দিগ্‌গজ শাস্ত্রার্থ মহারথী পণ্ডিত মনসারাম "বৈদিক তোপ‌"

 


দিগ্‌গজ শাস্ত্রার্থ মহারথী পণ্ডিত মনসারাম "বৈদিক তোপ‌"


আগ্নেয় পুরুষ পণ্ডিত মনসারাম জীর‌ জন্ম ১৮৯০ সনে । তাঁর জন্ম সনেই মুনিবর পণ্ডিত গুরুদত্ত বিদ্যার্থী জীর‌ অকাল প্রয়াণে আর্যসমাজে‌ এক শোকের ছায়া নেমে আসে । বীরভূমি হরিয়াণার হিসার জেলার হড্ডাঁবালা নঙ্গল গ্রামে কট্টর পৌরাণিক লালা শঙ্করদাস নামে একজন বৈশ্যের গৃহে পণ্ডিত জীর‌ জন্ম হয় । 

পণ্ডিত জীর‌ গৃহে তাঁর পিতা লালা শঙ্করদাস জী পৌরাণিক দেবীর মন্দির স্থাপন করেছিলেন । তিনি প্রতিদিন এই দেবীর‌ পূজা করতেন । শঙ্কর দাস জী প্রতিদিন দেবীর জন্য‌ অর্পণকৃত কোষাগারেদুই পয়সা করে রাখতেন । বালক মনসারাম তাঁর পিতার অনুপস্থিতিতে প্রত্যহ কোষাগারে দুই পয়সা‌ করে‌ অর্পণ করে‌ কর্তব্য সম্পন্ন করতেন এবং তাঁর পিতার ন্যায় অন্ধভক্তি দর্শাতেন ।

বামনবালা গ্রামে পণ্ডিত জীর প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন হয় । পণ্ডিত মনসারাম জী প্রাইমারি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে টোহানা এর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে প্রবিষ্ট হন । 

এই সময়ে পণ্ডিত জীর জীবনে দুইটি বিশেষ ঘটনা ঘটে । টোহানা‌ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ১৯০৭ সনে যখন তিনি অষ্টম শ্রেণিতে অধ্যয়ন করতেন সে সময়ে তাঁর পিতা দেহত্যাগ করেন । পণ্ডিত মনসারাম জীর‌ গৃহে পাট‌ও‌য়ারী রামপ্রসাদ নামে একজন ব্যক্তি থাকতেন। তিনি ছিলেন দৃঢ় আর্যসমাজী, সদাচারী, মধুরভাষী, অত্যন্ত পরোপকারী মানুষ । পাট‌ও‌য়ারী জী পরম সত্য সনাতন বৈদিক ধর্মের প্রচারে‌ একনিষ্ঠ ছিলেন । লালা শঙ্করদাসজী পাট‌ও‌য়ারী জীর‌ সহিত নিয়মিত সৎসঙ্গে বেদ এর পরম সত্য স্বরূপ সম্বন্ধে পূর্ণ জ্ঞাত হয়ে‌ও এবং বৈদিক সিদ্ধান্তকে মেনেও পৌরাণিক অন্ধকূপ থেকে বাহির হতে পারেন নাই । 

পাট‌ও‌য়ারী জী পণ্ডিত জীকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন । সব প্রকারের সহযোগিতা‌ও করতেন । প্রতিদিন মহাশয় রামপ্রসাদ জী বালক মনসারামকে বৈদিক সিদ্ধান্তের জ্ঞান প্রদান করতেন । বাল্যকাল থেকেই পণ্ডিত মনসারাম জীর একটি বিশেষ গুণ ছিল যে‌, কোনো বিষয় যুক্তিসঙ্গত‌ তথা‌ ন্যায়সংগত হলেই তা‌ তিনি নির্দ্বিধায় গ্রহণ করে নিতেন । পাট‌ও‌য়ারী জীর‌ উপদেশে‌র প্রভাবে এবং সৎসঙ্গে অতি শীঘ্রই বৈদিক সিদ্ধান্তকে তিনি হৃদয়ঙ্গম করে নেন‌, আর্যসমাজে প্রবিষ্ট হন । একারণে‌ পণ্ডিত মনসারাম জী‌ মহাশয় রামপ্রসাদ জীর‌ এই উপকারকে প্রতিনিয়ত স্মরণ করে‌ মৃত্যুর অন্তিমক্ষণ অবধি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন । পণ্ডিত মনসারাম জী‌র মনোভাব সেটাই ছিল, যা‌ ভক্তরাজ অমীচন্দ্র জী মহর্ষি দয়ানন্দ জীর প্রতি ব্যক্ত করেছিলেন –

