পণ্ডিত দীনবন্ধু বেদশাস্ত্রী

 


 

পণ্ডিত দীনবন্ধু বেদশাস্ত্রী ১৯০৯ সালের ৭ই মার্চ বর্তমান বাংলাদেশের (তৎকালীন পূর্ব বাংলার) পাবনা জেলার সাগরকান্দী নামক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন৷ তাঁর পিতার নাম পণ্ডিত বিপিনবিহারী আচার্য এবং মায়ের নাম বিনোদনী দেবী৷ তাঁর বয়স যখন মাত্র দশ বছর, তখন তাঁর পিতা মারা যান৷ ফলে তাঁকে লালনপালনের সমস্ত দায়িত্ব এসে পড়ে তাঁর মা বিনোদনী দেবীর উপর ৷ 
 
বিনোদনী দেবী ছিলেন একজন তেজস্বিনী ও নির্ভীক নারী৷ তাঁর এই গুণসমূহ বালক দীনবন্ধুর মধ্যেও সঞ্চারিত হয়েছিলো৷ নির্ভীক বালক দীনবন্ধু মাত্র ১১ বছর বয়সে ১৯২১ সালে ইংরেজ সরকার বিরোধী কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত থাকার জন্য পাবনায় গ্রেফতার হন এবং তাঁকে বহরমপুর স্পেশাল জেলে প্রেরণ করা হয়। 
 
জেলে বন্দী থাকাকালীন তাঁর সাথে বিদ্যাভূষণ শ্রী দিগিন্দ্রনারায়ণ ভট্টচার্যের পরিচয় হয়৷ দিগিন্দ্রনারায়ণের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তিনি 'ব্রাহ্মণ-শূদ্র-সংঘর্ষ' নামক তাঁর প্রথম গ্রন্থ রচনা শুরু করেন৷
এই জেলে থাকাকালেই তাঁর সাথে একজন বাজপেয়ী ব্যক্তির পরিচয় হয়৷ এই ব্যক্তিই সাথে বিভিন্ন আলাপচারিতায় তিনি স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী ও "সত্যার্থপ্রকাশ" সম্পর্কে জানতে পারেন৷ একই সাথে তিনি আর্যসমাজের ধার্মিক, সামাজিক এবং বিপ্লবী কর্মকাণ্ড সম্পর্কে অবগত হন৷ 
 
জেলমুক্ত হওয়ার পর তিনি কলকাতায় চলে আসেন৷ এসময় তিনি নিয়মিত কলকাতা আর্যসমাজ মন্দিরে যাতায়াত শুরু করে করেন এবং প্রচণ্ডরূপে আর্যসমাজ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে যান৷ এইসময়ই তাঁর লেখা 'ব্রাহ্মণ-শূদ্র-সংঘর্ষ' (অপ্রাপ্ত) গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়৷ এই বইয়ের ওজস্বী প্রৌঢ় ভাষা, উৎকৃষ্ট লেখনশৈলী এবং মর্মজ্ঞ ভাব দেখে তৎকালীন কলকাতা আর্যসমাজের প্রসিদ্ধ বিদ্বান, প্রচারক এবং লেখক পণ্ডিত শঙ্করনাথজী এই বইয়ের লেখকের অনুসন্ধান শুরু করেন৷ যখন তিনি দীনবন্ধুজীর খোঁজ পান, তখন যুবক দীনবন্ধুকে দেখে শঙ্করনাথজী আশ্চর্য হয়ে যান৷ তিনি দীনবন্ধুজীকে ভবানীপুরে নিজের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে বহু আর্ষগ্রন্থ প্রদান করেন৷ সেখানে কিছুদিন অবস্থানের পর দীনবন্ধুজীর পাণ্ডিত্য দেখে মুগ্ধ হয়ে শঙ্করনাথজী তাঁকে তৎকালীন আর্য প্রতিনিধি সভার মন্ত্রী হরগোবিন্দ গুপ্তের কাছে নিয়ে যান৷ হরগোবিন্দজী তাঁকে কলকাতা আর্যসমাজের প্রচারক হিসেবে নিযুক্ত করেন৷ এসময় তিনি তাঁর মাকে পাবনা থেকে কলকাতা নিয়ে যান এবং তাঁরা কলকাতায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন৷
 
পণ্ডিত দীনবন্ধু বেদশাস্ত্রী শুধু গ্রন্থকার হিসেবেই বিখ্যাত ছিলেন না, তিনি তৎকালীন তার্কিক হিসেবেও বিখ্যাত ছিলেন৷ একবার চব্বিশ পরগনা জেলার ভাটপাড়া নামক স্থানে 'শূদ্রের যজ্ঞোপবীত ও বেদাধিকার' বিষয়ে শাস্ত্রার্থ আয়োজিত হয়৷ সেখানে পণ্ডিত দীনবন্ধু বেদশাস্ত্রী, দিগিন্দ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য, পণ্ডিত নরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী প্রমুখ বিদ্বান ছিলেন শূদ্রের যজ্ঞোপবীত ও বেদাধিকারের পক্ষে৷ অপরদিকে, তাঁদের বিপক্ষের বিতার্কিক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জীব ভট্টাচার্য ন্যায়তীর্থ, পঞ্চানন তর্করত্ন, পণ্ডিত তারাকান্ত, পণ্ডিত ঈশাশাস্ত্রী প্রমুখ৷ উক্ত শাস্ত্রার্থে পণ্ডিত দীনবন্ধু বেদশাস্ত্রীর যুক্তি, প্রমাণ ও বাগ্মিতার কারণে প্রতিপক্ষ পুরোপুরি পর্যদুস্ত হয়ে যায়৷ এই শাস্ত্রার্থের কিছুদিন পরে দীনবন্ধুজী 'ভাটপাড়া বধকাব্য' (অপ্রাপ্ত) নামক একটি গ্রন্থ রচনা করেন৷ 
 
