা কেনার মতো টাকাও ছিলো না। তখন ঘরে রাখা পুরানো পত্রিকার স্তুপ বিক্রি করে অন্নসংস্থান করতে হয়েছিলো। 


এছাড়া তাঁর জীবনে এমন সময়ও পার করতে হয়েছে যে, আর্থিক দুরাবস্থার কারণে দুবেলা ভরপেট ভোজনও করতে পারতেন না। সকালে তিনি একটি লাড্ডু আর আধা সের দুধ পান করে দোকানে যেতেন। সারাদিন ক্ষুধার্ত অবস্থায় দোকানে কাজ করে সন্ধ্যায় এসে খাবার খেতেন। জীবনের এমন দুঃসময়েও পণ্ডিতজী নিরন্তর ধর্মপ্রচারে রত ছিলেন। যখন প্রচারের (ভাষণ, ব্যখ্যানের) জন্য কোথাও যেতে হতো তখন তিনি ভাড়ার সম্পূর্ণ খরচ নিজের পকেট থেকে ব্যায় করতেন। কিছু সন্ন্যাসী মহাত্মারা তাঁকে এমন না করার জন্য আদেশ দেওয়ায় তিনি এটা বন্ধ করেন।


ধার্মিক জগতে পদার্পণ


নিজের অত্যন্ত কণ্ঠকময় পারিবারিক জীবনের কষাঘাতে জর্জরিত হয়েও পণ্ডিতজী কখনো নিজের উদ্যম হারান নি। এতো দুঃখ কষ্টের দিনেও তিনি বিদ্যাচর্চা তথা ধর্মীয় পুস্তকাদি অধ্যয়ন থেকে বিরত না হয়ে নিরন্তর স্বাধ্যায় চালিয়ে যেতেন। কিন্তু বিধি যেন তাঁর সম্পূর্ণ প্রতিকূল হয়ে উঠেছিল। বারবার বিভিন্ন আঘাতে তাঁকে পথচ্যুত করতে চাইছিলো। যেমন ,টানা ছয় মাস পণ্ডিতজীর চোখে এক বিষম রোগ হয় ,তখন তিনি চোখে পট্টী বেধে বসে তাঁর শ্যালক মহাশয়ের দ্বারা বিভিন্ন গ্রন্থ পাঠ করিয়ে তা শ্রবণ করতেন। এভাবে তিনি নিজের স্বাধ্যায় অব্যাহত রাখেন।


 দিল্লীর ফব্বারায় সপ্তাহে দুইদিন মুসলমান এবং সপ্তাহে দুইদিন খ্রিস্টানগন নিজেদের ধর্ম প্রচার করত । পণ্ডিতজী প্রায়ই তাদের ভাষণ শুনতে যেতেন । সেখানে সনাতন ধর্মের প্রতি তাদের নির্মম আঘাত ও অগুণতি মিথ্যাচার তিনি নিজে প্রত্যক্ষ করেছিলেন। এসব শুনে পণ্ডিতজীর স্বাভিমানী মন জ্বলে উঠে। তিনি নিজেকে বললেন , "আরে! তোর এতো স্বাধ্যায় দিয়ে কি লাভ? সব তো বেকারই পড়ে আছে!" মুসলমান এবং খ্রিষ্টানদের ২+২=৪ দিন + সাপ্তাহিক ছুটির দিন বাদে আরো দুইদিন খালি ছিলো। তিনি সেই দুইদিন নিজে বক্তব্য দিবেন বলে মনস্থির করলেন। এবং পুলিশকে এ বিষয়টি জানিয়ে দেন । তবে পুলিশের থেকে আজ্ঞা চাইলেন না যে সপ্তাহে দুইদিন তিনি বক্তৃতা দিবেন। যে রাতে তিনি পরের দিন ব্যখ্যান দেওয়ার জন্য মনস্থির করেন সে রাতে তিনি উত্তেজনায় ভালোভাবে ঘুমোতে পারেন নি। পণ্ডিতজীর ধর্মপত্নী কমলাদেবী তখনও জীবিত ছিলেন। পণ্ডিতজীর এমন অস্থিরতা দেখে তিনি তার কারণ জিজ্ঞেস করেন, পণ্ডিতজী তাঁকে সব বলেন । সেসময় পণ্ডিতজীর এই সিদ্ধান্তের গুরুত্ব কমলাদেবী ততোটা ভালোভাবে না বুঝলেও সর্বদা তাঁর এই চেষ্টায় সহায়িকা হয়েছিলেন। পরের দিন পণ্ডিতজী ফব্বারায় নিজের বক্তৃতা দিলেন।  ব্যাখ্যানের পূর্বে তিনি আধা ঘণ্টা ভজনও গায়ন করতেন। ব্যাস! এই নিয়ম চালু হয়ে গেলো। পণ্ডিতজী রোজ ট্রামযোগে ফব্বারায় গিয়ে মুসলমান এবং খ্রিষ্টানদের অপপ্রচারমূলক মন্তব্যসমূহকে ইংরেজিতে নোট করে নিয়ে আসতেন এবং নিজের বক্তৃতার দিনে এসব অপপ্রচারের কঠোর খণ্ডন করে বৈদিক ধর্মের মণ্ডন করতেন। তাঁর স্বাধ্যায় অগ্নির সামনে মুসলমান এবং খ্রিষ্টান আলেমদের বড়াই চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায় এবং সেখানে মাহফিল বসিয়ে সনাতন ধর্মের বদনাম করার দিনও শেষ হয়ে যায়। 


পণ্ডিতজীর একেকটা ব্যাখ্যানে শ্রোতার সংখ্যা এতো ছিল যে, যেই স্থানে ব্যাখ্যানের আয়োজন করা হতো সেখানে এতো মানুষের সংকুলান হওয়া অসম্ভব হয়ে পড়তো । পরে  পুলিশ গান্ধী গ্রাউন্ডে ব্যাখ্যানের স্থান করে দেয়। পণ্ডিতজীর এই ব্যাখ্যান কার্যক্রম (সপ্তাহে ছয় দিন পর্যন্ত ও) টানা ১৫ বছর (সন্ ১৬১০-১৬২৫ পর্যন্ত) ধরে চলেছিল।  আশ্চর্যের কথা এই যে এতো দীর্ঘ সময়ব্যাপী ব্যাখ্যানের ধারাবাহিকতার কোনো ব্যতিক্রম নেই যদিও পণ্ডিতজীর পুত্র এবং কর্তব্যপরায়ণ ধর্মপত্নী কমলাদেবীর মৃত্যুও তাঁর ব্যাখ্যানের জন্য নির্দিষ্ট দিনেই হয়েছিলো। 