"তুম্হারী কৃপা সে অজী মেরে ভগবন্, মেরী জিন্দগী নে অজব পলটা খায়া ॥"


এরপর পণ্ডিত জী সংস্কৃত শিক্ষা‌ এবং সকল‌ শাস্ত্রের বিশদ‌ অধ্যয়নে মনোনিবেশ করেন । প্রথমে তিনি কুরুক্ষেত্রে পৌরাণিকদের সংস্কৃত পাঠশালায় প্রবিষ্ট হন । এই পাঠশালায় শ্রী বন‌ওয়ারীলাল আজাদ তাঁর সহপাঠী ছিলেন । তিনি একজন উত্তম শৈলীর আর্যকবি ছিলেন । তিন-চার বর্ষ কনখল নগরের ভাগীরথী পাঠশালায় সংস্কৃত অধ্যয়ন করতে থাকেন । দেববাণীর‌ পঠন-পাঠনের জন্য গুরুকুল কাঁগড়ীতে পত্রবাহক পদে কার্য‌ও করেছিলেন, তৎপশ্চাৎ কাশীতে চলে যান ।

কাশীতে পৌরাণিক ব্রাহ্মণ‌ বিদ্যার্থীদের সংস্কৃত পঠন-পাঠনের জন্য বিবিধ সুযোগের ব্যবস্থা ছিলো, পরন্তু পণ্ডিত মনসারাম জীর‌ পঠন-পাঠনের তেমন কোনো সুযোগ ছিল না, এমনকি তাঁর ভোজন ব্যবস্থা ছিল না । কারণ তিনি ব্রাহ্মণ বংশে জন্মেছিলেন না । দেব-বাণী অধ্যয়নের‌ জন্য না জানি কত‌ মাস‌ তিনি ক্ষুধাতৃষ্ণায় জর্জরিত ছিলেন । সমস্ত দুঃখ-কষ্ট সহ্য‌ করেও তাঁর হৃদয়ে কার‌ও প্রতি কোনো দুর্ভাবনা অথবা প্রতিক্রিয়া কদাপি ছিল না ।


পণ্ডিত জী জঙ্গল থেকে বরই জাতীয় ফল‌ সংগ্রহ করে তা‌ খেয়ে‌ জীবন নির্বাহ‌ করতেন । একদিন তিনি ফল‌ সংগ্রহে বের হয়েছিলেন তখন‌ সে-সময় একজন সেঠ সেখানে থেকে যাচ্ছিলেন । পণ্ডিত জীকে সংস্কৃত এর বিদ্যার্থী ভেবে‌ জিজ্ঞাসা করেন- 'এখানে কী করছো ?' পণ্ডিত মনসারামজী বলেন- 'সংস্কৃত অধ্যয়নের জন্য এখানে‌ অবস্থান করছি । ক্ষুধা‌ নিবারণের জন্য এখান থেকে ফল‌ সংগ্রহ করছি । অধ্যয়ন সমাপ্তির পর ক্ষুধা নিবারণের জন্য ফল গুলো খাবো ।'


তৎপশ্চাৎ সেঠ জিজ্ঞাসা করেন -- 'পাঠশালার‌ ক্ষেত্রে ভোজন কেনো করো না ?' পণ্ডিত জী বলেন – 'সেখানে কেবল ব্রাহ্মণ বিদ্যার্থীরাই ভোজন করে, আমি আগার‌ওয়াল বংশের ।'

এ কথা শুনে সেঠ এর হৃদয়ে এক অন্যরকম অনুভূতির অনুভব হয় । তিনি স্বয়ং পাঠশালার বিভিন্ন ক্ষেত্রে দান করতেন । তিনি মনসারাম জী‌কে অন্য‌ একটি পাঠশালার‌ ক্ষেত্রের‌ নাম বললেন এবং সেই সেই সাথে বললেন- 'তুমি সেখানে যেয়ে ভোজন করো‌, কেউ তোমার‌ পদবী জিজ্ঞাসা করবে না ।'