দীনবন্ধুজীর কার্যক্রম শুধু গ্রন্থ লিখে আর্যসমাজের প্রচারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো না৷ একবার কলকাতা আর্যসমাজের কাছে সংবাদ আসে যে পূর্ববঙ্গের (বর্তমান বাংলাদেশের) ময়মনসিংহে হাজার হাজার হাজং পরিবারকে খ্রিস্টান মিশনারিরা ভুল বুঝিয়ে ধর্মান্তরিতের চেষ্টা করছে৷ এটি শুনে কলকাতা আর্যসমাজ দীনবন্ধুজীকে ময়মনসিংহ প্রেরণের সিদ্ধান্ত নেন৷ দীনবন্ধুজী এটি শোনা মাত্রই আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করে পণ্ডিত ভুবনমোহনকে সাথে নিয়ে ময়মনসিংহ চলে আসেন। দীনবন্ধুজীর ওজস্বিতা, বাগ্মিতা, পাণ্ডিত্য, প্রচারশৈলী এবং অপপ্রচার খণ্ডনের ফলস্বরূপ ময়মনসিংহের হাজার হাজার হাজং পরিবার ধর্মান্তরিত হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পায়৷
 
পণ্ডিত দীনবন্ধু বেদশাস্ত্রীর পারিবারিক জীবন সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য এখনো উপলব্ধ হয়নি৷ ফলে তিনি বিয়ে করেছিলেন কিনা অথবা করে থাকলে তাঁর সন্তান কতজন ছিলেন, তাঁরা কি করতেন এসব সম্পর্কে এখনো অজানা রয়েছে৷ তিনি ব্যক্তিগত জীবন যাপন অনেক অনাড়ম্বর ভাবে করতেন৷ তিনি কলকাতা আর্যসমাজের প্রচারের পাশাপাশি কলকাতা আর্য কন্যা মহাবিদ্যালয় এবং কলকাতা ওমেন্স কলেজ-এর ধর্মশিক্ষক পদে নিযুক্ত ছিলেন৷ এর পাশাপাশি তিনি ভারত সরকার থেকে স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসেবে প্রাপ্ত পেনশনের সামান্য অর্থ দিয়ে নিজের জীবন নির্বাহ করতেন৷ 
 
পণ্ডিত দীনবন্ধু বেদশাস্ত্রী তাঁর সারা জীবনে প্রায় অর্ধশতাধিক গ্রন্থ রচনা এবং অনুবাদ করেছিলেন৷ তিনি বেদসার, বৈদিক সন্ধ্যা বিধি, বৈদিক সন্ধ্যা ও উপাসনা, বৈদিক উপাসনা ও গায়ত্রী ব্যাখ্যা, বৈদিক সন্ধ্যা ও হবন বিধি, বৈদিক উপাসনা পদ্ধতি, আর্যসমাজ পরিচিতি, শুদ্ধি, অবতারবাদ, দেবদেবী ও মূর্তিপূজা, দিগ্বিজয়ী দয়ানন্দ, হিন্দু জাতিতত্ত্ব, জাতি না বজ্জাতি, অসমবর্ণ বিবাহ, জাতির বড়াই, বিধবা বিবাহের শাস্ত্রীয় প্রমাণ, বিধবা বিবাহের আপত্তি খণ্ডন, অশৌচ ও পরলোক, শ্রাদ্ধ ও পরলোক, বেদামৃত, ধর্ম পরিচয়, ধর্মশিক্ষা, আস্তিক্যবাদ, ধর্ম বা অধর্ম, আর্যসমাজের কথা, বঙ্গে দয়ানন্দ, গুরুগিরি প্রভৃতি গ্রন্থ রচনা করেন৷ এছাড়াও তিনি সামবেদের বঙ্গানুবাদ, ঋগ্বেদের প্রথম মণ্ডলের বঙ্গানুবাদ, যজুর্বেদের প্রথম অধ্যায়ের বঙ্গানুবাদ, অথর্ববেদের প্রথম কাণ্ডের বঙ্গানুবাদসহ সত্যার্থপ্রকাশ, সংস্কারবিধি, ব্যবহার ভানু, ভ্রমোচ্ছেদন, ভ্রান্তি নিবারণ প্রভৃতি গ্রন্থ অনুবাদ করেন৷ কিন্তু দুঃখের বিষয়, বর্তমানে এসকল গ্রন্থের অধিকাংশই অপ্রাপ্ত রয়েছে৷ 
 
বঙ্গে আর্যসমাজের এই মহান প্রচার, প্রখ্যাত বেদবিদ্বান দীনবন্ধু বেদশাস্ত্রী ২১শে এপ্রিল, ১৯৭৯ সালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন । 
 
© বাংলাদেশ অগ্নিবীর

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.