⭕ এমন উদাহরণ আমাদের অন্য কোনো বিদ্বানদের ক্ষেত্রে দেখা যায় না । একটানা ১৫ বছর ধরে প্রবচন দিয়ে যাওয়া পণ্ডিতজীর এক অসাধারণ রেকর্ড। যা আর কেউ গড়তে পারেননি । ভাঙ্গা তো অতি দুরূহ। এর মাধ্যমে আমরা পণ্ডিতজীর জনপ্রিয়তা এবং সুযোগ্যতার অনুমান করতে পারি।  


এই সময়ে পণ্ডিত রামচন্দ্রজীর বুদ্ধিমত্তা, অদ্ভুত তার্কিক শৈলী, অনুপম কার্য প্রণালী এবং পাণ্ডিত্যের তেজের কথা ভারতবর্ষের প্রতিটি কোণায় কোণায় ব্যাপ্ত হয়েছিলো । দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ধর্ম-প্রচারের জন্য পণ্ডিতজীর ডাক আসতে থাকে । দেশ এবং সময়ের দাবীর যথার্থতা বিবেচনায় রেখে পণ্ডিতজী ধর্ম প্রচারার্থ দেশের বিভিন্ন স্থানে গমনাগমন করা আরম্ভ করে দেন।


অবৈদিক মতবাদের অধ্যয়ন 


পণ্ডিতজী ফব্বারায় বক্তৃতা দেওয়ার দিনগুলোতে বৈদিক শাস্ত্রের পাশাপাশি কুরাণ এবং বাইবেলও অধ্যয়ন করেছিলেন। তাঁর কুরাণ পড়ার কাহিনি বেশ মনোমুগ্ধকর। তিনি তাঁর শ্বশুরের সামনে কুরাণ পড়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করলে শ্বশুরজী তাঁর পরিচিত এক হাফেজের সাথে পণ্ডিতজীর সম্পর্ক করিয়ে দেন । হাফেজ সাহেব দিল্লিরই বাসিন্দা ছিলেন । তিনি পণ্ডিতজীকে কুরাণ পড়তে আগ্রহের কারণ জিজ্ঞেস করলে পণ্ডিত জী উত্তর দেন, হকের খোজ করার জন্য, সত্যকে জানার জন্য কুরান পড়তে চাই । হাফেজ সাহেব তাঁর উত্তর শুনে বড়ো খুশি হন এবং পণ্ডিতজীকে কুরাণ পড়ানো শুরু করে দেন। তিনি লুকিয়ে পড়াতেন। পণ্ডিতজী হাফেজকে কাধে করে নিয়ে আসতেন এবং পড়া শেষে আবার কাধে তুলে তার বাসায় দিয়ে আসতেন । পণ্ডিতজী হাফেজ সাহেবের নাম কখনো বলেননি কারণ তিনি জানতেন যে নাম বললে তার উপর নানা বিপদ আসতে পারে। কেননা মুসলমানরা অমুসলিমকে কোরাণ শেখানোর পক্ষে ছিলো না । কয়েকবার তো এমনও হয়েছে যে , মুমিনগণ কোনো কোনো হাফেজকে সন্দেহ করে ধরে জিজ্ঞাসা করেছিলো , " তুমি রামচন্দ্র দেহলবীকে কুরআন শরিফ পড়াও কি না? " যখন সেই হাফেজ ঈমান এবং ধর্মের কসম খেয়ে 'না' বলতো তখন তারা তাকে ছাড়তো।


পণ্ডিতজী হাফেজের কাছ থেকে পুরো দুই মাসে কোরাণ-শরিফ পড়া শেষ করেন । তাঁর ওস্তাদ হাফেজ পণ্ডিতজীর আয়াত পড়া শোনে প্রসন্ন হতেন। তিনি বলতেন আমি অনেক বড় বড় শিষ্য পেয়েছি, কিন্তু তোমার মতো সত্যিকারের সত্যবক্তা আর কাউকে পাইনি। পণ্ডিতজীর প্রথম বিতর্ক যেটি বাড়া হিন্দূরাওয়ে হয়েছিলো সেটি তিনি গোপনে শুনেছিলেন। পণ্ডিতজীর মুখে কোরাণের আয়াতের বিশুদ্ধ পাঠ শুনে তাঁর মন ভরে উঠে। পণ্ডিতজী কোরাণ শেখার জন্য সর্বমোট ১০ রুপি খরচ করেন।


বাইবেলের অধ্যয়ন পণ্ডিতজী নিজেই করেছিলেন। তাঁর ব্যক্তিগত পুস্তকালয়ে হিন্দি ও ইংরেজী ভাষার অনেক কপি বাইবেল ছিল । তিনি এসব খুব ভালোভাবেই পড়েছিলেন ।


শাস্ত্রার্থের প্রারম্ভ


পণ্ডিতজী নিজের প্রথম শাস্ত্রার্থ মাওলানার সাথে করেন। এই শাস্ত্রার্থে জয়লাভ করে তিনি প্রসন্ন হন এবং সাথে তাঁর আত্মবিশ্বাসও অনেক বেড়ে যায়। সেইসাথে জনতাও পঞ্চমুখে পণ্ডিতজীর প্রশংসা করতে থাকে । তারা পণ্ডিতজীকে মহাপরাক্রমশালী ভীম রূপে পেয়ে যায়, যার অকাট্য তর্করূপী গদার প্রহার সমস্থ অবৈদিক মতকে ধূলিসাৎ করে দিতো। 

না জানি কতো সমাবেশ বসেছিলো যেখানে পণ্ডিতজী নিজের প্রতিদ্বন্দ্বীদের দম্ভ চুর্ণ করেছিলেন। এই সমাবেশের মধ্যে একটির কাহিনী উল্লেখ করছি -