ভোজন-ব্যবস্থা নিশ্চিত হ‌ওয়ার‌ পর‌ পণ্ডিত মনসারামজী বিদ্যাধ্যয়নে একাগ্রচিত্তে মনোনিবেশ করেন । পঠন-পাঠন সমাপ্তির পর পণ্ডিত মনসারামজী কাশীর পণ্ডিতগণের সমক্ষে উপস্থিত হন এবং প্রশ্ন করেন- 'আমি আগার‌ওয়াল‌ বংশের', এবং সেই সাথে তিনি তাঁর পাণ্ডিত্যের নৈপুণ্যতা প্রদর্শন করে বলেন - 'আমাকে পণ্ডিত বলার‌ অধিকার প্রাপ্ত হতে পারি কী, নাকি নয় ?' এ বিষয়ে প্রচুর বাদ-বিবাদ হয় । অন্তে পণ্ডিত মনসারামজীর বিজয় হয় । তাঁকে পণ্ডিত পদবী প্রদান করা হয় ।


শিক্ষা সম্পন্নের পশ্চাৎ তিনি কার্যক্ষেত্রে প্রবেশ করেন । তাঁর গম্ভীর স্বাধ্যায়, তীব্রবুদ্ধি, অকাট্য তর্ক-শৈলীর কারণে মূহুর্তের মধ্যে তাঁর কীর্তি সমগ্র‌ ভারতে‌ ছড়িয়ে পড়ে ‌। আর্য জগতে এক নতুন ভাস্বর‌ নক্ষত্র‌রূপে প্রতিষ্ঠিত হন ।


 পণ্ডিত জী সিরসা নগরে ধর্ম প্রচারে রত ছিলেন । তখন স্বামী স্বতন্ত্রানন্দজী সিরসা নগরে‌ অবস্থান করছিলেন । তাঁর বহুমুখী প্রতিভায় প্রভাবিত হয়ে স্বামী স্বতন্ত্রানন্দজী তাঁকে পাঞ্জাবের আর্যপ্রতিনিধি সভায় নিযুক্ত করেন । পাঞ্জাবের সুলতানপুর লোধী এবং সিরসা নগরের আর্য সমাজ মন্দিরে পুরোহিত পদে নিজেকে সুশোভিত করে স্বীয় বিদ্বতার প্রভাব সর্বত্র‌ ছড়িয়ে দেন । পণ্ডিতজী সমগ্র পাঞ্জাব বৈদিক নাদে প্রকম্পিত করে তোলেন । পূজ্যপাদ স্বামী সর্বানন্দজী মহারাজ এবং শ্রী শান্তিপ্রকাশজী পণ্ডিত জীর ঘনিষ্ঠ মিত্র ছিলেন ।


একজন আর্যের জন্য যে‌সব কর্ম অত্যাবশ্যক ছিলো, পণ্ডিত জী সর্বদা সেসব কর্ম করার প্রযত্নে মনোনিবেশ ছিলেন । বিবিধ‌ প্রতিভাময় প্রথিতযশা গুণে গুণান্বিত পণ্ডিত জীর বিশেষ তিনটি গুণ ছিল — অত্যন্ত সাহসী ছিলেন তিনি, কিঞ্চিৎমাত্র লোভ ছিল না তাঁর, ছিলেন দানী এবং উদার । শাস্ত্রার্থে তাঁর ছিল অনন্য প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব । শাস্ত্রার্থ-সংগ্রামের বিজয়ী যোদ্ধা ছিলেন । 

রোপড় নগরে শাস্ত্রার্থ উৎসব চলছিলো । অনেক দিবস অতিবাহিত হ‌ওয়ার পর‌ও শাস্ত্রার্থের সমাপ্তি হচ্ছিলো না । অন্তে পণ্ডিত মনসারাম জীকে আমন্ত্রণ করা হয় । মূহুর্তের মধ্যে তাঁর বিচক্ষণতা‌, তর্কশৈলী‌ এবং অপরাজেয় যুক্তিশৈলীর‌ মাধ্যমে পাখণ্ডদের খণ্ডন করে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেন। 

একবার ভিবানী নগরে পৌরাণিকদের সহিত শাস্ত্রার্থের আয়োজন করা হয় । ধূর্ত পৌরাণিকগণ পণ্ডিতজীকে দেওয়া নির্ধারিত সময়ের আগে বাঁধা দেন । শাস্ত্রার্থের নিয়মানুসারে পণ্ডিতজীর সময় ২৫ মিনিট ছিলো । এমনকি পণ্ডিতজীকে লাঠি দিয়ে‌ও আক্রমণ করা হয় । এ বিষয়ে পণ্ডিতজী একটি শীর্ষক - 'মেরে পচ্চীস মিনিট।' লেখ‌ লিখেন । এই শাস্ত্রার্থে টেকচন্দ্র জীর‌ উপর এমন প্রভাব পড়ে যে‌, তিনি সমস্ত‌ বিগ্রহ নদীতে বির্সজন দেন এবং বৈদিক ধর্মের সেবক‌ হয়ে যান‌ ।


'বৈদিক তোপ' নামে তিনি সমগ্র‌ ভারতবর্ষে খ্যাতিমান হন । পণ্ডিত জীর নামের‌ সাথে 'বৈদিক তোপ' নামটি অভিন্ন অঙ্গে জুড়ে যায় । সমগ্র‌ পৌরাণিক জগৎ তাঁর নাম শুবণ মাত্র‌ই কম্পিত হতো ।

 স্বাধীনতা সংগ্রামে‌ও তাঁর অনন্য‌ ভূমিকা ছিলো । অনেকবার কারাভোগ করেছেন। দেহান্তের‌ পূর্বে‌ও সত্যাগ্রহে অংশ নিয়েছেন । হায়দ্রাবাদ-সত্যাগ্রহে তাঁর মহত্ত্বপূর্ণ অবদান ছিলো । আন্দোলনে‌ হিসার এবং অম্বালা আদি জেলে‌ কারাভোগ করেছেন । ১৯২২ সনে গান্ধীর‌ প্রথম সত্যাগ্রহে অংশ নিয়ে কারাভোগের সময় ন্যায়ালয়ের ডিপুটি কমিশনার এবং জেলা ন্যায়াধীশ যখন পণ্ডিত জীর‌ সমক্ষে আসেন তখন তিনি তাঁর চোখ-মুখ কাপড় দিয়ে‌ ঢাকেন‌ । এমনটা করার‌ কারণ তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হলে‌ তিনি বলেন, " স্বীয়‌ স্বার্থ সিদ্ধির জন্য ধর্ম‌ এবং দেশের হানিকারকদের মুখ দর্শন করবেন না তিনি ।"

এরূপ বাক্য‌ ন্যায়ালয়ের জন্য অপমানজনক (Contempt of Court ) ছিল। তিনি ছিলেন ন্যায়ালয়ের সমালোচনাকারী প্রথম সত্যাগ্রহী । এই সমালোচনার দরুন তাঁকে অনেক নিপীড়িত হতে হয় । এতো কিছু হ‌ওয়ার পর‌ও তিনি ছিলেন অসমসাহসী যোদ্ধা ।


 পণ্ডিত মনসারামজী একজন পরিশ্রমী, সকল শাস্ত্র নিষ্ণাত, গবেষক, যশস্কর লেখক এবং উচ্চকোটির কবি ছিলেন। সংস্কৃত, হিন্দি, উর্দু ভাষায় একজন সশক্ত লেখক ছিলেন । অবৈদিক মতালম্বীদের‌ জগতে‌ তাঁর প্রভাব কীরূপ ছিল, এ বিষয়ে‌ নিম্ন ঘটনা অতীব মহত্ত্বপূর্ণ –  