একবার মুজফফরপুরে শাস্ত্রার্থের আয়োজন করা হয়েছিলো। মুসলমানরা পণ্ডিতজীর বিপক্ষে ছিলো । তো প্রতিপক্ষের থেকে এমন প্রস্তাব এলো যে শাস্ত্রার্থে হার-জিত নির্ণয়ের জন্য একজন জজ কে রাখা হোক। পণ্ডিতজী তাদের এই প্রস্তাবকে স্বীকার করে নেন এবং জজকে নিয়ে আসার দায়িত্ব তাদেরকেই দিয়ে দেন। পরের দিন তারা নিজেদেরই এক রেভারেন্ড জুডাহসাহেবকে জজ বানিয়ে নিয়ে আসে। আর সেই জজ এসে মুসলমানদের সাথেই বসে যান।


পণ্ডিতজীকে যখন একথা জানানো হলো তখন তিনি জজকে উদ্দেশ্য করে বললেন , "জজসাহেব তো দেখছি এখন থেকেই একদিকের পক্ষ নেওয়া শুরু করেছেন। আপনি যেমন মুসলমান পক্ষের জন্য বিচারক তেমন আমারও বিচারক তাই না? সুতরাং আপনার দু পক্ষের মধ্যস্তলে বসা উচিত।" পণ্ডিতজীর একথার উপরে জজের কিছুই বলার ছিলো না তাই তিনি নিজের ভুল স্বীকার করে মধ্যভাগে এসে বসেন। তারপর জজসাহেব এই মর্মে দুই পক্ষের সাক্ষর নিয়ে নিলেন যে, জজসাহেব কে তারা মান্য করেন এবং তার বিচারও উভয়পক্ষের জন্য মান্য। 

দৃশ্য দেখার মতো ছিলো। জনতার উপচে পড়া ভীড় ছিলো। চারিদিকে শুধু মানুষ আর মানুষই দেখা যায়। সবাই বিতর্ক শুরু হওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলো। যে কখন উত্তর-প্রত্যুত্তর আর যুক্তির ঘাত প্রতিঘাত শুরু হবে । অবশেষে শাস্ত্রার্থের সময় এসে গেল । যেভাবে সিংহ সামনে শিকার কে দেখে খুশি হয়ে যায় সেভাবে পণ্ডিতজীও খুশিমনে তাদের দিকে তাকালেন। তিনি বিরোধীদের চালের অপেক্ষা করছিলেন , যে কখন তারা যুক্তি দিবে এবং তিনি সেই যুক্তিগুলোকে ধ্বংস করে দিবেন । 


শাস্ত্রার্থ শুরু হলো। প্রথমে বিরোধীদের আক্ষেপের সময় দেওয়া হল । তারা যা যা আক্ষেপ করেছিল , পণ্ডিতজী প্রবল তর্কযুক্ত বাক্যের দ্বারা সেসব আক্ষেপের খণ্ডন করলেন। তাঁর বক্তব্য বেদ এবং কুরাণের বহুল প্রমাণ দ্বারা পরিপুষ্ট এবং সবল ছিলো । তিনি নিজের প্রতিপক্ষের বক্তব্য শুনে তাদের সামর্থ্য সম্পর্কে ধারণা করে নেন এবং প্রতিপক্ষের উদ্দেশ্যে তাঁর প্রশ্ন করার সময় তিনি এমন সব প্রশ্ন করতে লাগলেন যে তাতে প্রতিপক্ষের বিতার্কিক মাওলানা সাহেবদের কলিজার পানি শুকিয়ে যাওয়ার উপক্রম হলো । তারা না তো পণ্ডিতজীর বক্তব্যের উত্তর দিতে পারলেন আর না তো তাঁর খণ্ডন কিংবা কোনো গ্রন্থের প্রমাণ। 


এখন জজ জুডাহ সাহেবের সময় এলো। তবে জুডাহ সাহেব রায় দেওয়ার আগেই জনতা বুঝে গিয়েছিল যে ,কে বিজয়ী হয়েছে? জনতার মধ্যে কোলাহল পড়ে গেল। সবাই রোমাঞ্চিত ছিলো এবং  উৎসুক হয়ে জজ সাহেবের রায় শোনার জন্য অপেক্ষা করছিলো।

জুডাহ সাহেব যখন রায় দেওয়ার জন্য যখন উঠে দাড়ালেন তখন চারিদিকের সব কোলাহল থেমে পিনপতন নীরবতার পরিবেশ সৃষ্টি হলো। 

তিনি বলতে শুরু করলেন, 


" আমি পুরো বিতর্কই শুনেছি, আর্য পণ্ডিত যে ভাবে নিজের বক্তব্য দিয়েছেন । তা অসাধারণ ছিলো। অনেক আয়াতের দ্বারা ভরপুর তথা প্রমাণবহুল ছিলো।  প্রতিপক্ষের উত্তরও তিনি খুব সুন্দরভাবে দিয়েছেন। (জনতার প্রবল হাততালি) এদিকে আমাদের মুসলমান ভাইয়েরা তাদের বক্তব্যে একটি আয়াতও পড়তে পারেননি। এজন্য আমার নির্ণয় হলো আর্য পণ্ডিত জিতেছেন এবং মুসলমানরা হেরেছেন। " 


পণ্ডিত রামচন্দ্র দেহলবী কি- জয়! মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী কি- জয়! বৈদিক ধর্ম কি- জয়! এমন গগনভেদী জয়গান চারিদিক মুখরিত করে তুললো। জয়োল্লাসে মত্ত জনতা পণ্ডিতজীকে নিজেদের মাথার উপরে তুলে নেয়। পণ্ডিতজীও মনে মনে অনেক প্রসন্ন ছিলেন। এক ধনী ব্যক্তি জয়ের খুশিতে পণ্ডিতজীকে একটি সোনার পদক পুরস্কারস্বরূপ উপহার দেয়।


পুরস্কারের কথায় আমার আরেকটি ঘটনা মনে হলো , একবার পণ্ডিতজী ফিরোজপুর আর্যসমাজের বার্ষিক উৎসবে অংশগ্রহণ করতে যান। তাঁর আসার কারণে সেখানে প্রচুর লোকসমাগম হয় । শাস্ত্রার্থ শোনার জন্য আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া এক পাঠান নবযুবতীও এসেছিলো। । পণ্ডিতজী কুরাণের আয়াতসমূহ এমন বিশুদ্ধভাবে উচ্চারণ করতেন যে তা শুনে বড়ো বড়ো হাফেজ মাওলানারাও বিস্ময়াভিভূত হয়ে যেতেন। এই পাঠানকন্যাও পণ্ডিতজীর বাণীতে অত্যন্ত প্রভাবিত হয়েছিলো। পণ্ডিতজীর আয়াত পড়া তার খুবই পছন্দ হয় । এবং সে পণ্ডিতজীকে "মৌলবী পণ্ডিত" বলে সম্বোধন করে, সেখানকার মন্ত্রীর কাছে  তাঁর নামে পুরস্কারস্বরূপ ১০ রুপির একটি নোট দিয়ে দেয়। পণ্ডিতজী মজা করে এই ঘটনা শুনিয়ে বলতেন, আমার আরবি পড়ার খরচ মুসলমান সাহেবরাই দিয়েছিলো। আমি নিজের পকেট থেকে কিছু খরচ করি নি। আপনাদের মনে আছে হয়তো পণ্ডিতজী কুরাণ শরীফ পড়ার জন্য সর্বমোট ১০ রুপিই খরচ করেছিলেন।


ইসলাম এবং খ্রিস্টান মতের পুস্তকের গহন জ্ঞান প্রাপ্ত হওয়ার পরেই পণ্ডিতজী পাদ্রী এবং মৌলবীদের সাথে শাস্ত্রার্থে প্রবৃত্ত হয়েছিলেন । তিনি সব শাস্ত্রার্থে বিজয়ী হতেন । পণ্ডিতজীর করা শাস্ত্রার্থের সংখ্যা অনেক বেশি ছিলো। এবং এর সাথে পণ্ডিতজীর শাস্ত্রার্থসমূহ রুচিসম্মত, শিক্ষাপ্রদ এবং জনসাধারণের জন্য জ্ঞানবর্ধকও ছিলো। শাস্ত্রার্থে একের পর এক জয়লাভ করায় পুরো ভারতবর্ষের ধার্মিক জগতে পণ্ডিতজীর নামের ডংকা বাজতে থাকে। বেদ প্রচারের জন্য মনসা-বাচা-কর্মণা সমর্পিত পণ্ডিতজীকে পুরো দেশ থেকে  শাস্ত্রার্থ এবং প্রবচনের জন্য ডাকা হয় । হায়দ্রাবাদে হিন্দুদের সংখ্যা প্রচুর ছিলো । আর্যসমাজের প্রভাবও সেখানে ভালো ছিলো। সেখানে আর্যসমাজের বৈদিক ধর্মের প্রচার এবং ব্যাখ্যানের কারণে হিন্দুদের মধ্যে অপূর্ব গণজাগরণ শুরু হয়। কিন্তু হায়দ্রাবাদের মুসলিম স্বৈরশাসক নিজাম ,পণ্ডিতজীর প্রমাণ এবং সত্য মান্যতা যুক্ত প্রবচনের ভয়ে ভীত হয়ে হায়দ্রাবাদে তাঁর ব্যাখ্যানে দেওয়াতে সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা জারি করে।  


যখন পণ্ডিতজী মৌলভীর ভুল ধরে কানে ধরান-


এই ঘটনা আমার পুরোপুরি মনে নেই । তবে ঘটনা কিছুটা এমন যে , একবার আয়াত পড়ার সময় কুরআনের একটি শব্দ নিয়ে পণ্ডিতজীর সাথে এক মৌলভীর বিবাদ শুরু হয়ে যায় । পণ্ডিতজী নিজের কাছে থাকা কোরআন শরিফ খুলে দেখিয়ে দেন যে তাঁর কথাই সঠিক এবং মৌলভী ভুল। মৌলভী বাধ্য হয়ে নিজের ভুল স্বীকার করেন এবং ভরা সভায় কান ধরেন। জনতা সভার মধ্যে হৈচৈ বাধিয়ে দেয় এবং বলাবলি করতে থাকে যে পণ্ডিতজী মৌলভী সাহেবকে কান ধরিয়ে দিয়েছেন।



ঝড়ো মানব 


পণ্ডিতজী তার কাজে শয়তানকেও মারতেন। পণ্ডিতজী সময়ের প্রয়োজনে দ্রুততার সাথে কাজ করতেন । তিনি তার সাধারণ কাজও দ্রুত শেষ করতেন, সেভাবে প্রচার কাজও একই গতিতে করতেন। এককথায় তাঁর সব কাজে অসাধারণ গতি ছিলো । কি রাত? কি দিন? রোদ-ছায়াই বা কি? ক্ষুধার্ত বা তৃষ্ণার্ত ! এই সব ছোটখাটো বিষয়কে তিনি কখনই পরোয়া করতেন না। 


শুধুমাত্র হায়দ্রাবাদেই তিনি ৭ বারে ১২৫টি বক্তৃতা দিয়েছিলেন। এ থেকে আপনারা তাঁর প্রচারকার্যের গতি সম্পর্কে অনুমান করতে পারেন।


সত্যাগ্রহের নেতৃত্ত্ব


পণ্ডিতজী যেমন আর্য সমাজের অন্তর্ভুক্ত হয়েও, সতন্ত্র হয়ে ধর্ম প্রচার করেছেন। তেমনই আর্য সমাজের দ্বারা করা প্রতিটি আন্দোলনে তিনি সৈনিকের মতো হয়ে কাজ করেছেন। তিনি চাইলে আর্যসমাজের বিভিন্ন আন্দোলনের নেতাও হতে পারতেন। আর্যসমাজ যখন কাইরন শাহীর বিরুদ্ধে হিন্দি আন্দোলন শুরু করে তখন তিনি সেই আন্দোলনে নেমে পড়েন। এবং একটি বড় দল নিয়ে সত্যাগ্রহের জন্য পাঞ্জাবে যান।