এক বার রামাঁমণ্ডী নগরে একজন জৈন পণ্ডিত প্রবচন দিতে এসেছিলেন । একদিন সভার সমাপ্তির পর পণ্ডিত জী এক গ্রামীণ কৃষক বেশ ধরে‌ জৈন পণ্ডিতকে তাদের অহিংসা-সম্বন্ধী মতের উপর কিছু প্রশ্ন করেন । প্রশ্নের শৈলী বুঝতে পেরেই জৈন পণ্ডিত তৎক্ষণাৎ জিজ্ঞাসা করলেন, ''আপনি পণ্ডিত মনসারাম তো নন? এমন শৈলীর প্রশ্ন কেবল তিনিই করতে সক্ষম । সাধারণ ব্যক্তি এতো গম্ভীর‌ভাবে চিন্তন করতে সর্বথা অক্ষম ।' সেই গ্রামীণ ব্যক্তি পণ্ডিত মনসারাম জীই ছিলেন । তৎপশ্চাৎ তিনি তাঁর স্বীয় স্বরূপে প্রকটিত হলেন ।


পণ্ডিতজী হিসার নগরে স্থান-স্থানে শাস্ত্রার্থ উৎসবের আয়োজন করে পৌরাণিক জগতকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিতেন । 

 ১৯৩১ সনের মে‌ মাসের ২-৩ তারিখে আর্যসমাজ, জাখল এর বার্ষিকোৎসবে শাস্ত্রার্থের আয়োজন করা হয় । শাস্ত্রার্থের অধ্যক্ষ ছিলেন স্বামী স্বতন্ত্রানন্দজী এবং শাস্ত্রার্থকর্তা ছিলেন প্রসিদ্ধ মহারথী লোকনাথজী 'তর্কবাচস্পতি' । পণ্ডিতজী 'শাস্ত্রার্থ-জাখল' নামে উর্দু ভাষায় একটি পুস্তক রচনা করেন । পৌরাণিক জগতে তোলপাড় শুরু হয়ে যায় । পৌরাণিক‌গণ অনেক ধন ব্যয় করে 'সনাতনধর্ম বিজয়' নামক একটি পুস্তক রচনা করে । পুস্তকটি মূলতঃ অকথ্য‌, অপভাষায় পূর্ণ‌ ছিলো । উক্ত পুস্তকের খণ্ডনে পণ্ডিত মনসারাম জী অত্যন্ত সভ্য ভাষায়, নিষ্ঠাবান শৈলীতে‌ সপ্রমাণ যুক্তি এবং শতসহস্র প্রমাণে সুভূষিত প্রায়ঃ পাঁচ গুণ বৃহৎ‌ পুস্তক রচনা করেন, পুস্তকটির নাম – 'পৌরাণিক পোপ পর বৈদিক তোপ'। 


পণ্ডিত জীর তর্ক-শৈলী কতোটা‌ তীক্ষ্ণ ছিল, তার কিঞ্চিৎ আভাস ভটিণ্ডা শাস্ত্রার্থ এর ইতিহাসের মাধ্যমে জ্ঞাত হ‌ওয়া রায় ।


 পণ্ডিতজীর চারটি প্রশ্ন-

১. পৌরাণিক মতবাদে পশুবধ আদিকাল থেকেই চলমান নাকি পরবর্তীতে‌ সংযোজিত করা হয়েছে ? 


২. ধীবর পুত্রী সত্যবতীর গর্ভে জন্মানো‌ ব্যাসজীর বর্ণ পৌরাণিক মতানুসারে কী ?


৩. পৌরাণিক মতানুসারে শিখ, জাট, স্বর্ণকার এবং কায়স্থ কোন বর্ণের ?


৪. পৌরাণিক মতানুসারে দলিত ভ্রাতাগণ, যবন‌ ( খ্রিষ্টান-মুসলিম মতালম্বী) ভালো নাকি খারাপ ? যদি ভালো হয় তাহলে তাদের সাথে ভালো ব্যবহার কী কারণে করা হয় না ? 


পণ্ডিত মনসারামজী জীর‌ প্রশ্নসমূহ শ্রবণ‌ করে তৎক্ষণাৎ বিপক্ষ‌ পৌরাণিক সকলের‌ সমক্ষে কান ধরে ক্ষমা‌ প্রার্থনা করে পলায়ন করে ।

সঙ্গরূর-শাস্ত্রার্থ অনুষ্ঠানে মৃতক শ্রাদ্ধের উপর ওজস্বী ব্যাখ্যান দেওয়ার সময় পণ্ডিতজী বলেন –'আমি‌ও এই জন্মে কোথাও থেকে এসেছি । শ্রাদ্ধে আত্মাকে অর্পণকৃত‌ দ্রব্য‌ যদি‌ আত্মা পেয়ে থাকে তাহলে আমার দ্রব‌্য‌ কোথায় ? যদি শ্রাদ্ধের দ্রব্য‌ মৃতক পিতরের‌ কাছে পৌঁছানো সম্ভব হয়, তাহলে আমার পার্সেল কোথায় গেলো ?'