পণ্ডিতজীর খাদ্যাভ্যাস এবং জীবনধারা


পণ্ডিতজীর জীবনাচরণ তথা চালচলন অত্যন্ত সাদামাটা ছিল । খাওয়া-দাওয়ার ক্ষেত্রেও তিনি খুবই সাধারণ খাবার খেতেন। ঘরে তিনি সকালে শুধু রুটি এবং ডাল এবং সন্ধ্যায় শুধু শাক এবং রুটিই আহার করতেন । তিনি সম্পূর্ণ শাকাহারী এবং সম্পূর্ণ সাত্ত্বিকাহারী ছিলেন। তাঁর ঘরে কখনো পেয়াজও খাওয়া হতো না । চা,পান,বিড়ি ,সিগারেট এসব তো অনেক দূরের কথা। তাছাড়া তিনি নিজের পুরো জীবনে কখনো সিনেমা দেখেননি । পণ্ডিতজীর পরিধেয় কাপড় ছিলো অত্যন্ত সাদামাটা। তিনি সবসময় নিজের হাতে ধোয়া পরিস্কার জামাকাপড় পরতেন । শুধুমাত্র শেরওয়ানি ইস্ত্রি করে পরতেন । পণ্ডিতজী অত্যন্ত সাদামাটা এবং শান্ত স্বভাবের মানুষ ছিলেন। কিন্তু মিথ্যা এবং কুটিল কথাবার্তা তিনি সহ্য করতেন না । রেগে গেলে দোষী ব্যক্তিকে শাস্তি না দিয়ে ছেড়ে দিতেন না । মনের দিক দিয়ে অবশ্য অনেক কোমল ছিলেন। দোষী ব্যক্তি যদি তার সামনে এসে নিজের দোষ স্বীকার করে নিত তাহলে তার সকল রাগ উধাও হয়ে যেত এবং দয়ার্দ্র হৃদয়ে দোষীকে ক্ষমা করে দিতেন। পণ্ডিতজী খুবই দূরদর্শী এবং গম্ভীর বিচারক ছিলেন । যেকোনো সমস্যাকে ভালোভাবে বিচার বিবেচনা করার পরেই তিনি কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন । এবং কোন সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর যাই হোক না কেন সে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতেন না । শিশুদের তিনি অত্যন্ত ভালবাসতেন । সন্তানাদির কষ্টে তিনি অনেক দুঃখিত হতেন । তাদের দুঃখ দূর করার জন্য নিজের সামর্থ্য অনুসারে যা যা করা সম্ভব সবই তিনি করতেন । সেবা করা, যা করা অনেক কঠিন এবং অনেক কষ্টকর। সেই সেবাকার্যে তিনি সিদ্ধহস্ত ছিলেন । সেবা করতে গিয়ে যেকোনো দুর্গন্ধযুক্ত কাজে তিনি কখনো ঘৃণাবোধ করে সরে আসতেন না । যেখানেই  সেবা করার সুযোগ পেতেন সেখানেই তিনি সেবা করতেন । পণ্ডিতজী বলতেন, "Every opportunity to help is a duty." অর্থাৎ আমাদের কর্তব্য হলো যখনই সেবা কার্যের সুযোগ সুযোগ আসবে তখন সেটা থেকে পিছিয়ে না যাওয়া।


ধার্মিক ক্ষেত্রে অপূর্ব সফলতা প্রাপ্ত 


পণ্ডিতজীর সময়ে আর্যসমাজে পণ্ডিতজীর সমকক্ষ অনেক বড়ো বড়ো পণ্ডিত ও বেদশাস্ত্রের বিদ্বান ছিলেন। কিন্তু তাঁরা পণ্ডিতজীর মতো লোকপ্রিয়তা অর্জন করতে পারেননি। কারণ পণ্ডিতজীর মধ্যে বহু অসাধারণ গুণের সমাহার ছিলো যা অন্যদের মধ্যে ছিলো না। পণ্ডিতজী নিম্নলিখিত বিশেষতার কারণে অন্যদের চেয়ে অধিক এবং অত্যন্ত লোকপ্রিয় হয়েছিলেন-


১/ সব ধর্মমত ও সিদ্ধান্তের শাস্ত্রসমূহের গভীর অধ্যয়ন। 


২/ নিজের বোঝা কথাকে জনসাধারণের বুদ্ধি স্তর অনুযায়ী তাদের ভাষায় ভালোভাবে বোঝানোর ক্ষমতা।


৩/ বিধর্মীদের সিদ্ধান্তের খুঁত বা দোষসমূহ যুক্তি দিয়ে তাদেরকে বোঝাতেন। না তো তাদের সাথে ঝগড়া বিবাদ করতেন । আর না তাদের অপমান, তিরস্কার বা লজ্জিত করতেন।


৪/ অন্য ধর্মাবলম্বীদের আলীম বা নেতাদের নিয়ে কখনো অপশব্দ উচ্চারণ করেননি বরং তাদের নাম পূর্ণ সম্মানের সাথে নিতেন।


৫/ তাঁর জ্ঞান অসীমিত বা পূর্ণ ছিলো। তিনি কখনোই সন্দেহাত্মক কথা বলতেন না। সব কথা পূর্ণ আত্মবিশ্বাসের সাথে বলতেন।


৬/ বৈদিক জীবন  সিদ্ধান্তকে তিনি স্বয়ং নিজের মধ্যে ধারণ করে তদানুসারে নিজের জীবন পরিচালনা করতেন। এবং যেহেতু তিনি পূর্ণ বৈদিক হয়েই মানুষকে ধর্মোপদেশ দিতেন সুতরাং তাঁর আচরণের উপর আঙ্গুল উঠানোর কোনো অবকাশ ছিলো না। এজন্য জনসাধারণ তাঁর কথা শীঘ্রই মেনে নিতো। আমি স্বয়ং তাঁর উপদেশের নয় বরং যতটুকু হতে পেরেছি তাঁর জীবনাচরণ দ্বারাই প্রভাবিত হয়েছি ।


পণ্ডিতজীর রূগ্নাবস্থা 


এখন থেকে প্রায় পাঁচ বছর আগে থেকে পণ্ডিতজী  বাইরে আসা যাওয়া করা বন্ধ করে দেন। (বিমলচন্দ্রার্যের তথ্যানুসারে) একবার দিল্লির সদরে যাওয়ার সময় তাঁর রিক্সার পেছনে এক ট্যাক্সিওয়ালা জোরে ধাক্কা দেয়। পণ্ডিতজী রিক্সা থেকে ছিটকে পড়েন। এবং খুব আহত হন।  তাঁর মেরুদণ্ডেও বাজেভাবে আঘাত লাগে। তখন থেকে পণ্ডিতজীর বাম হাতে রাশা (কম্পন) হয়ে যায়। পণ্ডিতজী প্রথমে এর উপর ততোটা মনোযোগ দেননি কিন্তু এটা বাড়তেই থাকে। ধীরে ধীরে স্নায়ু-দুর্বলতাও বাড়তে থাকে। পরে চিকিৎসা করিয়েও লাভ হয়নি । তিনি এতোটাই দূর্বল হয়ে গিয়েছিলেন যে চলাফেরা করাও তাঁর পক্ষে কষ্টসাধ্য হয়ে যায়। ঘরের বিভিন্ন স্থানে দড়ি বেধে সেসব ধরে ধরে তিনি চলাফেরা করতেন। এই দুর্বল অবস্থা দ্রুত বাড়তে থাকে, একারণে যে, পণ্ডিতজী নিজেকে একা মনে করতেন । আমার পরিবারে অধিক ব্যক্তি ছিলো না । এবং সবাই কর্মব্যস্ত হওয়ায় পণ্ডিতজীর কাছে সবসময় থাকা সম্ভব ছিলো না। সময় পেলে পণ্ডিতজীর বড়ো কন্যা (শ্রীমতি কস্তুরি দেবী জী ) সপ্তাহে দু একবার পণ্ডিতজীকে দেখতে আসতেন। 


একা বসে বসে তিনি মানসিকভাবে ক্লান্ত এবং বিরক্ত হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি আমাকে ভারাক্রান্ত মনে অশ্রুসিক্ত হয়ে বলতেন , বেটা, আমার মন বসছেনা আমার দিন যেন কাটছেনা । আমি যথাসম্ভব তাঁর ইচ্ছানুসারে চেয়ারে বসিয়ে ঘুরতে নিয়ে যেতাম । ওনার মন খুশি রাখার চেষ্টা করতাম । কিন্তু ওনার একাকীত্বের কারণে মন ভারী হয়ে থাকতো।  ধীরে ধীরে পণ্ডিতজীর শারিরীক অবস্থা এতোটাই খারাপ হয়ে যায় যে তিনি চলাফেরাতে সম্পূর্ণ অক্ষম হয়ে যান । আমার মা তাঁকে উঠানো বসানো এবং চলাফেরায় সাহায্য করতেন । পণ্ডিতজী এক স্থানে ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকতেন কিন্তু চলতে পারতেন না । মায়ের সাহায্য নিয়ে চলতেন । তখন মা সবসময় তার সাথে থাকতেন ।


দীওয়ান নার্সিং হোম, দিল্লি


অক্টোবর ১৯৬৭ তে পণ্ডিতজীর জ্বর হয়। তাতে তিনি অত্যন্ত দুর্বল হয়ে গিয়েছিলেন । আমি দিল্লির আদরণীয় লালা রামগোপাল জীকে পণ্ডিতজীর অবস্থা বলি। পণ্ডিতজীর অবস্থা শুনে তিনি অত্যন্ত চিন্তিত হন । আর সেদিনই তিনি ওম্ প্রকাশজী ত্যাগী বা শ্রী বৈদ্য প্রহ্লাদ জীকে নিজের সঙ্গে নিয়ে পণ্ডিতজীকে দেখতে আসেন। পণ্ডিতজীর তখন হুশ ছিলো।  তিনি তাদের দেখতে পেয়ে অত্যন্ত প্রসন্ন হয়েছিলেন। লালা জী পণ্ডিতজীর অবস্থা দেখে দিল্লিতে যান এবং এই মহানুভবগণ দিওয়ান নার্সিং হোম এ পণ্ডিতজীর চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন ।  সেখানে ডাঃ এম. এল. শর্মা সাহেবের তত্ত্বাবধানে চিকিৎসা চলতে থাকে। এখানে এসে শীঘ্রই পণ্ডিতজীর জ্বর উপশম হয় এবং ধীরে ধীরে তিনি সুস্থ হতে থাকেন । তখন তিনি আমাদের সাহায্য নিয়ে চলাফেরা করতেন । পুরো দুই মাস পণ্ডিতজী সেখানে থেকেছিলেন। কিন্তু সেই স্থানের প্রতি ধীরে ধীরে তাঁর বিরক্তি এসে যায় । ঘরে ফেরার জন্য তাঁর মন ছটফট করতে থাকে। অবশেষে তাঁর ইচ্ছানুসারে তাঁকে নার্সিং হোম থেকে দীওয়ান হলে নেওয়া হয়। দীওয়ান হলের নিচে এক কক্ষে পণ্ডিতজীর থাকার ব্যবস্থা করা হয়। সেখানে তিনি প্রসন্ন তো ছিলেন কিন্তু সুস্থ ছিলেন না । হঠাৎ একদিন পণ্ডিতজীর ১০৬ ডিগ্রিতে জ্বর হয়। তিনি সেখানে সম্পূর্ণ অচেতন হয়ে যান।


ইর্বিন হাসপাতাল 


সব ডাক্তারগণ পণ্ডিতজীকে সেখানে দেখতে আসেন, তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করার কথা বলেন।  সাথে সাথে এম্বুলেন্সে করে পণ্ডিতজীকে ইর্বিন হাসপাতালে নেওয়া হয়। যেভাবে অবহেলার সাথে এই কাজ করা হয়, তাঁকে ইমারজেন্সি ওয়ার্ডে নিয়ে ভর্তি করিয়ে দেয়। পুরো রাত তারা কিছুই করেনি । কোমর সংলগ্ন মেরুদণ্ডীয় হাড়ের কাছে একজন এসে ইঞ্জেকশন দিয়ে যায়। আমি সারারাত অস্থির অবস্থায় সেখানেই ঘুরাঘুরি করেছি। লালা রামগোপালজী আর শ্রী বৈদ্য প্রহ্লাদজী পণ্ডিতজীর উপচার-প্রযত্নে মনে প্রাণে যুক্ত ছিলেন। পরদিন সকাল প্রায় পৌনে পাচটায় পণ্ডিতজীর জ্ঞান ফিরে আসে। তখনই আমি তাকে ডাকি ' নানা জী সাহেব' । এভাবে সারারাত আমি তাঁকে ডেকেছিলাম কিন্তু তিনি কোনো সাড়া দেননি । কিন্তু এখন দিলেন। চোখ খুলে সেই স্নেহময় কণ্ঠে বললেন , হ্যাঁ ব্যাটা! আমি মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছি! " আমার কণ্ঠ বিগলিত হয়ে এলো। নানাজী (পণ্ডিতজীর) চোখ থেকে অশ্রু ঝরতে লাগলোন তিনি বললেন যে ,   দুধ আমাকে অসুস্থ করেছে।  সেদিনের পর তাঁকে মেডিকেল ওয়ার্ড থেকে স্থানান্তরিত করা হয়। ইর্বিন হাসপাতালের যাওয়া আসা সম্পূর্ণ অনর্থকই ছিলো । না ঔষধ না চিকিৎসা। ডাক্তারও ক্লান্ত রোগীরাও বিরক্ত । আমি এরকম অবস্থা দেখে সাথে সাথে পণ্ডিতজীকে দীওয়ান হলে ফিরিয়ে নিয়ে যাই। দীওয়ান হলের কার্যকর্তারা এবার পণ্ডিতজীর থাকার ব্যাবস্থা আরো ভালো জায়গায়, উপর তলায় করে দেন । পণ্ডিতজীর সেবার জন্য আমি আর আমার মৌসা জী থাকতাম। আমি দিনে স্কুলে পড়াতে যেতাম তাই দিনে তিনি আর রাতে আমি থাকতাম। আমার বোনও এখানে রোজ আসতো।