শিখা সম্বন্ধে ধূর্ত‌ পৌরাণিকগণ আর্যসমাজের উপর‌ মিথ্যা আক্ষেপ করতে থাকে । 

পণ্ডিত মনসারামজী বলেন - -'যদি শিখা রাখলেই কেউ হিন্দু হয়ে যেতো, তাহলে বিনা শিখায় শিখ এবং স্ত্রী হিন্দু কীভাবে হতে পারে ?' 

পণ্ডিত মনসারাম জী ছিলেন বিদ্যার সাগর। 

তাঁর ব্যাখ্যান সর্বদা‌ সৈদ্ধান্তিক ছিল‌ । ব্যাখ্যানে প্রমাণের বহুলতা এবং রোচকতা অন্ত পর্যন্ত পরিস্ফুট হতো ।

প্রসিদ্ধ পৌরাণিক কালুরাম‌, মাধবাচার্য‌ থেকে শুরু করে‌ তৎকালীন প্রায়ঃ সকল‌ প্রসিদ্ধ‌ পৌরাণিক-জৈন‌-বৌদ্ধ‌-ইসলাম‌ মতবাদীদের‌ স্বীয় তীক্ষ্ণ যুক্তি‌র প্রভাবে‌ পরাস্ত করেছিলেন ।

পণ্ডিত জী‌ মহর্ষি দয়ানন্দ জী অপ্রতিম ভক্ত ছিলেন । নিয়মিত সন্ধ্যা করতেন । স্বদেশী বস্ত্র পরিধান করতেন । ঘী-দুধ প্রেমী ছিলেন । দক্ষিণার সম্পূর্ণ অংশ‌ই শ্রী স্বামী স্বতন্ত্রানন্দজীকে বেদ প্রচারের জন্য দিয়ে দিতেন । পণ্ডিত জী‌ প্রায়ঃ ত্রিশ (৩০) বছরের অধিক‌ আর্য‌ সমাজের প্রচারে রত‌ ছিলেন । মৃত্যুর অন্তিমক্ষণ‌ অবধি‌ আর্য‌ সমাজের প্রচার করেছেন । তিনি ছিলেন একজন আদর্শ সুধারক ।  

১৯৪১ সনের ১০‌ই অক্টোবর বুডলাঢা মণ্ডীতে (পাঞ্জাব) আর্য‌ জগতের এই ভাস্বর‌ নক্ষত্রের‌ দেহাবসান হয় ।

আজ পণ্ডিত জীর পার্থিব শরীর অবিদ্যমান, পরন্তু তাঁর যশরূপী শরীর অজর তথা অমর ।‌ তাঁর অপ্রতিম গুণসমূহ এবং সাহিত্যরূপে তিনি সদা অমর থাকবেন।


গ্রন্থরাজিঃ

1.‌একটি শীর্ষক গুমরাহী কে সমুদ্র মে রাস্তী কী কিশ্ত (অসত্য সিন্ধু মে সত্যনৌকা)


2. সত্যার্থপ্রকাশ কা সার (উর্দু) 


3. পৌরাণিক পোল প্রকাশ প্রসিদ্ধ পৌরাণিক ধূর্ত কালুরাম লিখিত 'আর্যসমাজ কী মৌত' নামক এক পুস্তকের বৃহৎ‌ খণ্ডন । এ পুস্তকে‌ কালুরাম কৃত‌ মিথ্যাচারের‌ প্রতি‌ লাইন‌ সপ্রমাণ‌ সহিত প্রবলভাবে খণ্ডন করা হয়েছে ।


4.চেতাবনী প্রকাশ (উর্দু) 