মৃত্যুর ছায়া


দেওয়ান হল থেকে আসার পর পণ্ডিতজী নিজে কিছুই খাননি । তার মুখ হাসপাতালেই অচেতন হয়ে গিয়েছিল । এরপর থেকে তিনি ডাক্তার শর্মাজীর চিকিৎসাধীন ছিলেন। তার মোটেও ক্ষুধা লাগতো না । তবে আমরা তাকে কিছু না কিছু খাইয়ে দিতাম।  কিছুদিন সুস্থ থাকার পর তিনি পুনরায় অর্ধচেতন অবস্থায় হয়ে যান । মৃত্যুর চার দিন আগে পণ্ডিতজী আজব ভাবে ভয় পেয়ে ওঠেন এমনটা কেন হয়েছিল সেটা বুঝিনি । সেদিন থেকে আমি আর পণ্ডিতজীর বলা কথা বুঝতে পারিনি । আমার মিত্র ভাই গোপাল (রামগোপাল) এবং কানাইয়া লাল আমার সাহায্যের এসেছিলেন । তারাও এই ভয় পাওয়া দেখেছিলেন কিন্তু কিছু বুঝতে পারেননি । আমি আমার মাকে নিয়ে এসেছিলাম । পণ্ডিতজীর উপর তখন থেকেই মৃত্যুর ছায়া পড়তে থাকে তিনি অনেক কথা বলার চেষ্টা করেছিলেন বলেছিলেনও কিন্তু আমি কিছু বুঝতে পারিনি । এরপর পণ্ডিতজীর জ্বর হয় । কোমরের অংশের মেরুদণ্ডীয় এবং নিতম্বের হাড়ে পূর্ব থেকে আঘাতপ্রাপ্ত হওয়ার কারণে এবার তাঁর খাটে শুয়ে থাকা কিংবা বসে থাকাও দুষ্কর হয়ে পড়ে । আমার পুরো পরিবার সেখানে উপস্থিত ছিলো। ডাক্তার পণ্ডিতজীকে পরীক্ষা করে বলেন যে তাঁর নিউমোনিয়া হয়ে গেছে । যা পণ্ডিতজীর জন্য ঘাতক সিদ্ধ হয়।  ২ ফেব্রুয়ারী পণ্ডিতজীর অসুখ আরো বেড়ে যায় । তাঁর পেটও খারাপ হয়ে যায় যার কারণে পেটে প্রচণ্ড ব্যথা শুরু হয় ।  পণ্ডিতজী ব্যাথায় কাতরাতে থাকেন। আমরা পণ্ডিতজীর এমন কাতরানো দেখতেই থাকি কিন্তু আমাদের পক্ষে কিছু করা সম্ভব ছিলো না।


মৃত্যুর মুখে


মৃত্যু ধীরে ধীরে পণ্ডিতজীকে গ্রাস করতে থাকে। সর্বথা অপরাজেয় বীর আজ যেন মৃত্যুর সম্মুখে নত হলেন।  এই রাত থেকেই পণ্ডিতজীর শরীর থেকে প্রাণবায়ু বের হয়ে যেতে থাকে। তাঁর শরীরের প্রতিটি অঙ্গে কম্পন শুরু হয়। আমাদের পৃষ্ঠপোষক আজ আমাদের ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। সবাই যেন শোক সাগরে ডুবে ছিল।  সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। এই ভীষণ দুঃখময় সন্ধ্যার অন্ধকার ধীরে ধীরে বাড়তে লাগলো । আর পণ্ডিতজীর জীবিত থাকার আশাও সেই অন্ধকারে লীন হতে থাকলো। বসন্তপঞ্চমীর এই রাত আমাদের জন্য মহা দুঃখের রাত ছিলো।



দেহত্যাগ


পণ্ডিতজীর শ্বাসপ্রশ্বাসের গতি অস্বাভাবিক হতে লাগলো। ডাক্তার ডেকে আনা হলো । ডাক্তার পরীক্ষা করে সবই দেখলেন কিন্তু কিছুই দেখলেন না । কেবল তাঁর মরণই দেখতে পেলেন। "ব্যাস! সবকিছু বন্ধ করে দাও, পণ্ডিতজীকে যেতে দাও, থামিয়ো না। তাঁর আত্মাকে আর কষ্ট দিও না।"  এই বাক্য বলে ডাক্তার মহাশয়ও আমাদের সাথে শিশুদের মতো  কান্না করতে লাগলেন।  তিনি বললেন , সাড়ে নয়টায়ই পণ্ডিতজী অন্তিম শ্বাস ত্যাগ করেছেন। চিৎকার! চারিদিকে ভয়ংকর চিৎকার!


⭕ পণ্ডিতজীর দেহত্যাগের তারিখ ২ ফেব্রুয়ারী ১৯৬৮ ইংরেজি। এবং মৃত্যুর সময় তাঁর বয়স ছিলো ৮৭ বছর।



শব যাত্রা


৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৮ তে পণ্ডিতজীর দেহত্যাগের সংবাদ সমগ্র দিল্লিতে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে । ৪ ফেব্রুয়ারি সকালে এই সংবাদ রেডিওতে প্রচার করা হয়। আজও সমাজে মন্দিরে শোকাকুল অবস্থায় সকাল সাড়ে আটটার দিকে পণ্ডিতজীর শবদেহ জনসাধারণের দর্শনের জন্য রাখা হয়। 


সাড়ে এগারো টা বাজার কিছুক্ষণ পূর্বে পণ্ডিতজীর শব যাত্রা শুরু হয় । দিল্লির বড় বড় সামাজিক কার্যকর্তা , সংসদ সদস্য , কংগ্রেস ও জনসংঘের নেতৃবৃন্দ  এই শব-যাত্রায় সম্মিলিত হয়েছিলেন । আর্যসমাজীগণ শোকাকুল অবস্থায় নিজেদের সাপ্তাহিক সৎসঙ্গের কার্যক্রম বন্ধ করে পণ্ডিতজীর অন্তিম যাত্রায় সম্মিলিত হন। 


পণ্ডিতজীর শবদেহ জাফরান কাপড়ের দ্বারা আবৃত ছিল । শুধু মুখ খোলা তথা অনাবৃত ছিল । জাফরান কাপড়ের উপর 'ओ३म्' খচিত পতাকা রাখা হয়েছিলো। ('ও৩ম্' কার তিনি জীবনভর উচ্চারণ করতেন । কখনো কখনো বেহুশ অবস্থায়ও উচ্চারণ করতেন।)

ফুলের মালায় পুরো শবদেহ ঢেকে ছিলো। 


শব যাত্রা 'চাদনী চৌক', 'এস্পলেনেড রোড', 'দরীবা', 'ফব্বারা', 'কৌড়ীয়া পুলের নিকটস্থ কাশ্মীরী গেট', বড়ো ডাকখানার সামনে দিয়ে নিগমবোধ ঘাটে পৌছেছিলো।

শব যাত্রার সাথে এখানে হাজারো দিল্লীবাসী সম্মিলিত হয়েছিলেন । নিগমবোধ ঘাটে একটুও জায়গা ছিলো না। কারণ হাজার হাজার লোক পণ্ডিতজীকে শেষবারের মতো দেখার জন্য নানান জায়গা থেকে সেখানে এসে পৌঁছেছিলো । এতে নিগমবোধ ঘাটে ভীড় সামলানো কষ্টকর হয়ে যায় । 


পণ্ডিতজী মৃত্যুর কয়েক বছর আগে নিজের কন্যা শ্রীমতি লীলাবতী দেবীকে নিজের অন্তিম সংস্কারের জন্য ৫০০ রুপি দিয়ে গিয়েছিলেন  । এই রাশি লালা রামগোপালজীর আদেশে শ্রী বৈদ্য প্রহ্লাদ দত্ত জী কে দেওয়া হয়। 


ঠিক দেড়টায়  পণ্ডিতজীর শব বেদীতে রাখা হয়। যখন পণ্ডিতজীর শবদেহ দাহ করা হচ্ছিলো, হাজার হাজার মানুষের চোখ তখন অশ্রুসিক্ত হয়ে গিয়েছিলো । 

দিল্লির মূর্ধন্য পণ্ডিতবর্গের দ্বারা পূর্ণ বৈদিক পদ্ধতিতে তাঁর দাহ ক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়।




গ্রন্থরাজিঃ



পণ্ডিত রামচন্দ্র দেহলবী আর্য জগতের সাহিত্যিক ভাণ্ডারেও নিজের জ্ঞানপূর্ণ লেখনীর দ্বারা মহত্ত্বপূর্ণ যোগদান করেছিলেন । তাঁর সুপ্রসিদ্ধ লেখনীসমূহ হলো-


 1- दो सनातन सत्तायें, 

(দুই সনাতন সত্ত্বা)


2- सत्यार्थप्रकाश के चतुर्दश समुल्लास में उद्धृत र्कुआन की आयतों का देवनागरी में उल्था और अनुवाद (सन् 1945), 

( সত্যার্থ প্রকাশের চতুর্দশ সমুল্লাসে উদ্ধৃত কোরানের আয়াতসমূহের দেবনাগরীতে প্রতিবর্ণীকরণ ও অনুবাদ । ১৯৪৫ সন)


3- ईश्वर सिद्धि, (ঈশ্বর সিদ্ধি)


4- ईश्वरोपासना, (ঈশ্বরোপাসনা)


 5- धर्म और अधर्म, (ধর্ম এবং অধর্ম)


6- ईश्वर में अविश्वास क्यों?, (ঈশ্বরে অবিশ্বাস কেন?)


7- विद्यार्थी और सदाचार, (বিদ্যার্থী এবং সদাচার)


8- ईश्वर की पूजा का वैदिक स्वरूप, (ঈশ্বরের পূজার বৈদিক স্বরূপ)


9- इंजील के परस्पर विरोधी वचन, (ইঞ্জিলের পরস্পর বিরোধী বাক্য)


10- पौराणिकों से शास्त्रार्थ का विषय निश्चित करते समय ध्यान में रखने योग्य बातें, (পৌরাণিকদের সাথে শাস্ত্রার্থের বিষয় নিশ্চিত করার সময় খেয়াল রাখার যোগ্য কথা)


11- र्कुआन में अन्य मतावलम्बियों के लिये कुछ अति कठोर, उत्तेजक वाक्यों का संग्रह (1944), (কুরাণে অন্য মতাবলম্বীদের জন্য অতি কঠোর উত্তেজক বাক্যের সংগ্রহ)


12- आर्यसमाज की मान्यतायें, (আর্যসমাজের মান্যতাসমূহ)


13- आर्यसमाज के मन्तव्य, (আর্যসমাজের মন্তব্য)


14- कुरान का अनुवाद (सूर ए बकर और सूर ए फातिहा),

(কুরাণের অনুবাদ- সূর এ বকর এবং সূর এ ফাতিহা) 


15- रामचन्द्र देहलवी लेखावली (1968), (রামচন্দ্র দেহলবীর রচনাসমগ্র)


16- ईश्वर ने दुनिया क्यों बनाई?, (ঈশ্বর কেন এই জগৎ সৃষ্টি করেছেন?)


17- पूजा क्या, क्यों और कैसे?  ( পূজা কি কেন এবং কিভাবে?)


18- वेद का इस्लाम पर प्रभाव। (ইসলামের উপর বেদের প্রভাব)



-- বিদুষামনুচরঃ







Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.