পৌরাণিক পণ্ডিত রাজনারায়ণ 'চেতাবনী' নামক শীর্ষক এক পুস্তক লিখেছিলো । এ পুস্তকে সে‌ কলিযুগের সমাপ্ত এবং সত্যযুগের প্রারম্ভ হ‌ওয়ার ভবিষ্যবাণী করেছিলো। এই ভ্রান্তি যুক্ত ধারণার খণ্ডনে পণ্ডিত জী উক্ত পুস্তক প্রণয়ন করেন ।


5.‌ পৌরাণিক পোপ পর বৈদিক তোপ (১৯৩৬ সন)  

 আর্য সাহিত্য মন্দির, লাহোর থেকে প্রকাশিত হয় । পাঞ্জাব সরকার এই পুস্তকের উপর প্রতিবন্ধকতা জারি‌ করেছিলো । এই পুস্তক তিনি মহাশয় রামপ্রসাদ জীকে সমর্পণ করেন ।


6. পৌরাণিক দম্ভ কা বৈদিক বম্ব 

মহর্ষি দয়ানন্দ জীর নির্মল চরিত্রের উপর পৌরাণিকগণ বিভিন্ন সময়ে মিথ্যা আরোপ এবং অনেক আপত্তিজনক কথা‌ লিখে বিভিন্ন পুস্তক প্রকাশিত করেছে‌ । এর মধ্যে লায়লপুর নিবাসী শম্ভুদয়াল ত্রিশূল' লিখিত তথা ১৯২৬ সনে প্রকাশিত 'দয়ানন্দ ভাব চিত্রাবলী', মাধবাচার্য রচিত 'দয়ানন্দ কে সির পর বুদ্ধদেব কা জুতা' গোপাল- মিশ্র হরয়াণবী লিখিত 'কলিযুগ ইন্সান কে লিবাস মেং ' অর্থাৎ 'অসলী সঙ্গীত দয়ানন্দ', 'শিবপূজা ঔর দয়ানন্দ কী তালীম' 'রামপূজা ঔর শৈতান কী তালীম' আদি মুখ্য ছিলো। 

পণ্ডিত মনসারাম জী এই সমস্ত মিথ্যাচার পরিপূর্ণ পুস্তকের সম্মিলিত উত্তর এবং অতিশয় বৃহৎ‌ খণ্ডনে উক্ত পুস্তক প্রণয়ন করেন । পণ্ডিত ধর্মনারায়ণ শর্মা নামে ছদ্ম নামে পুস্তকটি প্রকাশিত করে । কারণ‌ প্রবল সম্ভাবনা ছিল, লেখক এবং প্রকাশকের উপর সরকার আক্রমণ করতো । এ কারণে পুস্তকে লেখক, প্রকাশক এবং মুদ্রক আসল নাম দেওয়া হয়েছিলো না । 


7. শাস্ত্রার্থং বিবরণ — মেরে পচ্চীস মিনিট সঙ্গরূর-শাস্ত্রার্থ বিবরণ, শাস্ত্রার্থ-জাখল মণ্ডী (উর্দু ভাষায় প্রকাশিত ) (১৯৩৯ সন), রাবণ জোগী কে ভেষ মেং (১৯২৪ সন), পৌরাণিক সভায় আয়োজিত ভটিণ্ডার বার্ষিকোৎসবে শাস্ত্রার্থ-বিবরণ (উর্দু) (১৯২৫ সন)


8. ফলিত জ্যোতিষ মীমাংসা (২০২৪ বিক্রমাব্দ) ('চেতাবনী প্রকাশ' পুস্তকের একটি অংশ)


9. আর্যসমাজ ক্যা হৈ ? (২০৩২ বিক্রমাব্দ)

( এটি‌ও 'চেতাবনী প্রকাশ' পুস্তকের একটি অংশ ) 


10. শিবপুরাণ (১৯২৬ সন) তথা ভবিষ্য পুরাণের আলোচনা বিষয় দু'টি গ্রন্থ ।

 স্বামী বেদানন্দ তীর্থ সম্পাদিত পুরাণালোচন গ্রন্থমালার অন্তর্গত ।

 লাহোর থেকে প্রকাশিত হয় ।


অপ্রকাশিত গ্রন্থ –


11.আর্যসমাজ কে বগুলে ভগত 


12. ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ কী আলোচনা


-- বিদুষাং বশংবদঃ 


Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.